আর কত সত্য লুকোনো হবে ?

আর কত সত্য লুকোনো হবে ?
-------------------------------------------
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক,ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক কালিমালিপ্ত ঘটনাগুলো শাসক শ্রেণী ছলে,বলে, কৌশলে আম জনতার কাছ থেকে লুকিয়ে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে । প্রয়োজনে সংবাদপত্র ও আরো নানা মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করেছে হুমকি, ধামকি দিয়ে । কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচারের মাধ্যমগুলোও রহস্যজনকভাবে শাসকশ্রেণীর পোষা কুকুরের মত আচরণ করে, বিভিন্ন ঘটনাগুলো চেপে গেছে । ১৯৪৬ এর নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া একতরফা সংখ্যালঘু হিন্দু নিধনযজ্ঞের ঘটনাতেও সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকা ছিল যথেষ্ট রহস্যজনক । নোয়াখালীতে সংখ্যালঘু হিন্দু নিধনযজ্ঞ শুরু হয় ১০ই অক্টোবর, ১৯৪৬ এ অথচ, সংবাদপত্রে প্রথম খবর আসে ১৫ই অক্টোবর, ১৯৪৬ । খবরের প্রকাশও ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত । স্টেসম্যান কাগজটি প্রথম খবর প্রকাশ করে । সরকারের এই খবর black out করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অমৃতবাজার পত্রিকা লেখে :
"নোয়াখালী থেকে রক্ত হিম করা খবর আমাদের দপ্তরে এসে পৌঁচেছে । সরকারি ও বেসরকারি উভয়ের বক্তব্য থেকেই এটা পরিষ্কার যে,এই দাঙ্গা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত । পরিকল্পনা অনুসারেই গত বৃহস্পতিবার থেকে খুন ও লুঠ শুরু হয়েছে । কিন্তু এটা ভাবতে অবাক লাগছে যে, এই ধরণের এক অভূতপূর্ব দাঙ্গার খবর প্রথম প্রকাশিত হলো পনেরোই অক্টোবর, অর্থাৎ দাঙ্গা শুরু হওয়ার পাঁচদিন পরে । দুঃখজনকভাবে, অথবা বলা যেতে পারে রহস্যজনকভাবে, বাংলা সরকারের 'Director Of Publicity' দ্বারা প্রকাশিত 'press note' এত সংক্ষিপ্ত (Laconic) ছিল যে এর থেকে কোনোভাবেই দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভব নয় । কিন্তু এই দীর্ঘ পাঁচদিন এভাবে স্বাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখবার কৈফিয়ৎ কে দেবে ? আর যাই হোক নোয়াখালী নিশ্চই পেশোয়ার বা কোয়েট্টা নয় । কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ । তবে কি রাজ্য সরকার জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এই কদিন কোনো সংবাদ পায়নি । এবং যদি পেয়ে থাকে তবে রাজ্য সরকার এই কদিন কি করেছে ?" {Amrita Bazar Patrika-১৭-১০-৪৬} ।

পাঠক এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে হবে, সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের নোয়াখালীতে একতরফা হিন্দু নিধন ঘটানোর মূল উদ্দেশ্য খুন বা লুঠ ছিল না । তাই যদি হতো তবে, হামলাকারীদের সাথে মোল্লা, মৌলবীর দলও গ্রামগুলোতে গিয়ে হিন্দুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পরতো না ! আসলে এই সর্বাত্মক সংখ্যালঘু হিন্দু নিধন ছিল ভবিষ্যতের পাকিস্তানের রূপরেখার প্রতিবিম্ব । নোয়াখালীর সকল সংখ্যালঘু হিন্দুকে ইসলামে ধর্মান্তকরিত করে দার-উল-ইসলাম কায়েমের সর্বাত্মক প্রয়াস ! তাই মুসলিম লীগের নেতাদের সেদিন প্রয়োজন পরেছিল বল্গাহীন সন্ত্রাসের । নোয়াখালীতে দার-উল-ইসলাম কায়েমের জন্য সেদিন একদিকে চললো খুন, লুঠ আর বল্গাহীন সন্ত্রাস আর অপরদিকে, বারো থেকে বিয়াল্লিশ নির্বিশেষে হিন্দু নারী ধর্ষণ । যে কজন ভাগ্যবতী পালাতে পেরেছিলো ওই সময়ে, তাদের শূন্য দৃষ্টিতে ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুর বিভীষিকা ! 'হয় কোরান, নয় মৃত্যু' -এই নীতি অবলম্বন করে নোয়াখালীর সংখ্যালঘু হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হলো । সংখ্যালঘু হিন্দুদের গরু জবাই করতে বাধ্য করা হলো । নাহ, ঘাবড়াবেন না ! এটা হলো বাঙালি মুসলমানের ইসলামের প্রাথমিক পাঠ । গোমাংস ভক্ষণে ইসলামিয়ানা জাহির করতে হয় তাদের । তাই সংখ্যালঘু হিন্দুদের সন্ত্রাসের মাধ্যমে কেবল গরু জবাই করিয়েই তারা সেদিন ক্ষান্ত হয়নি, খাঁটি মুসলমান বানাতে তাদের সেই গোমাংস বলপূর্বক ভক্ষণ করতে বাধ্য করেছিল নোয়াখালীর বাঙালি মুসলমান । আরে বাবাঃ শতকরা ১০০ % মুসলমানি করতে হবে তো ! এত সব ঘটনা নাহয় সেদিনের নোয়াখালীর বাঙালি মুসলমান ঘটাচ্ছিলো, কিন্তু সেসময়ে প্রশাসন ও তার পুলিশ নোয়াখালীর সংখ্যালঘু হিন্দুদের রক্ষা করতে কি ব্যবস্থা নিয়েছিল ? উত্তর হলো-নোয়াখালীর জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ওই বর্বরতা বন্ধ করতে সেদিন কোনো উদ্যোগ নেয়নি ! কি বিশ্বাস হচ্ছেনা ? না বিশ্বাস করার কি হলো ? পাঠক ওই জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টও বাঙালি মুসলমান, এটা ভুলে চলবে ? নোয়াখালীর জেলার পুলিশ প্রধান নিজেই মুসলিম লীগের সহযোগী হয়ে দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছিলেন । নিজেরাই দেখুন Statesman পত্রিকা কি লিখেছিল: " The District Magistrate and the Police Superintendent of Noakhali took no step to prevent it ."

আজকে যখন ফেসবুকে দেখি এখনের বাংলাদেশে রসরাজকে ভুঁয়া ছলে ফাঁসিয়ে ধারার প্যাঁচকলে আটক করা হয়েছে বা সংখ্যালঘু হিন্দুর দেবোত্তর সম্পত্তি, জমিয়ে হাতিয়ে কোনো শাসকদলের নেতা সুপার মার্কেট করার পায়তাঁরা করছে, আমি রেগে যাই, দুকলম লিখি বটে, কিন্তু একদম অবাক হইনা । আরে এটাই তো বাঙালি মুসলমানের সেই ১৯৪৬ এর নোয়াখালী থেকে বহন করে আসা ঐতিহ্য ! প্রকারটা পাল্টে গেছে, মূলটা একই রয়ে গেছে । তাই অবাক হওয়ার কি আছে এই ঘটনাগুলোতে?

রেফ: Amrita Bazar Patrika 23-10-46
The Statesman 16-10-46
Bell Papers, C.S.A.S.Cambridge

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted