৭১ টিভির মিথিলা ফারজানা বলেছিলেন জায়গা দখলের অন্যতম কৌশল মসজিদ বানানো।

Stay Conneted

৭১ টিভির মিথিলা ফারজানা বলেছিলেন জায়গা দখলের অন্যতম কৌশল মসজিদ বানানো। কারণটা সবাই জানে। মসজিদ ভাঙ্গতে কেউ সাহস পাবে না! এখন মিথিলার ছবি দিয়ে ইসলামিক জঙ্গিরা বলছে তিনি ইসলাম বিদ্বেষ করেছেন। মিথিলা প্রকৃত সত্য কথাই বলছেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মসজিদ দখল করা জমি হয়েছে। সঙ্গে মন্দির মঠের জমি দখল করতে গড়ে উঠছে মসজিদ। এরকম অসংখ্য ঘটানা দেখার অভিজ্ঞতা আছে। সেই চোখে দেখা ঘটনা নিয়ে গল্প লিখেছিলাম। যারা আগে পড়েননি তারা পড়তে পারেন।
..........................................................
জীবনদা বললেন, তুমি কি কিছু খাবে?

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল, সেভাবেই বললাম, এখন আবার কি খাবো?

-এখন না, দুপুরের কথা বলছি। যদি আরো সময় থাকতে চাও তাহলে মন্দিরে দুপুরের খাবারের কথা বলি।

-দুপুর কেন, রাতেও থাকবো ভাবছি…

জীবনদা হেসে চলে গেলেন। ব্রহ্মপূত্রের পাড় ঘেঁষে একশত সাঁইত্রিশ বছরের পুরোনো এই কালি মন্দিরটি শুক্রবার ছাড়া বেশ নিড়িবিলি। জীবনদার সঙ্গে এই নিয়ে সাত বার আসা হলো। প্রথমবার আসার পর পরবর্তী যতবার এসেছি আমাকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছে। যখন শহুরে জীবনে একদম হাঁপিয়ে উঠি, তখন শহর ছেড়ে একটু শহরতলীর দিকে, শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে রিকশায় চল্লিশ মিনিট গ্রামের রাস্তার দুপাশে গাছের ছায়ায় ছায়ায় শ্রী শ্রী ভবেশপুর কালি মন্দিরের জং ধরা টিনের গেইটের সামনে এসে রিকশা থামে। জীবনদাকে কখনো মন্দিরে পূজাটুজা দিতে দেখিনি। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিত পরিবারটির সঙ্গে তার হৃদয়ের সম্পর্ক। বুড়ো পুরোহিত ফণিভূষণ জীবনদাকে “কর্তা” বলে এক দিলখোলা অভ্যর্থনা জানায় প্রত্যেকবার। আমার আর জীবনদার প্রিয় জায়গা মন্দিরের পিছনের চাতালে, এখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের জল ছোঁয়া যায়। এখন, চৈত্র মাসের এমন তাঁতানো সকালবেলা, অশ্বত্থের ছায়ায় ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে উঠে আসা শীতল বাতাসে গা জুড়িয়ে দুচোখে ঘুম নামিয়েছে। মন্দিরে দুপুরবেলা যে ভোগটা হয়, এই নিয়ে কয়েকবার খেযেছি, খিচুরী-সবজি, বড় সুস্বাদু খেতে। আগে থেকে চালডালের টাকা দিয়ে দিলে দুপুরের ভোগে ভাগ বসানো যায়। আমরা অবশ্য একটু আগে খুব করে খেয়ে এসেছি বাজারের ভাজাপুড়ির দোকান থেকে। গরম গরম জিলিপি অনেকদিন খাওয়া হয়নি।জিলিপির রস আর ব্রহ্মপুত্রের বাতাস এখন আমার চোখে ঘুম এনে দিচ্ছে! জীবনদা ফণিভূষনের সঙ্গে কি নিয়ে যেন আলাপ করছেন, ঘর থেকে ফণির ছেলের বউয়ের গলা শোনা যাচ্ছে, সন্ধ্যা, ও সন্ধ্যা, একটু জল আনতো…। 

সন্ধ্যা ৬-৭ বছরের একটা মেয়ে। ফণির ছেলেটা বাজারে এই সময় সবজি বেচে। মন্দির থেকে যে বেতন পায় তাতে তো ভাল মত চলে না। পাড়াগার মন্দির, দক্ষিণাও কম, মন্দিরের আয় কম হলে তাদেরও বেতনভাতাও সেরকম হবে। আমি মুসলমান ঘরের ছেলে জানার পর ফণিভূষণ প্রথমদিকে একটু নিজেকে খোলসে ঢেকে রাখতো। কিন্তু এই কয়েক বছরের আসা যাওয়ায় আস্তে আস্তে সে দুরত্বটা ঘুচেছে। জীবনদা ভক্তপুরুষ নন, ঈশ্বরে তার বিশ্বাস আছে কিনা জানি না। তবে তাকে কোনদিন আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্ম করতে দেখিনি। কোনদিন কোন মূর্তির সামনে মাথা নোয়াতে দেখিনি। কতদিন তার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তর্ক লাগতে চেষ্টা করছি, তিনি আগ্রহ দেখাননি। উনি গানবাজনার মানুষ, মন্দিরে খোল-তবলা বাজিয়ে কীর্তনে সঙ্গত দেন। সম্ভবত মন্দিরের সঙ্গে এই সূত্রেই তার ঘনিষ্ঠতা…।

