তৃতীয় পর্ব
....
এক শুভদিনে প্রতাপ যাত্রা করলেন রাজধানীর উদ্দেশ্যে, কাকা বসন্ত রায় নৌকাবিহারে তাঁকে এগিয়ে দিলেন পদ্মা পর্যন্ত। চারমাস জলপথে ক্রমাগত চলে প্রতাপ শেষ পর্যন্ত রাজধানী আগ্রায় পৌঁছলেন। আকবরের বিশাল সভা, তাঁর উদার মতামত, সুমধুর ব্যবহার ও সভাসদ টোডরমল, বীরবল, ভগবানদাস, ফৈজী, আবুল ফজল প্রমুখকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন প্রতাপ।
আগ্রায় থাকাকালীন মুঘল শাসনব্যবস্থা, যুদ্ধকৌশল, ভূমি–রাজস্বব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিবিড় অধ্যয়নের মাধ্যমে রপ্ত করে ফেললেন এবং মুসলমান শাসকদের রীতিনীতি রপ্ত করার তাগিদে প্রত্যহ সম্রাটের দরবারে যাতায়াত শুরু করলেন। এভাবে অতি অল্প সময়ে প্রতাপ মুসলমান আমীর ও হিন্দু সভাসদদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এসময় একটি ঘটনা প্রতাপকে সম্রাটের কাছাকাছি এনে দিল। একদিন প্রতাপ দরবারে উপস্থিত এমন সময় আকবর তাঁর সভাসদদের একটি অসম্পূর্ণ পদ পূরণের জন্য দিলেন। পদটি এইরকম-“ সেত ভুজঙ্গিনী যাত চলি হেঁ । সভাসদ ও পন্ডিতবর্গ অনেকেই পদটি পূরন করলেন, কিন্তু কোনোটিই সম্রাটের পছন্দ হল না। বিনম্রচিত্ত প্রতাপ সম্রাটকে কুর্ণিশ করে স্বরচিত পদটি সম্রাটকে শোনাতে চাইলেন। আকবর অনুমতি দিলেন। মেঘমন্দ্রস্বরে আবৃত্তি করলেন প্রতাপ– “শোবর কামিনী নীর নিহারতি রিত ভালি হেঁ। চিরমচরকে গঠপর বাপিকে ধারেহ চল্ল চলি হেঁ। রায়বচোরি আপন মনমে উপমাও চারি হেঁ। কেছঙ্গ মরোরতি সেত ভুজঙ্গিনী যাত চলি হেঁ।“ সাহিত্যপ্রেমী সম্রাট অভিভূত হলেন। আকবর ছিলেন প্রকৃত গুণগ্রাহী এবং প্রতাপের এই দক্ষতার পরিচয় পেয়ে তাঁকে বহুমূল্য পুরষ্কারে ভূষিত করলেন। এই সময় থেকেই প্রতাপ বাদশাহ আকবরের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকে পড়লেন। এর পর কিন্তু আগ্রায় স্থির হয়ে প্রতাপ বসে থাকেননি। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে বন্ধু শঙ্করের সঙ্গে ভারতবর্ষের বহু জায়গা ভ্রমণ করেন। চোখের সামনে দেখলেন মেবারের রাণা প্রতাপের লড়াই যা তাকে অখন্ড হিন্দুসাম্রাজ্য স্থাপনে নতুন করে অনুপ্রেরণা এনে দিল। কিছুদিন পর প্রতাপ যশোহর দখলের এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করলেন কেননা তাঁর পিতার অবর্তমানে পিতৃব্য বসন্ত রায়ই যে যশোরাধিপতি হবেন এ বিষয়ে তাঁর ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় তিনি সম্রাটের তহবিলে যশোরের দেয় বার্ষিক খাজনা আটকে দিলেন। এটা তাঁর একটা কূটনৈতিক চাল। কিছুদিন পর ব্যপারটা সম্রাটের নজরে এলে, তিনি প্রতাপকে এ ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলেন। অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে প্রতাপ সমস্ত দোষ এবং অপদার্থতার দায় পিতৃব্য বসন্ত রায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। সম্রাটের কাছে কয়েকদিন সময় চেয়ে নিলেন যাতে তিনি এই অচলাবস্থা কাটিয়ে দিতে পারেন। আকবর তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, যে যদি প্রতাপ বকেয়া কর আদায় করে সম্রাটের তহবিলে জমা করে দিতে পারেন, তাহলে সম্রাট প্রতাপকেই যশোরের সিংহাসনে বসাবেন। ধূর্ত প্রতাপ অল্পদিনের মধ্যেই প্রদেয় রাজস্ব জোগাড় করে ফেললেন এবং সম্রাটের রাজকোষে জমাও দিয়ে দিলেন। সম্রাট অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রতাপকে তার মধ্যে থেকে তিন লক্ষ টাকা এবং যশোর