জয় হল শিবাজির। মা ভবানীর আশীর্বাদ সত্যি হল।


Ayan Chakraborty র
পোস্ট থেকে ।

১৬৫৯ সাল, প্রতাপগড় দুগর্: রাত গভীর হয়েছে। নৈশরক্ষীরা ছাড়া আর সকলেই ঘুমে অচেতন। কেবল নিদ্রাহীন একজন। বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহের অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর সেনাপতি আফজল খানের কাছে কি শেষমেশ বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হবে? কিন্তু বশ্যতা স্বীকার মানে তো মৃত্যু। মৃত্যু ‘স্বরাজ্যস্থাপন’ স্বপ্নের। কত দিন ধরে এই স্বপ্ন দেখার শুরু। আমার দেশ, আমার মাতৃভূমিকেন তাকে বিকিয়ে দেব বহিরাগতদের হাতে। ছোটবেলায় মা জীজাবাঈয়ের কাছে রামায়ণ মহাভারতের গল্প, দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের গল্প, জাতীয়তাবাদের কথা শোনা কি মিথ্যা হয়ে গেল? 
এই সব নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিদ্রাহীন দুটি চোখের পাতা কখন এক হয়ে গিয়েছিল সবে ত্রিশের কোঠায় পা দেওয়া যুবক শিবাজির। অকস্মাত্‌ তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। এ কি সত্যি না স্বপ্ন? মা ভবানী কি সত্যিই এসেছিলেন তাঁর কাছে? যেন মনে হল, তিনি বলছেন, ‘ওরে ওঠ, আর ঘুমোস না। তুই জিতবি রে জিতবি! আফজল খানের কাছে তুই কিছুতেই হারবি না, কিছুতেই না!’
মনে বল পেলেন শিবাজি। দেখতে পেলেন আশার ক্ষীণ আলো। কিন্তু ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপ আফজল খানের বিরুদ্ধে কী ভাবে আসবে জয়? অনেক চিন্তা করে শিবাজি ঠিক করলেন তিনি মিলিত হবেন আফজল খানের সঙ্গে। আফজল খানও সম্মতি দিলেন ওই প্রস্তাবে। ঠিক হল দু’জনের সাক্ষাত্‌ হবে প্রতাপগড় দুর্গের কাছে এক স্থানে। প্রতাপগড় দুর্গ মহারাষ্ট্রের জঙ্গল-ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ে নিজ মহিমায় দণ্ডায়মান। সেই পাহাড়েরই নীচে নির্মিত হল একটি মণ্ডপ। সেখানেই সাক্ষাত্‌ হবে দু’জনের—শিবাজি এবং আফজল খান।

