Courtesy Tipu Chowdhury
শ্রীহট্টে সুরমা নদীর তীরে সুরম্য আসাম প্যাটার্নের বাংলো টাইপের টিনশেড্ 'রতনমণি লোকনাথ টাউন হল' প্রতিষ্ঠা করেন শহরের নয়াসড়ক খাজাঞ্চীবাড়ীর প্রজাহিতৈষী জামাতা জমিদার নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী । ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন শ্রীহট্টের প্রলয়ঙ্কারী 'ডাউকি ফল্ট' ভূমিকম্পে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় ।
পূর্বপুরুষ 'রতনমণি শর্ম্মা' ও 'লোকনাথ শর্ম্মা'র স্মৃতি রক্ষার্থে, শ্রীহট্টের নয়াসড়ক খাজাঞ্চী পরিবারের জমিদার শ্রী বৈকুন্ঠনাথ শর্ম্মা ও তার স্ত্রী শ্রীমতী বিনোদিনী শর্ম্মার নির্দেশে তাদের একমাত্র জামাতা নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী ১৯০০ সালে নির্মাণ করেন 'রতনমণি লোকনাথ টাউন হল'। হলটির সামনে ছিলো সুরম্য ফুলবাগান ।
পূর্বপুরুষ 'রতনমণি শর্ম্মা' ও 'লোকনাথ শর্ম্মা'র স্মৃতি রক্ষার্থে, শ্রীহট্টের নয়াসড়ক খাজাঞ্চী পরিবারের জমিদার শ্রী বৈকুন্ঠনাথ শর্ম্মা ও তার স্ত্রী শ্রীমতী বিনোদিনী শর্ম্মার নির্দেশে তাদের একমাত্র জামাতা নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী ১৯০০ সালে নির্মাণ করেন 'রতনমণি লোকনাথ টাউন হল'। হলটির সামনে ছিলো সুরম্য ফুলবাগান ।
অনেকেই হয়তো জানেন, শ্রীহট্টের শিক্ষা বিস্তারে এক আলোকবর্তিকা খ্রিস্টান ধর্মযাজক রেভারেন্ড প্রাইস । পাদ্রী প্রাইস সাহেব শ্রীহট্টে শিক্ষা বিস্তারের হাল না ধরলে, শ্রীহট্টের অবস্থা আজ কোন পর্যায়ে যেতো তা না বলাই সমীচীন । ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে 'নবাব তালাব' অর্থাৎ বর্তমান লালদীঘির পাড়ে শ্রীহট্টের জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য রেভারেন্ড প্রাইজ গড়ে তুলেন এক পাঠাগার, শ্রীহট্টে এটাই ছিলো প্রথম গণপাঠাগার । ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন 'ডাউকি ফল্ট' ভূমিকম্পে সবকিছু বিধ্বস্ত হলে প্রাইজ সাহেবের পাঠাগারটি ১৯০০ সালে নির্মাণ সমাপ্তির মুহুর্তেই রতনমণি লোকনাথ টাউন হল'এ স্থানান্তরিত হয় ।
এখানে শ্রীহট্টের কিছু আইনজীবীদের সমন্বয়ে সপ্তাহে দু'দিন আইন বিষয়ে পাঠদান হতো । যার নামে শ্রীহট্টের মদনমোহন কলেজ, সেই মদনমোহন দাস এখানে কিছুদিন আইনের পাঠ নিয়েছিলেন । যদিও মদনমোহন দাস ছিলেন শ্রীহট্ট জিলা কালেক্টরেট'এ রাজস্ব শাখার একজন কর্মচারী । অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে শ্রীহট্টের লামাবাজারের মদনমোহন কলেজ তিন বছরের জন্য স্থানান্তরিত হয়েছিলো এই ভবনে ।
১৯০৫ সালে ১৬ই সেপ্টেম্বর এই হল'এ শ্রীহট্টের প্রথম স্বদেশী আন্দোলনের সভা অনুষ্ঠিত হয় ।
১৯১৯ সালের ৫ই নভেম্বর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীহট্ট পরিভ্রমণকালে ৬ই নভেম্বর এই রতনমণি লোকনাথ টাউন হলেই গুরুদেবকে নাগরিক সংবর্ধনা জানানো হয় । সভাস্থলের আশেপাশে পাঁচ হাজারেরও বেশী লোকের জনসমাগম হয়েছিল । সভার প্রারম্ভেই স্থানীয় সংগীতশিল্পী যতীন্দ্রমোহন দেব চৌধুরী, আইনকৌশলী অম্বিকাচরণ রচিত একটি কবি-প্রশস্তিমূলক গান গেয়ে শোনান, অতপরঃ শ্রীহট্টের বিখ্যাত বেহালাবাদক যামিনীকান্ত রায় দস্তিদার বেহালা বাজিয়ে কবির চিত্তবিনোদন করেন । কুলাউড়া ভাটেরা নিবাসী উমেশচন্দ্র দেব এর স্বরচিত রবীন্দ্রস্তুতি প্রশংসা কুড়িয়েছিল । সভায় কবিগুরুর আগমনে শ্রীহট্টবাসী কতটুকু আনন্দিত হয়েছে তা জানিয়ে উর্দুতে দশ মিনিট স্বাগত বক্তব্য দেন আসামের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী খানবাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ সি.আই.ই. (কাপ্তান মিয়া)। আইনকৌশলী সৈয়দ আবদুল মজিদ যদিও খুব ভালো ইংরেজি ও উর্দু জানতেন তথাপি বিশুদ্ধ বাংলাতে ভাষণ দিতে পটু ছিলেন না, তাই তিনি উর্দুতে ভাষণ দেন । অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন নগেন্দ্রচন্দ্র দত্ত । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিনন্দনের প্রতিউত্তরে বক্তৃতা প্রদান করেন যা পরবর্তীতে ১৩২৬ বঙ্গাব্দ 'প্রবাসী' পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় 'বাঙালির সাধনা' শিরোনামে প্রকাশিত হয় । গুরুদেব বলেছিলেন, 'আমি এটা অনুভব করি যে, ভারতে বাঙালির একটি বিশেষ সাধনা আছে । নব্য বঙ্গের আরম্ভকাল থেকেই তার একটি অপরূপ নব্যতা দেখা দিয়েছে । এই নুতন বাঙলার সকল মহাপুরুষই নুতনকে অভ্যর্থনা করে নিতে ভয় পান নি । এই নুতন আশার, এই নুতন প্রাণের প্রবল সঞ্চার এদেশের সাহিত্য, সমাজ, শিক্ষা-দীক্ষায় প্রবেশ করেছে'।
১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে এই হল'এ সুরমা উপত্যকার রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে অসহযোগ প্রস্তাব গৃহীত হলে মৌলানা আব্দুল করিমের সভাপতিত্বে বিপিনচন্দ্র পাল, মৌলানা আকরাম খাঁ ও সুন্দরীমোহন দাসের উপস্থিতিতে সরকারি স্কুল কলেজের নাম দেয়া হয় 'গোলামখানা' । দলে দলে ছাত্ররা ব্রিটিশের স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে । ১৯২৭ সালে রতনমণি লোকনাথ টাউন হল'এ অনুষ্ঠিত 'সুরমা উপত্যকা ছাত্র ফেডারেশন সম্মিলনী’তে যোগদান করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও শের এ বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক । ১৯২৮ সালে এখানে সুরমা উপত্যকা রাজনৈতিক যুব সম্মেলন হয়, উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল, ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাস, আসাম কংগ্রেস নেতা বসন্তকুমার দাস প্রমুখ ।
শ্রীহট্টে ঘরোয়া সভার এটাই ছিলো একমাত্র উল্যেখযোগ্য স্থান । কিছুকাল পরে এই ভবনটির উত্তরপাশে ১৯৩৬ সালের ২০শে জানুয়ারী 'ইন্দেশ্বর টি এন্ড ট্রেডিং কোম্পানী' তাদের অন্যতম পরিচালক সারদাচরণ শ্যাম'এর স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করে 'সারদা মেমোরিয়াল হল' । উল্লেখ্য যে, এবছরই যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল 'কীন্ ব্রিজ'।
পরবর্তীতে এই টাউন হলের নিয়ন্ত্রণ সিলেট পৌরসভার অধীনে চলে যায়, পৌর কর্তৃপক্ষ এখানে একটি গণপাঠাগার স্থাপন করেন । পাঠক সমাবেশে 'পৌর পাঠাগার' নামে এর দিনগুলো চলছিলো বেশ । বর্তমানে ডিজিটাল উন্নয়নের যাঁতাকলে এই টিনশেড্ ভবনের স্থানে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন । পাশের সারদা স্মৃতি ভবনে সড়িয়ে পৌর পাঠাগারের নাম দেয়া হয়েছে 'পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার' । ছিলো লোকনাথ রতনমণি টাউন হল, এখন সেটি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পরিবহন পুল, ও স্যুয়ারেজ সেকশন হিসেবে ব্যবহৃত ।
কালের অতলগর্ভে হারিয়ে গেলো নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী'র শতবর্ষপ্রাচীণ রতনমণি লোকনাথ টাউন হল । কিন্তু প্রশ্ন হলো, রতনমণি, লোকনাথ, বৈকুন্ঠনাথ, বিনোদিনী, নগেন্দ্রনাথ, রেভারেন্ড প্রাইস এতগুলো নাম থাকতে পীর হাবিবের নামটি কিভাবে চলে আসলো ! এটা চিরন্তন যে, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধে পীর হাবিবুর রহমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য । কিন্তু সেটার কৃতজ্ঞতা তো অন্য কোথাও প্রকাশ করা যেতে পারতো । সরকারী অর্থব্যয়ে সিলেটে নির্মিত অনেক স্থাপনার নামইতো ভূতপূর্ব দু'জন অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ও আবুল মাল আবদুল মুহিতের নামানুসারে করা হয়েছে । এসব নামকরণের কোনটিতে কি পীর হাবিবের নামকরণ করা যেতো না ? বিষয়টি কিন্তু একদিনে হয়নি, তথাপি সিলেটের লোকেরা সবকিছু মেনে নিয়েছে, সেটা লোকনাথ, রতনমণির জাতিগত পরিচয় কি'না কে জানে ? এই শতকের প্রথম দশকে শাবিপ্রবি'র হল ও ভবনের নামকরণ নিয়ে প্রচন্ড আন্দোলন হয়েছিলো, সিলেটবাসীর আন্দোলনের মুখে সরকার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল । কিন্তু লোকনাথ-রতনমণির ব্যাপারে কেউ কোন টু শব্দটি বের করলো না । এভাবেই কী বিলুপ্ত হয়ে যাবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল শেষ ইতিহাস ও স্মৃতিটুকু ?
শ্রীভুমি শ্রীহট্ট থেকে।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................