রাজ্যে মুঘল সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করার ফরমান দিয়ে দিলেন। কাকা বসন্ত রায় যদি তাঁর কতৃত্ব স্বীকার না করতে চান সেইজন্য সম্রাটের কাছ থেকে কিছু সৈন্য চেয়ে নেন প্রতাপ। এছাড়াও তিনি নিজে বহু সৈন্য সংগ্রহ করেন। প্রায় বাইশ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রতাপ যশোর অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন। এ রকম একটি ধারণা চালু আছে এই যাত্রাপথে তিনি কিছুদিন বারাণসীতে কাটান এবং এসময়ে তাঁর ব্যয়ে চৌষট্টি যোগিনীর ঘাট নির্মিত হয়, এবং ঘাট সংলগ্ন ভদ্রকালীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হয়। যথাসময়ে প্রতাপ যশোরে পৌঁছে গেলেন। পূর্ব বিদ্বেষবশত প্রতাপের ধারণা হয়েছিল যে সম্রাটের কাছ থেকে ফরমান পেলেও কাকা বসন্ত রায় তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তিতে তীব্র বিরোধিতা করবেন। তাই আগেভাগেই তিনি সশস্ত্র সৈন্যদের সাহায্যে যশোরের রাজকোষ দখল করে নিলেন। কিন্তু বসন্ত রায়ের এরকম কোন চিন্তাভাবনা ছিল না। সুতরাং প্রতাপের এহেন আচরণে শ্রীহরি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। অন্যদিকে প্রতাপও রাজকোষ দখল করার সময়ে বাবা বা কাকার কাছ থেকে কোন বাধা না পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। খুব তাড়াতাড়ি প্রতাপ নিজের ভুল বুঝলেন এবং অনুতপ্ত হলেন। শেষমেশ পিতা ও পিতৃব্যের সঙ্গে প্রতাপের মিলন হল। শ্রীহরি ও বসন্ত রায় প্রতাপের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করালেন। শ্রীহরি জাগতিক দায় থেকে মুক্ত হয়ে সাহিত্যচর্চায় মগ্ন হলেন। এইবার শুরু হল প্রতাপের জীবনে এক নতুন অধ্যায়। মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনতা ছিন্ন করার যে স্বপ্ন তিনি এতদিন ধরে লালন করে এসেছেন সেই রক্তিম পথে পা বাড়ালেন তিনি। প্রতাপ বন্ধু সূর্যকান্ত, শঙ্কর, প্রমুখ বীরদের নিয়ে নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে নিপুণ ছকে নিজেকে তৈরী করতে শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি সুদক্ষ ও কর্মপটু একটি শ্রমিকদের পুল তৈরী করলেন। তাদের সাহায্যে সুন্দরবনাঞ্চলে প্রচুর খাল কাটিয়ে প্রদেশটিকে দুর্গম করে তুললেন। রাজ্যের সর্বত্র মাটির দুর্গ নির্মাণ করালেন, তৈরী করালেন প্রচুর জলাশয়। দুর্গগুলির মধ্যে নৈহাটির কাছাকাছি জগদ্দল, গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে শালিখা দুর্গ (বর্তমানে হাওড়ার শালকিয়া) রায়গড় (বর্তমানে গার্ডেনরিচ/ কেউ বলেন বেহালার বড়িশার কাছাকাছি অবস্থিত ছিল এই দুর্গ), মাতলা এবং ধূমঘাট উল্লেখযোগ্য। পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমে একটি আধুনিক নগর সমন্বিত ধূমঘাট দুর্গ নির্মাণ করা হয়, যা এখন ঘোর জঙ্গলে পরিপূর্ণ এবং মূল সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশে পড়ছে। মগ এবং পোর্তুগীজ জলদস্যুদের বাধা দেবার জন্য তৈরী হল সশস্ত্র রণতরী। নৌবাহিনীকে সুদক্ষ ও শক্তিশালী করে তোলার জন্য তিনি পোর্তুগীজ রডাকে নিযুক্ত করেন নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে। পোর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের নিয়মিত আক্রমণ করে তাদের মেরুদন্ড গুঁড়িয়ে দিলেন, বহু পোর্তুগীজ জলদস্যুকে তিনি সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেন নিজস্ব নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে। গ্রামে গ্রামে তৈরী হল ব্যায়ামাগার, কুস্তি ও তিরন্দাজী শেখার আখড়া, বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে কেনা হতে লাগল প্রচুর পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র। প্রচন্ড উৎসাহ দেওয়া হতে লাগল নাগরিকদের যুদ্ধবিদ্যায় নিজেদের পারদর্শী করে তোলার জন্য।