লোকটার নাম মহসিন তালুকদার। সবাই লোকটাকে জঙ্গি জঙ্গি বলছে। অথচ সনু নিগম যখন আজানকে শব্দ দূষণ বলেছিলো তখন মহসিন তালুকদার আর আপনারা একই দলে ছিলেন। সনু নিগমকে যখন মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ফেতোয়া দিয়েছিলো ভারতের একজন মুফতি তখন সেই মুফতিকে আপনারা না বলেছেন জঙ্গি না মহসিন তালুকদার তাকে বলেছিলো জঙ্গি। আজকে একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটারকে হুমকি দেয়ায় সে জঙ্গি হয়ে গেলো! অথচ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান আর আপনারা তো একই দলের লোক। ব্রিটিশ একটা গবেষণা যখন বলেছিলো দাড়িতে জীবাণু থাকে তখন সাকিব নকল দাড়ি লাগিয়ে ছবি পোস্ট করে সেই গবেষণার প্রতিবাদ করেছিলো, তখন শুধু মসহিন তালুকদারই কি খুশি হয়েছিলো, আপনারা হন নাই? আজ তাহলে কেন মহসিন তালুকদারের জাত ভিন্ন হয়ে গেলো?
আপনাদের একজন কিংবদন্তি ক্যাপ্টেন হালাল বডিস্পে’র এড করে না? উনি নাকি হালাল জিনিসের সঙ্গে কম্প্রমাইজ করেন না! এরকম বিজ্ঞাপন পৃথিবীর যে কোন সভ্যদেশে ভীষণ রকম বর্ণবাদী ঘৃণাবাদী বলে প্রচারই করতে পারবে না। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি তার দেশে ‘হালাল দোকান’ সম্পর্কে বলেছেন, এগুলো তো স্পষ্টতর বিভাজনের উপাদান! একজন মহসিন তালুকদার এরকম হালাল হারাম নিয়ে কঠিন নো-কম্প্রমাইজ থেকেই তো উৎপন্ন হয়।
ভারতের মন্দিরে গত বছর দুর্গা পুজায় সম্প্রীতির অনন্য নজির হিসেবে আজান প্রচার করেছিলো। ‘আল্লা ছাড়া কোন মাবুত (ঈশ্বর) নাই’ বলে আজান যে সম্প্রীতির বার্তা দেয় সেটা হিন্দু লিবারালরা না বুঝুক কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো না। সেরকম উদ্দেশ্য থেকেই সাকিবকে কোলকাতায় নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলো কালি পুজাতে। কিন্তু জুতার বাড়ি যা খাওয়ার সেটা কোলকাতার লোকজনই খেয়েছে। সাকিব পুজার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়াটাকে এখন নিজেই বলছে অন্যায়, গর্বিত মুসলমান হিসেবে তিনি পুজা উদ্ধোধন করতেই পারেন না ইত্যাদি…।
বন্যার কারণে মন্দিরে ঈদের নামাজ, বৌদ্ধ মঠে ইফতার, গির্জাতে জুম্মার নামাজ পড়ার সুযোগ যদি সম্প্রীতির নিদর্শন হয় তাহলে মসজিদে পুজার অনুষ্ঠান করে সম্প্রীতির বার্তা ফিরতি পাঠানোটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? ফেইসবুকে আবদুর নুন তুষার সাকিব আল হাসান ক্ষমা চাওয়ায় যারা সমালোচনা করছেন তাদের সমালোচনা করেছেন। উনি বলছেন, এই সমাজ সাকিব তৈরি করেনি, কাজেই নষ্ট সমাজে নিজের নিরাপত্তার ভয়ে সাকিব ক্ষমা চাইতেই পারে। ফালতু যুক্তি। এই সমাজ তৈরিতে সাকিব অবশ্যই দায়ী। তুষারদের মত সেলিব্রেটি সবাই দায়ী। বিদেশে গিয়ে হালাল খাবারের অভাবে অভুক্ত থাকায় বিতর্ক প্রতিযোগীতায় ফাস্ট হতে না পারার গল্প তিনিই বলেছিলেন। এরকম রক্ষণশীলতা থেকেই তো মহসিন তালুকদাররা জন্ম নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের তমদ্দুনিক সংস্কৃতি ধর্মকে সমুন্নত রাখার জন্য আবুল ফজল থেকে আহমদ ছফা সবাই তাই মহসিন তালুকদারদের জন্য দায়ী। কারণ তারাই ‘মুসলমান’ এরকম সাতন্ত্র্য একটা চেতনা লেখাপড়া জানা মানুষজনের মধ্যে প্রথিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সেদিন বাংলা একাডেমি পুরুস্কার পাওয়া এক লেখক লিখল, পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকের পাট বেচা টাকায় হিন্দুদের রাম সীতার কাহিনী স্কুলে কেন মুসলমানরা পড়তে বাধ্য হবে- এসব কারণেই মুসলমানরা দেশভাগ চেয়েছিলো। একবার বলুন তো, মহদিন তালুকদার অশিক্ষিত অমার্জিত বলে সাকিব আল হাসান একটা পুজার অনুষ্ঠানে যাওয়ায় যে মারমুখি হয়েছিলো তার থেকে আমাদের এই একাডেমি পুরুস্কার প্রাপ্ত লেখক ঠিক কতখানি দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন?
মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর ফেইসবুক পোস্টের কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেই। এই লোক শাহবাগের প্রগতিশীলদের এক হাত নিয়েছিলো বছর কয়েক আগে এই বলে, “…শাহবাগের আড্ডা, টিএসসি, আজিজ মার্কেট- এই রাস্তা-ঘাট ইট-পাথর সবই ছিল আমার শ্রেণী-শিক্ষক। শাহবাগের কাছে আমার তাই আজন্মের ঋণ। তো সেখানে গিয়েই আবিষ্কার করলাম সংস্কৃতিকর্মীরা পুজোয় যাবে, বড়দিনে যাবে, পুজো নিয়ে গল্প করবে, ভাই-ফোঁটা দিবে, কিন্তু শবেবরাতে তাদের কোনো কর্মসূচি থাকবে না। তারা ঈদের জামাত নিয়ে বেশি বাক্যব্যয় করবে না। আমার কেন যেন মনে হতো ইসলামী আচার বা সংস্কৃতি নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না করাটাই প্রগতিশীল প্রমাণ করার উপায়”।
কি এটা কি মহসিন তালুকদারের ভদ্র মার্জিত বড় ভাইয়ের মত কথা হলো না? ঈদের নামাজে কি করে সবাই মিলে উৎসব হবে? শবে বরাতের রাতে কে কোথায় আড্ডা দিয়েছে? আসল জ্বলুনি হচ্ছে পুজা বড়দিন ভাই ফোঁটায়। এই যে তুষার বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে নাস্তিকদের ধরে ধরে যখন খুন করা হয়েছিলো তখন কি সে এরকম হায় আফসোস করেছিলো সমাজটা নষ্ট হয়ে গেছে? এখন যারা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত, দেশটা মোল্লাতন্ত্রে চলে গেছে বলে ব্যথিত তারা কেউ নাস্তিক কোতলের সময় দেশ নিয়ে এরকম হতাশ হননি। যখন বাউলদের ধরে ধরে জেলে ভরা হচ্ছিল, লালন চর্চাকারীদের হত্যা করছিলো, যখন রামু নাসিরনগর ঘটেছিলো তখনো কেউ দেশ নিয়ে হতাশ ছিলো না। উল্টো এসবের পিছনে র’ বিজেপি আরএসএসের হাত আবিস্কার করেছিলো। কিংবা ভারতে এরচেয়ে বেশি মুসলমান নির্যাতন হয় বলে দায় সেরেছিলো। কিন্তু লালমনিরহাটে একজন মুমিনবান্দাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর এইসব ননপ্যাক্টিসিলি মুমিনরা ভীত হতে শুরু করে। শেষে সাকিবের মত গণভবন কানেকশন সম্বলিত সেলিব্রেটিকে হত্যার হুমকি দেয়ার পর সবাই দেশে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মহসিন তালুকদারদের প্রথম প্রজন্ম তৈরি হয়েছিলো হাতমে বিড়ি মুখমে পান নিয়ে। সে মাটি ফুড়ে বের হয়নি। যার যখন পালা আসছে সে তখন এই দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে সংকিত হচ্ছে। এই দেশে হিন্দুরা প্রথম নিজেদের বিপন্ন মনে করেছিলো। তারপর নাস্তিকরা। বাংলাদেশকে তারাই বহু আগে চিনে ফেলেছিলো। এখন এইসব মডারেটদের বোধদয় হচ্ছে। তাদের তমুদ্দিন, হালাল হারাম মুসলমান ছুৎমার্গ থেকে জন্ম নেয়া মহসিন তালুকদার তাদেরকেও ছাড়বে না এটা তারা বুঝে গেছে।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................