দ্বিতীয় পর্ব
.....
মহারাজ আদিশূর বঙ্গদেশে বৈদিক ক্রিয়াকলাপ চালুর জন্য কানাকুব্জ থেকে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন তার মধ্যে দার্শনিক ও মহাকবি শ্রী হর্ষ অন্যতম। এনার গৃহভৃত্য হিসেবে আসেন বিরাট গুহ যিনি পূর্ববঙ্গের বাকলায় বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয় ইনিই বঙ্গীয় গুহদের প্রথম পুরুষ এবং যশোহর রাজ প্রতাপাদিত্যের পূর্বপুরুষ। বিরাটের অধঃস্তন একাদশ পুরুষ রামচন্দ্র গুহ গৌড়ে এসে উপস্থিত হন।
তখন বাংলায় সুলেমান করবানীর শাসন। শেরশাহের মৃত্যুর পর গৌড়েও তখন টলমল অবস্থা। কর্মকুশলী রামচন্দ্র শীঘ্রই সুলেমান এর চোখে পড়েন এবং একের পর এক পদোন্নতি ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীর পদ পেয়ে যান। এসময় তিনি তাঁর তিন পুত্র ভবানন্দ, শিবানন্দ এবং গুণানন্দকে গৌড়ে নিয়ে আসেন এবং তিন জনকেই রাজসরকারে নিযুক্ত করেন। যথাসময়ে ভবানন্দের শ্রীহরি নামে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয় যিনি ভবিষ্যতে বিক্রমাদিত্য নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। অল্প কিছুদিন পরে শিবানন্দেরও একটি পুত্রসন্তান জন্মায় যার নাম রাখা হয় জানকী বল্লভ, ইনিই পরে বসন্ত রায় নামে পরিচিত হন। এই দুই ভাই ছোটবেলা থেকেই ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা, ঘোড়ায় চড়া, বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়গুলিতে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকেন এবং অচিরেই সুলেমান পুত্র রাজকুমার দাউদের অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে ওঠেন। সুলেমান করবানির মৃত্যুর পর ১৫৭৬ সনে দাউদ করবানি গৌড়ের সিংহাসনে বসেন এবং প্রিয় বন্ধু শ্রীহরি ও জানকীবল্লভকে মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেন।
এসময়েও ভবানন্দ দাউদের অন্যতম পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছিলেন। দাউদ ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন প্রজাবৎসল এবং জনহিতৈষী শাসক। কিন্তু প্রজাদরদী, উঁচুদরের প্রশাসক দাউদ ছিলেন প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অচিরেই দাউদ মুঘল অধীনতা ছিন্ন করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সেই মর্মে সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। দূরদর্শী ভবানন্দ অশনিসংকেত দেখতে পেলেন। ভাইদের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি কোনও দুর্গম স্থানে সরে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করলেন। তিনি দাউদের কাছে প্রার্থনা করে দক্ষিণ দিকের অগম্য এবং জনবর্জিত ভূস্বামীহীন যশোহর প্রদেশ। নিজ আয়ত্তাধীন করে নেন এবং বহু পরিশ্রম ও অর্থব্যায়ে দু তিন বছরের মধ্যে যশোহর নগরীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর একটি শুভদিন দেখে পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সহ ভবানন্দ জলপথে পাড়ি দিলেন যশোহরের দিকে, গৌড়ে রেখে গেলেন মেজ ভাই শিবানন্দ ও তাঁর পুত্র জানকী বল্লভ এবং নিজের ছেলে শ্রীহরিকে। আত্মগর্বী দাউদ ক্রমাগত মুঘল সীমানা আক্রমণ শুরু করলেন। মোগল পাঠান সংঘর্ষ শুরু হল পুরোদমে। একের পর এক লড়াইয়ে পিছু হঠতে লাগলেন দাউদ। বিপদ বুঝে দাউদ আবাল্যসুহৃদ শ্রীহরি ও জানকীবল্লভ (বসন্ত রায়)–কে নিজের বহমূল্য সম্পদ ও ধনরত্ন রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে যশোরে পাঠিয়ে দিলেন এবং মুঘল সেনাপতি মজঃফর খাঁর সঙ্গে নির্ণায়ক যুদ্ধের জন্য তৈরী হলেন। প্রাণপণ যুদ্ধের পর দাউদ নিহত হলেন। এরপর আকবর বাংলায় স্বীয় প্রভাব স্থায়ী করার জন্য টোডরমলকে বাংলায় পাঠালেন।
টোডরমল একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে, তৎকালীন বঙ্গীয় জমিদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলেন, বিদ্রোহী পাঠানদের রসদ সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করলেন, সমগ্র বাংলায় কৃষিজমি জরিপ করিয়ে জমিদারদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করলেন এবং আরো বড় ব্যাপার যেটা হল প্রশাসনিক ও স্বভাবগত উদারতা বজায় রেখে দাঊদের আমলের সুদক্ষ রাজকর্মচারীদের নতুন প্রশাসনে পুনর্বহাল করার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই সুত্র ধরেই রাজা টোডরমল শ্রীহরি ও বসন্ত রায় এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদের বেশ ঊঁচু পদে