মন্দির থেকে বেরিয়ে কাঁচা মাটির রাস্তাটার দুইপাশে কাঠমলতির ফুলের ঝোঁপ। এই ফুলগুলো নদীর ওপাড়ে বিক্রি হয় সকালবেলা। দুপাশের ফসলের ক্ষেত। অনেকটা দূর গেলে শ্মশান, শ্মশান ছাড়িয়ে রাস্তাটা একদম নদীর ধারে গিয়ে মিশে গেছে। শ্মশানের সাধুজির কাছ থেকে কতদিন গাঁজা নিয়ে খেয়েছি। পূবের আকাশে বড় গোল ঠান্ডা পূর্ণিমার চাঁদ, মন্দিরের চাতালে শুয়ে অপার্থিব এক পৃথিবীর রূপ দেখতে দেখতে রাত ক’টা বেজে গেছে কতদিন হুঁস থাকেনি। কাঠ মালতির ঝোপের অন্ধকারে জোনাকীর ঝাঁক কত অন্ধকার চাঁদহীন রাতে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে খেয়াঘাট পর্যন্ত। জীবনদা আর আমি লম্বা করে বিড়ি টানতে টানতে চলে গেছি হেঁটে ঘাট পর্যন্ত। এখানে সন্ধ্যের পরই রিকশাটিকশা বন্ধ হয়ে যায়।

শান্ত, সবুজ, নদী আর মাটির কাছাকাছি শহুরে দালানকোঠার ভীড় ভুলে কয়েকটা ঘন্টা বেড়ানোর বাইরে এখানে আসলে আমার আসার দ্বিতীয় কোন কারণ নেই। তবু কি আশ্চর্য এই গল্পটা একটা মন্দিরকে নিয়েই। মাস আটেক পর একদিন জীবনদাকে যখন বললাম, চলেন ভবেশপুর! জীবনদা স্বভাবসূলভ মৃদু হেসে বললেন, যাবে? চলো তাহলে একদিন…।

…কিন্তু… ও হরি! একী দেখছি সামনে? মন্দিরের গা ঘেষে মাটি ভড়াট করে লম্বা করে টিনের চালাঘর উঠেছে। বাশেঁর মাথায় শিকের বাক্সে মাইক…।

-জীবনদা, মসজিদ!

জীবনদা মৃদু হাসলেন।

নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে পাড় ভড়াট করে মাস ছয় আগে মসজিদটা তুলেছে গায়ের লোকেরা। মুড়ির কারখানা করে দুহাতে কাঁচা পয়সায় ভরে গেছে আশেপাশের দশ-বিশ ঘর। মসজিদটি তাদেরই অবদান…। 

-কি হচ্ছে এসব জীবনদা? আমার কন্ঠে উদ্বেগ।

-কেন, মন্দির হতে পারলে মসজিদ হতে পারবে না?

-একশবার হতে পারবে। কিন্তু মন্দির আছে জেনেও তার পাশে মসজিদ করার মানে কি?

-মন্দির ভেঙ্গে তো আর করেনি…

জীবনদার মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। জীবনদার মুখে কৌতুক, যেন খুব মজা পাচ্ছে এসব বলে। একটা হাত আমার কাঁধে রেখে বললেন, সুষুপ্ত, কষ্ট পেয়ো না ভাই! কিছুই করতে পারবে না। তাহলে আর শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে লাভ কি? যা ঘটছে চারপাশে সেদিকে তাকিয়ে থেকো না। তাহলেই দেখবে খুব সুখী হতে পারবে। আমি তো তাই করি। কিচ্ছু হয়নি এরকম ভান করে চলি…।

ফণিভূষণ এসে বলল, মসজিদ কমিটি কাল বলে গেছে সন্ধ্যার নামাজের পর যেন মন্দিরে ঘন্টি বাজে। না হলে নামাজে খুব সমস্যা হয়…। মন্দির কমিটি এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে সভা ডেকেছে, সভা আর কি, মসজিদের সঙ্গে ঝগড়াতে তো যাওয়া যাবে না…।

চাতালের নিচে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যাকে নামতে দেখলাম। পৃথিবী এখন আবছা আঁধারে ঢেকে গেছে। অশ্বত্থের পাতায় তিরতির করে বাতাস কাপছে। এক ঝাঁক পাখি ব্রহ্মপুত্রের বুক স্পর্শ করে উড়ে ওপারে ঘন গাছের বাঁকে হারিয়ে গেলো। আমরা সবাই সহসা নির্বাক হয়ে গেলাম। কি রকম অস্বস্তিকর মুহূর্ত একটা। একটু পরেই মাইকে মাগরিবের আজান শুরু হলো। এখানে এরকম অভিজ্ঞতা নতুন। সত্যি বলতে কি, সন্ধ্যার এই আজানটা আমার মাঝে মাঝে বড় মধুর লাগে! কেমন যেন এক বিষাদমাখা মধুর সুর ধ্বনি।… কিন্তু আজ এই আজানের ধ্বনি অনতিকালের অশনি সংকেত যেন…। ফণিভূষণ দূরে অশ্বত্থ গাছের গুড়িতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে ছিল। চাই বা না চাই, মানি আর না মানি, আমার গায়ে একটা ধর্মীয় পরিচয় সেঁটে আছে- কোনদিন এই পরিচয়কে নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু এখন ফণিভূষনের কাছে, জীবনদার কাছে… এমনকি ঐ নিরেট প্রাণহীন কালিমূর্তিটির কাছে… বড় অস্বস্তিতে ফেলে দিলো…।

Post a Comment

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................