আফজল খানের সঙ্গে সাক্ষাত্‌—কিন্তু ক্রূর সর্পকে কি কেউ বিশ্বাস করে? সন্ধিপ্রস্তাবের ছল করে সেরার রাজা কস্তুরি রঙ্গাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল আফজল খান। দুরাত্মাকে কখনও বিশ্বাস করতে নেই।
তাই শিবাজি গায়ে ও মাথায় চড়ালেন লোহার বর্ম ও শিরস্ত্রাণ। তার ওপর আলখাল্লা ও মাথায় উষ্ণীষ। বাম হাতে পরলেন বাঘনখ লাগানো দস্তানা এবং ডান হাতের জামার হাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখলেন একটি ভোজালি। তাঁর লুটিয়ে-পড়া পুরো-হাতা সাদা আলখাল্লার নীচে সব চাপা পড়ে গেল। হ্যাঁ, এ বার তিনি প্রস্তুত!
প্রণাম করলেন জিজামাতাকে। মা পুত্রকে আশীর্বাদ করলেন, ‘তুমি জয়যুক্ত হও।’
শিবাজি এবং আফজল খান দু’জনের কেবল দু’জন করে দেহরক্ষী উপস্থিত থাকবে সাক্ষাত্‌স্থলে, এমনই কথা হয়েছিল। তারিখটি ছিল ১০ নভেম্বর, ১৬৫৯ সাল।
বিশালকায় দীর্ঘদেহী আফজল খান শিবাজির জন্য অপেক্ষায় রত। শিবাজি এক সময় প্রবেশ করলেন সুসজ্জিত তাঁবুতে। আপাতদৃষ্টিতে শিবাজিকে দেখে মনে হল, তিনি নিরস্ত্র—যেন কোনও বিদ্রোহী এখানে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে।
আফজলের পাশে রাখা ছিল তলোয়ার এবং ভোজালি। শিবাজি মঞ্চে উঠলেন, যেখানে আফজল খান উপবিষ্ট ছিলেন এবং মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলেন।
আফজল—চাতুর্যে যার জুড়ি মেলা ভার, ত্বড়িত্‌গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে শিবাজিকে আলিঙ্গন করলেন। বিরাট দেহ আফজলের কাঁধের কাছে আকৃতিতে ছোটখাটো মরাঠা বীর। এই অসম আকৃতির সুযোগে বাঁ হাতে আফজল শিবাজির গলা জড়িয়ে ধরলেন লৌহ কঠিন ফাঁসে। ডান হাতে তুলে নিলেন ধারালো চকচকে ছুরি এবং আঘাত করলেন শিবাজির দেহের এক পাশে। শিবাজির দেহে বর্ম থাকায় সেই ছুরিকাঘাত প্রতিহত হল। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকিত হলেও আঘাত সামলে নিতে অবশ্য শিবাজির দেরি হল না। বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় শিবাজি তাঁর বা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আফজলের কোমর এবং সঙ্গে সঙ্গে পরপর বাঘনখের আঘাতে চিরে ফেললেন আফজলের পেট। আফজল খান যন্ত্রণায়, ক্ষোভে চিত্‌কার করে উঠলেন, ‘বিশ্বাসঘাতক! খুন করে ফেলল আমায়! বাঁচাও বাঁচাও, কে আছ বাঁচাও!’
শিবাজি ততক্ষণে লাফ দিয়ে নেমে এসেছেন মঞ্চ থেকে। আফজলের বিশ্বস্ত সঙ্গী সৈয়দ বান্দা শিবাজির পথ আটকে দাঁড়াল। হাতে তার বিশাল ঝকঝকে খাপখোলা তলোয়ার। এক কোপ বসাল সে শিবাজির মাথায়। পাগড়ি দু’টুকরো হয়ে গেল তাঁর। কাহিনি এখানেই খতম হলে মরাঠা ইতিহাস আজ অন্য ভাবে লেখা হত। কিন্তু না, পাগড়ির নীচে লোহার শিরস্ত্রাণ এ বারেও রক্ষা করল তাঁকে। শিবজির বিশ্বস্ত দেহরক্ষী জীব মহলা ত্বড়িত্‌গতিতে কেটে ফেলল সৈয়দের ডান হাত এবং হত্যা করল তাকে, নিজের প্রভুকে বাঁচানোর জন্য।
এ দিকে দেখা যাক, আফজল খানের কী হল। বাঘনখের আঘাতে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে এসেছে। পালকিবাহকরা আফজলকে পালকিতে চাপিয়ে পালাতে যাওয়ার উপক্রম করছে—এমন সময় শিবাজির আরেক বিশ্বস্ত রক্ষী শম্ভুজি কাওজি পালকি থেকে নামিয়ে আফজল খানের শিরচ্ছেদ করলেন।

জয় হল শিবাজির। মা ভবানীর আশীর্বাদ সত্যি হল। স্বরাজ্য স্থাপনের পথে এক ধাপ এগোলেন তিনি এবং তা সম্পূর্ণ নিজের দুর্জয় সাহস আর প্রত্যুত্‌পন্নমতিত্বের জোরে৷

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted