বরিশালের মনীষা চক্রবর্তীকে নিয়ে ফেইসবুক সমাজে বেশ শোরগোল উঠেছে। ঘটনা হল, মনীষার দল বাসদ বরিশাল জেলা শাখার পক্ষ থেকে গরু কোরবানি করে বরিশালের প্রায় দেড় হাজার মানুষের মাঝে মাংস বিতরণ করেছেন।
সেই বিতরণ কার্যক্রমে তিনি আগাগোড়া উপস্থিত থেকে এই বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। তার এই ঘটনায় জনগণের মাঝে তিনটি ভাগ তৈরি হয়েছে। একভাগে আছেন দেশের হিন্দুধর্মাবলম্বী ফেইসবুকার, যারা মনীষা একজন ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে হয়েও গরুর মাংস বিতরণে সামিল হওয়ায় ভীষণ রকম ক্ষিপ্ত, আরেক ভাগে আছেন মুসলিম প্রগতিশীল অংশের ফেইসবুকার যারা এই কাজে মনীষার উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পেয়েছেন এবং তারা ভীষণ উল্লসিত, আর শেষ ভাগে আছেন আরেকদল মানুষ যারা নিজেরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং মনীষা হিন্দু হয়ে কেন কোরবানির কাজে অংশ নিয়ে কোরবানিকে বিতর্কিত করলেন সেই অপরাধে হিন্দুদের মতই ক্ষুব্ধ।
মনীষা অবশ্য তার ফেইসবুক আইডি থেকে বিবৃতি দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এবং সবাইকে সামপ্রদায়িকতা নয় মানবতার আলোকে উদ্ভাসিত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তবে আমি সেই আলোচনায় যাব না। আমি বরং একজন ভুলে যাওয়া মানুষের গল্প শোনাই। মনীষার মতই বরিশালে আরেকজন নেতা হঠাৎ করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তবে তিনি ছিলেন দলিত সমাজের মানুষ। মানে ভদ্রলোকেরা যাদেরকে ছোটলোক বলে ঘেন্না করেন সেই সমাজের মানুষ আর কি। নাম ছিল তার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, ওরফে যোগেন মন্ডল। একেবারে হতদরিদ্র, অচ্যুত ঘরে জন্ম নিয়েও তিনি জীবনের বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে শেষমেশ একজন আইনজীবী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এটা আরও একশ বছর আগের কথা, তখন বৃটিশদের শাসন চলছে। আইনজীবী হয়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে একের পর এক চমক দেখাতে শুরু করলেন। বরিশালের কিংবদন্তী অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলে সরল কুমার দত্তকে হারিয়ে এই অঞ্চলের প্রথম দলিত ব্যক্তি হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হোন। এরপর ধাপে ধাপে তিনি বাংলার প্রাদেশিক সরকারে সমবায় মন্ত্রী ও বিচার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে যখন দেশ ভাগাভাগি শুরু হয় তখন তিনি ভারতের পক্ষে না গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা শুরু করেন। ব্রাহ্মণ শাসিত হিন্দু সমাজ দ্বারা যুগ যুগ ধরে লাঞ্চিত হওয়ার কারণে তিনি হিন্দুদের দেশে থাকতে চাইলেন না। তিনি চাইলেন আরেক নিপীড়িত জনগোষ্ঠী মুসলমানদের সাথে জোট বেঁধে থাকতে। তার হিসাব ছিল সহজ, হিন্দু অভিজাতদের কাছে অস্পৃশ্য হিন্দুরা যেমন নিপীড়িত, গরীব মুসলমানরাও তেমনি নিপীড়িত। অতএব, দুই নিপীড়িত জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পরষ্পরের সহযোগী হতে হবে। গরীবের দুঃখ গরীব ছাড়া আর কে বুঝবে?
এই চিন্তা থেকে তিনি পূর্ব বাংলার সকল দলিত মানুষদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার আহবান জানালেন। ভারত পাকিস্তান প্রশ্নে সিলেট বিভাগে যখন গণভোট আয়োজন হয়েছিলো তখন যোগেন মন্ডল সর্বশক্তি দিয়ে সিলেটকে পাকিস্তানে রাখার কাজে নেমেছিলেন। এই অঞ্চলের দলিত নেতাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি সিলেটকে পাকিস্তানে রাখার পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তার এই পরিশ্রম বৃথা যায় নি। সিলেটের জনগণ ৫৬%-৪৩% ভোটে সিলেটকে পাকিস্তানে রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, যেখানে দলিত ভোটের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্ব বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও নিম্নবর্গের হিন্দুরা পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
তার এহেন তৎপরতায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ খুব খুশি হোন। তিনি যোগেন মন্ডলকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং পাকিস্তান আইনসভার প্রথম স্পীকারের পদে অধিষ্ঠিত করেন। যোগেন মন্ডলের জীবনের সেরা সময় ছিল সম্ভবত ঐ দিনগুলো। কিন্তু সুখের সময় বেশিদিন থাকলো না। পাকিস্তান গঠিত হওয়ার তিন বছরের মাথায় যখন পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপর ভয়ংকর হামলা শুরু হয়, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, দলিত নির্বিশেষে যখন লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট করা হয়, জ্বালিয়ে দেয়া হয়, ধর্মান্তরিত করা হয় তখন তিনি বুঝতে পারেন, তিনি কি ভুল করেছেন। কিন্তু তখন আর সেই ভুল শোধরাবার কোন সুযোগ ছিল না। তাই তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধাণমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে পদত্যাগপত্র পত্র পাঠিয়ে পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে সেই ব্রাহ্মণদের কাছে পাড়ি জমান।
তার ভারতের জীবনও খুব সুখকর ছিল না। ভারতে গিয়ে তিনি দলিত সমাজের উন্নতির জন্য আবার রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেখানে আর কেউ তাকে পাত্তা দেয় নি। না নিজের সমাজ, না অভিজাত সমাজ কেউই তাকে আর আপন করে নেয় নি। সেখানকার মানুষের কাছে তিনি বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই প্রতিপন্ন হয়েছেন এবং মাত্র ৬৪ বছর বয়সে একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
মনীষা চক্রবর্তী ও অসাম্প্রদায়িকতার নামে নিজের সার্থে নিজ ধর্ম ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যোগেন মন্ডলের পথেই হাটছেন।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................