নিযুক্ত করলেন। শ্রীহরি তার কর্মকুশলতার সাহায্যে অতি অল্পদিনেই রাজা টোডরমলের বিশ্বাসভজন হয়ে উঠলেন এবং রাজার অনুমতি নিয়ে ভাই বসন্ত রায়কে যশোরে পাঠিয়ে দিলেন। এবং রাজার অনুমতি নিয়ে ভাই বসন্ত রায়কে যশোরে পাঠিয়ে দিলেন। সমস্ত বাংলা জুড়ে টোডরমল যে জমি রেকর্ড করানোর ব্যবস্থা করেন তাতে শ্রীহরি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন। একসময় রাজা টোডরমলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শ্রীহরি যশোরে ফিরে গেলেন। এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়েই গৌড়ে প্রতাপাদিত্যের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। প্রচলিত কোন তথ্য থেকে প্রতাপের সঠিক জন্মসন পাওয়া যায় না। তবে আনুমানিক ১৬৫৮ থেকে ১৬৬৫ সনের মধ্যে কোন এক সময় প্রতাপ জন্মগ্রহণ করেন, তখনও দাদু ভবানন্দ বেঁচে। ভবানন্দই তাঁর এই নাতির নামকরন করে যান। প্রতাপের শৈশব কাটে গৌড়ে, চোখের সামনে তিনি দেখতে থাকেন একটি রাষ্ট্রের ভাঙাগড়া যা তার মনকে আগামী দিনের জন্যে পরিণত করে তোলে। মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে দাউদের তীব্র লড়াই তাঁর রোমান্টিকতাকে উসকে দিল, মনেপ্রাণে স্বাধীনতার পূজারী হয়ে উঠতে থাকলেন তিনি। গৌড়ে থাকাকালীনই তিনি ফার্সিভাষা শেখা আরম্ভ করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই ফার্সিভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ভবানন্দের আদেশে পরিবারের সবাই যশোরে চলে গেলে, প্রতাপও পরিবারের সঙ্গে যশোরে চলে যান। এখানে শুরু হল তাঁর অস্ত্রশিক্ষা, মল্লযুদ্ধ ও অশ্বারোহণ শিক্ষা। অল্পদিনের মধ্যেই তীরন্দাজিতে পটু হয়ে উঠলেন প্রতাপ। ছেলেবেলাতেই দুটি নির্ভীক ও অসমসাহসী কিশোরের সঙ্গে প্রতাপের আলাপ হয়–তাঁরা হলেন শঙ্কর চক্রবর্তী ও সূর্যকান্ত গুহ। এই আলাপ ক্রমে নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় রূপান্তরিত হয়। খুব ছোটবেলা থেকেই প্রতাপ অসমসাহসী এবং দুরন্ত। তাঁর আচরণ শ্রীহরিকে ভাবিয়ে তুলল। মাঝেমাঝেই প্রতাপকে ডেকে তীব্র ভর্তসনা করতেন শ্রীহরি। কিন্তু প্রতাপ অনড়। যুদ্ধবিদ্যায় তাঁর দেখা দিল প্রগাঢ় আগ্রহ। মুঘল পাঠান যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখা,তা বিশ্লেষণ করা, সতীর্থ ও গুরুজনদের সঙ্গে তা নিয়ে নিবিড় আলোচনায় মগ্ন হওয়া তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল। এই যখন অবস্থা তখন অনেক ভেবেচিন্তে শ্রীহরি প্রচুর ধুমধামের সঙ্গে প্রতাপের বিয়ে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে প্রতাপ হয়ত খানিকটা শান্ত হবেন। কিন্তু প্রতাপের জীবনযাত্রা ও অভ্যাস অপরিবর্তিত রইল।জীবনীকার সত্যচরণ শাস্ত্রী মশাইয়ের ভাষায় ”প্রতাপ যৎকালে গৃহে অবস্থান করিতেন, সে সময় তিনি রাজ্যের আয়ব্যয় ও শাসনব্যবস্থা অতি বিচক্ষণতার সহিত সম্পন্ন করিতেন। সে সময় তিনি কঠোরভাব ধারণ করিতেন, সে সময় তাহাকে যমরাজ প্রতিম বলিয়া বোধ হত; কিন্তু অন্য সময় তাঁহার মধুর বাক্য, সহৃদয় ব্যবহার দেখিলে, তাঁহাতে যে অণুমাত্র কঠোরতা আছে তাহা বোধ হইত না। “ভাতৃবৎসল শ্রীহরি আশঙ্কা করলেন প্রতাপের থেকে ভাই বসন্ত রায়ের অকল্যাণ হতে পারে এবং পরিণামে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়াও অসম্ভব নয়। এই ভয়ে শ্রীহরি কিছুদিনের জন্য পুত্রকে দূরে পাঠানোর পরিকল্পনা করলেন। যাতে স্বজনবিরহের প্রভাবে প্রতাপের হৃদয়ে কঠোরতা দুরীভূত হয়। ভাই বসন্ত রায় কিন্তু অগ্রজ শ্রীহরির এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু শ্রীহরি অনড় রইলেন। আগ্রা এ সময়ে ভারতবর্ষের রাজধানী। সম্রাট আকবরের দরবারে একজন প্রতিনিধি হিসেবে প্রতাপকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন শ্রীহরি। এবং ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তটি প্রতাপকে জানানোর ভার নিতে হল কাকা বসন্ত রায়কেই। ফল হল বিপরীত। প্রতাপ ভেবে নিলেন কাকা বসন্ত রায়ই ষড়যন্ত্র করে প্রতাপকে যশোর থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন যাতে বসন্ত রায়ের আধিপত্য যশোরে নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে প্রতাপ আরো ভেবে নিলেন যে তাঁর পিতা শ্রীহরি, কাকা বসন্ত রায়ের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন এবং তীব্র পিতৃব্যবিদ্বেষের বীজ তাঁর মনে গাঁথা হয়ে গেল
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................