কিন্তু পুরো কর্মসূচীটাই চলল নিবিড় গোপনতার সঙ্গে। সৈন্যবাহিনীতে বৃদ্ধি পেল অশ্বারোহী, পদাতিক ও গোলন্দাজ সৈন্যের সংখ্যা। এরই মধ্যে মৃত্যু হল শ্রীহরির। বিষণ্ণ প্রতাপ পিতৃশ্রাদ্ধ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে আবার মন দিলেন আগামী দিনের প্রস্তুতিতে।
আগ্রায় থাকাকালীন মুঘল শাসনব্যবস্থা, যুদ্ধকৌশল, ভূমি–রাজস্বব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিবিড় অধ্যয়নের মাধ্যমে রপ্ত করে ফেললেন এবং মুসলমান শাসকদের রীতিনীতি রপ্ত করার তাগিদে প্রত্যহ সম্রাটের দরবারে যাতায়াত শুরু করলেন। এভাবে অতি অল্প সময়ে প্রতাপ মুসলমান আমীর ও হিন্দু সভাসদদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এসময় একটি ঘটনা প্রতাপকে সম্রাটের কাছাকাছি এনে দিল। একদিন প্রতাপ দরবারে উপস্থিত এমন সময় আকবর তাঁর সভাসদদের একটি অসম্পূর্ণ পদ পূরণের জন্য দিলেন। পদটি এইরকম-“ সেত ভুজঙ্গিনী যাত চলি হেঁ । সভাসদ ও পন্ডিতবর্গ অনেকেই পদটি পূরন করলেন, কিন্তু কোনোটিই সম্রাটের পছন্দ হল না। বিনম্রচিত্ত প্রতাপ সম্রাটকে কুর্ণিশ করে স্বরচিত পদটি সম্রাটকে শোনাতে চাইলেন। আকবর অনুমতি দিলেন। মেঘমন্দ্রস্বরে আবৃত্তি করলেন প্রতাপ– “শোবর কামিনী নীর নিহারতি রিত ভালি হেঁ। চিরমচরকে গঠপর বাপিকে ধারেহ চল্ল চলি হেঁ। রায়বচোরি আপন মনমে উপমাও চারি হেঁ। কেছঙ্গ মরোরতি সেত ভুজঙ্গিনী যাত চলি হেঁ।“ সাহিত্যপ্রেমী সম্রাট অভিভূত হলেন। আকবর ছিলেন প্রকৃত গুণগ্রাহী এবং প্রতাপের এই দক্ষতার পরিচয় পেয়ে তাঁকে বহুমূল্য পুরষ্কারে ভূষিত করলেন। এই সময় থেকেই প্রতাপ বাদশাহ আকবরের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকে পড়লেন। এর পর কিন্তু আগ্রায় স্থির হয়ে প্রতাপ বসে থাকেননি। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে বন্ধু শঙ্করের সঙ্গে ভারতবর্ষের বহু জায়গা ভ্রমণ করেন। চোখের সামনে দেখলেন মেবারের রাণা প্রতাপের লড়াই যা তাকে অখন্ড হিন্দুসাম্রাজ্য স্থাপনে নতুন করে অনুপ্রেরণা এনে দিল। কিছুদিন পর প্রতাপ যশোহর দখলের এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করলেন কেননা তাঁর পিতার অবর্তমানে পিতৃব্য বসন্ত রায়ই যে যশোরাধিপতি হবেন এ বিষয়ে তাঁর ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় তিনি সম্রাটের তহবিলে যশোরের দেয় বার্ষিক খাজনা আটকে দিলেন। এটা তাঁর একটা কূটনৈতিক চাল। কিছুদিন পর ব্যপারটা সম্রাটের নজরে এলে, তিনি প্রতাপকে এ ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলেন। অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে প্রতাপ সমস্ত দোষ এবং অপদার্থতার দায় পিতৃব্য বসন্ত রায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। সম্রাটের কাছে কয়েকদিন সময় চেয়ে নিলেন যাতে তিনি এই অচলাবস্থা কাটিয়ে দিতে পারেন। আকবর তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, যে যদি প্রতাপ বকেয়া কর আদায় করে সম্রাটের তহবিলে জমা করে দিতে পারেন, তাহলে সম্রাট প্রতাপকেই যশোরের