প্রতাপাদিত্য – ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক
সপ্তডিঙা
✍কৌশিক মিত্র
সপ্তডিঙা ইতুপুজো /অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি সংখ্যা ১৪২৫
* Shoptodina Vol 4 No 5 2018 *
ISSN 2395 6054
নীরদচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে একাধিকবার বলেছেন যে বাঙালী আত্মঘাতী। বাস্তবিক এতদূর না গেলেও “আত্মবিস্মৃত” আখ্যা বাঙালী পেতেই পারে। চিতোরের রাণা মহারাজ প্রতাপ এর স্বাধীনতাস্পৃহা, মুঘল সম্রাট আকবররের বিরুদ্ধে তাঁর মরণপণ সংগ্রাম আমাদের কাছে শ্রদ্ধা, শ্লাঘা ও আলোচনার বস্তু। কিন্তু প্রায় একই সময়ে এই বাংলাতেও যে আর একজন প্রতাপ যে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, সারা ভারত জুড়ে অখন্ড হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন সে কথা আমরা ভুলতে বসেছি। তিনি প্রতাপাদিত্য। বার ভুইঞার একজন। অবশ্য উপাদনের অভাবও প্রতাপচর্চার পক্ষে অন্তরায়। বিশেষত প্রতাপ যে যশোর পরগণার অধিপতি ছিলেন সেই যশোরও দেশভাগের সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়, বর্তমানে তা বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং গবেষণা সেভাবে না হওয়ায় বাঙালী জাতির ইতিহাসচর্চার মধ্যে রাজা প্রতাপ ভিনদেশী তারা হয়েই থেকে যান। মুঘল আমলে এই বাংলায় বারোজন প্রতাপশালী জমিদার মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনতাকে অস্বীকার করে নিজস্ব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুঘলের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হন। এমন নয় যে এই বারোজন একই সময়ে অবস্থান করেছেন বা মুঘলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। অথবা তারা যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তা স্থায়ী হয়েছে। মুঘলের প্রচণ্ড পরাক্রম, বিশাল সৈন্যবল কিম্বা স্থানীয় লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সেই সব গৌরবময় প্রয়াসগুলি ব্যর্থ হয়ে গেলেও, তাঁরাও কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসে সমান মর্যাদা পাওয়ার দাবী রাখেন। বিভিন্ন উপাদান থেকে বারো ভুইঞার নামের যে তালিকা পাওয়া যায় তা অনেকটা এইরকম– ১) যশোহর–প্রতাপাদিত্য ২) খিজিরপুর/খিজিপুর–ঈশা খাঁ মসনদ আলি ৩) শ্রীপুর (বিক্রমপুর)-চাঁদ রায় ও কেদার রায় ৪) ভূষণা–মুকুন্দরাম রায় ৫) বাকলা/চন্দ্রদ্বীপ–কন্দর্প রায় ও রামচন্দ্র রায় ৬) ভুলুয়া–লক্ষ্যণমাণিক্য ৭) ভাওয়াল–ফাজেল গাজী, চাঁদ গাজী ৮) বিষ্ণুপুর–হামীর মল্ল ৯) তাহিরপুর–কংসনারায়ণ ১০) সাতৈল– রামকৃষ্ণ ১১) পুটিয়া–পীতাম্বর ও নীলাম্বর ১২) উড়িষ্যা ও হিজলী–ইশা খাঁ লোহানী ও ওসমান খাঁ। উপরোক্ত বারোজনের মধ্যে যশোহর রাজ প্রতাপাদিত্য ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী, শুধুমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া নয়, সেই ষোড়শ শতকেই তার নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত ভালভাবে লক্ষ্য করলে শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করে নিতে হয় – প্রথমত দুর্ধর্ষ পোর্তুগীজ জলদস্যুদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে তাদের সাহায্যে একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলা যা প্রাক ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় ইতিহাসে বিশেষ চোখে পড়েনা, সমসাময়িক পার্শ্ববর্তী মুঘল বিদ্বেষী এবং স্বাধীনতাপ্রেমী রাজাদের সঙ্গে অত্যন্ত মধুর এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, সব রকম সম্প্রদায়ের সহায়তায় একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসন গড়ে তোলা, এবং একটি স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্রের স্থাপনার স্বপ্ন দেখা। যে স্বপ্ন মেবারের রাণা প্রতাপ বা মহারাষ্ট্র জীবনপ্রদীপ শিবাজীও দেখেছিলেন। এ দুজনের সঙ্গে যশোহর রাজের পার্থক্য এই যে এরা প্রথম জীবনে বহুবার ব্যর্থ হলেও শেষ পর্যন্ত প্রথম জন আংশিক সফল হন এবং দ্বিতীয় জন ও সফলতা পান কিন্তু যশোহর রাজ প্রতাপ প্রথম থেকে মুঘলের বিরুদ্ধে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। কারণ প্রথম দুজনের সঙ্গে কোন বিশ্বাসঘাতক স্বজাতিদ্রোহী ছিল না, কিন্তু প্রতাপকে এই জায়গাতেই ইতিহাসের কাছে মাথা নত করে নিতে হয়। যারা বিশ্বাসঘাতকতার তুলনা দিতে কথায় কথায় মীরজাফরকে টেনে আনেন তারা ছোটবেলায় শোনা ‘চামে কাটা মজুমদার” কথাটি প্রায়ই ভুলে যান। মীরজাফর নন, বাংলার প্রথম রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকের নাম ভবানন্দ মজুমদার—‘চামে কাটা মজুমদার”। এ প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। তার আগে প্রতাপের পূর্বপুরুষদের নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেওয়া দরকার।
চলবে.....
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................