জাপানে স্কুল কলেজের প্রথম দেশব্যাপী পরীক্ষা হয় টুয়েলভ গ্রেডের সময়। এটাকে সেন্টার পরীক্ষা বলে। পরীক্ষা হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, দুই দিনেই শেষ, শনি রবি দুই ছুটির দিনে। পুরা দেশব্যাপী একই সময়ে, একই প্রশ্নে। এত বড় পরীক্ষার জন্য, স্কুল কলেজে একটা দিনও ছুটি থাকেনা, দরকারও হয় না।
জাপানের কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই এবং প্রতি বছর শত শত ভূমিকম্প হয় তবু তারা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। হিরোশিমায় বোমা হামলার মাত্র ১০ বছরে হিরোশিমা তার আগের জায়গায় ফিরে আসে। এর কমাত্র কারণ জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা ইউরোপের আদলে গড়া।
স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কিভাবে বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয় তা দেখেছি ইউরোপের কিছু দেশ ঘুরে। কোমলমতি এই বাচ্চাদের ১৪-১৫ টা সাবজেক্ট নেই, ১ম/২য় হবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। এরা মজা করতে করতে গুনতে-লিখতে-পড়তে শিখছে। পাঠ্যক্রমের বাইরেও শিখছে বিভিন্ন সৃজনশীল বিষয়।
যেমন দলবেঁধে জঙ্গলে গিয়ে কুড়িয়ে আনছে গাছের রঙবেরঙ এর পাতা, ফুল আর ফল - চিনছে প্রকৃতিকে, জানছে ঋতু পরিবর্তন। জাদুঘরে গিয়ে পুরাতন জিনিসপত্র দেখে শিখছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। চিড়িয়াখানার সত্যিকারের গরু দেখে এসে বর্ণনা লিখছে। কাঠ কেটে বা পাথর ঘষে বানাচ্ছে বিভিন্ন জিনিস, করছে শিল্পচর্চা। মজার এক্সপেরিমেন্ট করে আলো জ্বালাচ্ছে, খেলনা-গাড়ি বানাচ্ছে, পাচ্ছে আবিষ্কারের আনন্দ, কৌশলে শিখছে বিজ্ঞান। নিউজ প্রেজেন্টেশন করা শিখছে, কাটছে মনের জড়তা, লজ্জা, ভয়। লাইব্রেরী থেকে পছন্দের বই নিয়ে তৈরি করছে বই পড়ার অভ্যাস। পালা করে নিজেরাই ঘণ্টা বাজিয়ে ক্লাস শুরু করে শিখছে ঘড়ি দেখা, শিখছে নিয়মানুবর্তিতা। বিভিন্ন খেলাধুলা ছাড়াও শিখছে গান, কবিতা-আবৃতি, গল্প বলা, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি, অভিনয়, হচ্ছে প্রতিভার বিকাশ। সেলাই শিখে, বিস্কিট-পিজ্জা বেক করে শিখছে আত্মনির্ভরশীল হতে। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট কন্টেইনারে ফেলে শিখছে পরিচ্ছন্নতা। ছাত্র-শিক্ষক মিলে দাবা খেলে করছে বুদ্ধির চর্চা, যোগ-ব্যায়ামে শিখছে ধৈর্যশীল হতে। বাগান করে শিখছে গাছ লাগানো ও পরিবেশ পরিচর্যার উপায়।
৫ম শ্রেণী থেকে বাচ্চারা আলাদা হতে থাকবে বিভিন্ন সেকেন্ডারি বা হাই স্কুলে। যার যে বিষয়ে আগ্রহ বেশি, সাধারণ সব বিষয়ের পাশাপাশি সে সেই ‘বিশেষ’ বিষয়ে নিবে কারিগরি প্রশিক্ষন। ভালো পিয়ানো যে বাজাতে পারে বা ভালো ফুটবল খেলতে পারে বা অসাধারণ ছবি আঁকাতে পারে, এমন একজনকে ধরেবেঁধে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ানো হবেনা। প্রতিটা বিষয়ের জন্য আলাদা কোচিং, গৃহশিক্ষক, নোটবই, গাইডবই এর বালাই নেই। নেই কোন বাবা, মা কর্তৃক বাড়তি চাপের বালাই।
ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে মাঠ-পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরি বিষয় ছাড়াও ছোটখাটো যে কোন বিষয়ে, চট করে কোন সমস্যার সমাধানে এরা কতটা পারদর্শী। বাগান করা, রান্না-বান্না, অফিস-আদালত, কল-কারখানায় এরা সুনিপুণভাবে দক্ষ। যেমন ছেলেরা, তেমন মেয়েরা।
জীবন ও বাস্তবমুখী শিক্ষাই একটা জাতির উন্নত হবার প্রথম ও প্রধান শর্ত, মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াবার একমাত্র হাতিয়ার। একটা বাচ্চা বড় হয়ে শুধু একটা ‘চাকরি’ করবে না, নিজের জীবনকে গড়বে, সমাজকে গড়বে, একটা জাতিকে নেতৃত্ব দিবে, তাই তাকে সবকিছুই শিখতে হবে হাতে-কলমে।
বলার অপেক্ষা রাখে না ইউরোপিয়ানদের এই বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাই দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের পরও তাদের অর্থনীতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
লিখেছেন ঃ
Razik Hasan
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................