সিংহাসনে বসাবেন। ধূর্ত প্রতাপ অল্পদিনের মধ্যেই প্রদেয় রাজস্ব জোগাড় করে ফেললেন এবং সম্রাটের রাজকোষে জমাও দিয়ে দিলেন। সম্রাট অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রতাপকে তার মধ্যে থেকে তিন লক্ষ টাকা এবং যশোর রাজ্যে মুঘল সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করার ফরমান দিয়ে দিলেন। কাকা বসন্ত রায় যদি তাঁর কতৃত্ব স্বীকার না করতে চান সেইজন্য সম্রাটের কাছ থেকে কিছু সৈন্য চেয়ে নেন প্রতাপ। এছাড়াও তিনি নিজে বহু সৈন্য সংগ্রহ করেন। প্রায় বাইশ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রতাপ যশোর অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন। এ রকম একটি ধারণা চালু আছে এই যাত্রাপথে তিনি কিছুদিন বারাণসীতে কাটান এবং এসময়ে তাঁর ব্যয়ে চৌষট্টি যোগিনীর ঘাট নির্মিত হয়, এবং ঘাট সংলগ্ন ভদ্রকালীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হয়। যথাসময়ে প্রতাপ যশোরে পৌঁছে গেলেন। পূর্ব বিদ্বেষবশত প্রতাপের ধারণা হয়েছিল যে সম্রাটের কাছ থেকে ফরমান পেলেও কাকা বসন্ত রায় তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তিতে তীব্র বিরোধিতা করবেন। তাই আগেভাগেই তিনি সশস্ত্র সৈন্যদের সাহায্যে যশোরের রাজকোষ দখল করে নিলেন। কিন্তু বসন্ত রায়ের এরকম কোন চিন্তাভাবনা ছিল না। সুতরাং প্রতাপের এহেন আচরণে শ্রীহরি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। অন্যদিকে প্রতাপও রাজকোষ দখল করার সময়ে বাবা বা কাকার কাছ থেকে কোন বাধা না পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। খুব তাড়াতাড়ি প্রতাপ নিজের ভুল বুঝলেন এবং অনুতপ্ত হলেন। শেষমেশ পিতা ও পিতৃব্যের সঙ্গে প্রতাপের মিলন হল। শ্রীহরি ও বসন্ত রায় প্রতাপের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করালেন। শ্রীহরি জাগতিক দায় থেকে মুক্ত হয়ে সাহিত্যচর্চায় মগ্ন হলেন। এইবার শুরু হল প্রতাপের জীবনে এক নতুন অধ্যায়। মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনতা ছিন্ন করার যে স্বপ্ন তিনি এতদিন ধরে লালন করে এসেছেন সেই রক্তিম পথে পা বাড়ালেন তিনি। প্রতাপ বন্ধু সূর্যকান্ত, শঙ্কর, প্রমুখ বীরদের নিয়ে নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে নিপুণ ছকে নিজেকে তৈরী করতে শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি সুদক্ষ ও কর্মপটু একটি শ্রমিকদের পুল তৈরী করলেন। তাদের সাহায্যে সুন্দরবনাঞ্চলে প্রচুর খাল কাটিয়ে প্রদেশটিকে দুর্গম করে তুললেন। রাজ্যের সর্বত্র মাটির দুর্গ নির্মাণ করালেন, তৈরী করালেন প্রচুর জলাশয়। দুর্গগুলির মধ্যে নৈহাটির কাছাকাছি জগদ্দল, গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে শালিখা দুর্গ (বর্তমানে হাওড়ার শালকিয়া) রায়গড় (বর্তমানে গার্ডেনরিচ/ কেউ বলেন বেহালার বড়িশার কাছাকাছি অবস্থিত ছিল এই দুর্গ), মাতলা এবং ধূমঘাট উল্লেখযোগ্য। পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমে একটি আধুনিক নগর সমন্বিত ধূমঘাট দুর্গ নির্মাণ করা হয়, যা এখন ঘোর জঙ্গলে পরিপূর্ণ এবং মূল সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশে পড়ছে। মগ এবং পোর্তুগীজ জলদস্যুদের বাধা দেবার জন্য তৈরী হল সশস্ত্র রণতরী। নৌবাহিনীকে সুদক্ষ ও শক্তিশালী করে তোলার জন্য তিনি পোর্তুগীজ রডাকে নিযুক্ত করেন নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে। পোর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের নিয়মিত আক্রমণ করে তাদের মেরুদন্ড গুঁড়িয়ে দিলেন, বহু পোর্তুগীজ জলদস্যুকে তিনি সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেন নিজস্ব নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে। গ্রামে গ্রামে তৈরী হল ব্যায়ামাগার, কুস্তি ও তিরন্দাজী শেখার আখড়া, বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে কেনা হতে লাগল প্রচুর পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র। প্রচন্ড উৎসাহ দেওয়া হতে লাগল নাগরিকদের যুদ্ধবিদ্যায় নিজেদের পারদর্শী করে তোলার জন্য।কিন্তু পুরো কর্মসূচীটাই চলল নিবিড় গোপনতার সঙ্গে। সৈন্যবাহিনীতে বৃদ্ধি পেল অশ্বারোহী, পদাতিক ও গোলন্দাজ সৈন্যের সংখ্যা। এরই মধ্যে মৃত্যু হল শ্রীহরির। বিষণ্ণ প্রতাপ পিতৃশ্রাদ্ধ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে আবার মন দিলেন আগামী দিনের প্রস্তুতিতে।
এবার প্রতাপ হাতে কলমে দেখে নিতে চাইলেন কেমন হয়েছে তাঁর যুদ্ধ প্রস্তুতি। পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যায় তখন বিভিন্ন ছোট বড় শাসকরা নিজস্ব পরাক্রম দেখিয়ে আসছিলেন। প্রতাপ এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। নিজস্ব রাজ্যের শাসনব্যবস্থার দায়িত্ব সুদক্ষ কর্মচারীদের বুঝিয়ে, অভিন্নহৃদয় বন্ধু সূর্যকান্ত ও শঙ্করকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন উড়িষ্যা অভিমুখে। সঙ্গে চলল একদল রণদুর্মদ সৈন্য। এই যাত্রায় প্রতাপ মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা জনিত ত্রুটি গুলি খুঁটিয়ে দেখলেন, দানধ্যানের মাধ্যমে জয় করে নিলেন উৎকলবাসীর মন, সুমিষ্ট ব্যবহারে সুসম্পর্ক তৈরী করে নিলেন ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিদ্রোহী পাঠানদের সঙ্গে যা ভবিষ্যতে তাঁকে বহু সাহায্য করেছিল। কিন্তু প্রতাপ চাইছিলেন মনেপ্রাণে যুদ্ধ। সুযোগ এসে গেল। পিতৃব্য বসন্ত রায় অনুরোধ পাঠালেন প্রতাপের কাছে–উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ এবং গোবিন্দদেব নামে শ্রীবিষ্ণুর কমনীয় মূর্তি নিয়ে আসার জন্য। মধ্য উড়িষ্যায় অবস্থিত এই মূর্তি দুটি নিয়ে চলে আসা সোজা কাজ ছিল না। তদুপরি এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সমগ্র উৎকলবাসীর ভাবাবেগ। যাইহোক বহু উৎকোচ দিয়ে পূজারীদের মাধ্যমে মুর্তিদুটি হস্তগত করে ফেললেন প্রতাপ। কিন্তু প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই স্থানীয় সমাজপতিদের আক্রমণের মধ্যে পড়ে গেলেন। যাই হোক এ আক্রমণ তার কাছে শুকনো পাতার মত উড়ে গেল। কিন্তু প্রতাপ বুঝলেন এত সহজে তিনি ছাড় পাবেন না। তাই আগেভাগেই সৈন্যবাহিনীকে তিনটি আলাদা দলে ভাগ করে নিয়ে শুরু করলেন বাংলা অভিমুখে পথ চলা। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই হল। সুবর্ণরেখা নদীর তীরে আক্রান্ত হলেন উড়িষ্যার বিভিন্ন ছোটবড় রাজাদের মিলিত বাহিনীর দ্বারা। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর হেরে গেল সেই মিলিত বাহিনী। বন্দী হলেন প্রধান উৎকলী সমরনায়করা। কৌশলী প্রতাপ বন্দীসেনানায়কদের যথোচিত সম্মান দেখিয়ে মুক্তি দিলেন, সঙ্গে দিলেন মিত্রতার স্মারক হিসেবে প্রচুর উপহার। উৎকলী সামন্তরাজাদের জড়িয়ে নিলেন বন্ধুত্বের বাঁধনে।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................