বাংলার সুলতানী আমলে হিন্দু মুসলমানের সামাজিক সম্পর্ক ও শ্রীচৈতন্যদেবের খুনীরা
................................................
পঞ্চাদশ শতকে বিজয় গুপ্ত লিখিত ‘মনসামঙ্গলে’ হিন্দু কর্মচারীকে নিয়ে তামাশার চিত্র ফুটে উঠেছে এভাবে-
“যাহার মাথায় দেখে তুলসী পাত।
হাত গলে বান্ধি নেয় কাজির সাক্ষাৎ।
বৃক্ষ তলে থুইয়া মারে ব্রজ কিল।
পাথরের প্রমাণ যেন ঝড়ে পড়ে শিল”…
ব্রাহ্মণ পাইলে লাগ পরম কৌতুক
কার পৈতা ছিঁড়ি ফেলে থুতু দেয় মুখে”।
সাধারণ আম-জনতার জীবনযাত্রা মধ্যযুগের সাহিত্যেগুলোতে কতকটা ফুটে উঠেছে। এসব থেকে আন্দাজ করা যায় সে সময়কার সামাজিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি কেমন ছিল।
সেই মনসামঙ্গলে রাখাল বালকরা যখন ঘট দিয়ে নদীর ধারে মনসা পুজার করে তখন দেখা যায় কাজির লোকজন এসে রাখালদের অকথ্য নির্যাতন করে পুজার আয়োজন ভেঙে দেয়। যে কুমার ঘট তৈরি করে দিয়েছিল তাকে গ্রেফতার করা হলো। মনসামঙ্গলে কাজির উক্তি এভাবে উঠে এসেছে-‘হারামজাত হিন্দুর এত বড় প্রাণ/আমার গ্রামেতে বেটা করে হিন্দুয়ান/গোটে গোটে ধরিব গিয়া যতেক ছেমরা/ এড়া রুটি খাওয়াইয়া করিব জাত মারা”।
চৈতন্যভাগবতের কয়েকটা লাইন, ‘যাহারে পাইল কাজি মারিল তাহারে/ভাঙ্গিল মৃদঙ্গ অনাচার কৈল দ্বারে।/ কাজি কহিল হিন্দুয়ানী হইল নদীয়া।/ করিব ইহার শাস্তি নাগালি পাইয়া/।…
কাজির অত্যাচারে ভীত হয়ে চৈতন্যদেবের চ্যালারা নবদ্বীপ থেকে অন্যত্র চলে যেতে চাইল। হিন্দুদের মধ্যে যারা অবৈষ্ণবী ছিল তারা মনে মনে খুশি হলো এই ভেবে যে এইবার নিমাই পণ্ডিতের দর্পচূর্ণ হবে। নিমাই বেদকে অস্বীকার করে যে জাতপাতহীন ধর্ম প্রচার করছে এই হচ্ছে সেই অনাচারের সাজা। কখনো কখনো কোনো মুসলিম শাসককে স্থানীয় হিন্দুদের প্রশংসা বা স্তূতি’র কারণ ছিল এইরকম কায়েমী স্বার্থের কারণে। চৈতন্যদেব জাতপাতহীন হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে চাইলে ব্রাহ্মণরা ক্ষেপে গিয়েছিল। কাজি চৈতন্য ভক্তদের কীর্তন বন্ধ করে দিলে স্বভাবতই ব্রাহ্মণরা খুশি হয়েছিল। মুসলমান কাজি যেমন চৈতন্যের কীর্তনের দলকে দমন করতে ব্যগ্র ছিলো তেমনি চৈতন্যদেব হিন্দু পুরোহিততন্ত্রের ভীত নাড়িয়ে দিয়ে শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। চৈতন্যদেবের জাতপাতহীন ভজন সাধনকে সেযুগের হিন্দু প্রতিক্রিয়াশীলরা এটাকে মুসলমানদের ষড়যন্ত্র বলে অভিহত করেছিলো এবং চৈতন্যদেবকে বাংলার মুসলমান শাসকদের চর বলে সন্দেহ করত। শ্রীচৈতন্যদেব পুরীতে আসার পর গৌড়ের মুসলমান শাসক শাহ ইসমাইল গাজী অতর্কিত হামলা করে হিন্দুদের মন্দির লুন্ঠন ভাংচুর চালায়। চৈতন্যদেবের আগমনে সময় মুসলিম শাসকের হামলা বহু সাধারণ অবৈষ্ণবী হিন্দু সত্যি সত্যিই চৈতন্যদেবকে মুসলিমদের চর বলে বিশ্বাস করে। এমনকি উরিষ্যর অনেক মানুষ এখনো চৈতন্যদেবকে সেরকমই মনে করে। আসলে চৈতন্যের সাম্যবাদী ধর্ম প্রচারে মন্দিরের পুরোহিত পান্ডাদের ব্যবসায় ভাটা পড়ার আশংকা হচ্ছিল। বিশিষ্ট চৈতন্যদেব গবেষক ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ বইয়ের লেখক ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায় চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে পুরীতে খুন হন। এর আগে আরেক বিশিষ্ট চৈতন্য গবেষক নীহাররঞ্জন রায় চিঠিতে জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে জানান, ‘চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটে কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল । … এই বয়সে শহীদ হবার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না, ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল’।
ঐতিহাসিক দীনেশ সেন ‘বৃহৎ বঙ্গে’ বইতে সর্বপ্রথম চৈতন্যদেবকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবী করেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন অপরাপর দিনের ন্যায় বেলা তিনটার সময় গুণ্ডিচা বাটীর দরজা খোলা হয় নাই। চৈতন্যর পার্শ্বচরগণ মন্দিরের দ্বারে ভিড় করিয়া ছিলেন। কিন্তু আটটা রাত্রিতে দরজা খুলিয়া পাণ্ডারা বলেন, মহাপ্রভু স্বর্গে গমন করিয়াছেন, তাঁহার দেহের আর কোন চিহ্ন নাই। বেলা তিনটা হইতে রাত্রি আটটা পর্য্যন্ত সেই গৃহে পাণ্ডারা খিল লাগাইয়া কি করিয়াছিলেন? মন্দিরের মধ্যেই দেববিগ্রহের প্রকোষ্ঠ-সংলগ্ন বৃহৎ মণ্ডপের এককোণে তাঁহাকে সমাধি দেওয়া হয়। প্রতাপরুদ্রের অনুমতি লইয়াই সম্ভবত ঐরূপ করা হইয়াছিল, যেহেতু উক্ত পুস্তকের একখানিতে লিখিত হইয়াছে, বহু পুষ্পমাল্য সেই মন্দিরের গুপ্তদ্বার দিয়া তখন লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। পুরীর পাণ্ডাদের মধ্যে আর একটি ভীষণ প্রবাদ প্রচলিত আছে - তাহা আমি তথায় শুনিয়াছি। জগন্নাথ বিগ্রহ হইতেও চৈতন্যের প্রতিপত্তি বেশি হওয়াতে পাণ্ডারা নাকি গোপনে তাঁহাকে হত্যা করিয়াছিল’।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডারা নাকি গর্ব করে বলে আমাদের পূর্ব পুরুষরা চৈতন্যদেবকে খুন করেছিলো! এরকম কায়েমী স্বার্থের কারণেই কখনো কখনো শাসকরা উদারতা দেখিয়েছে কিংবা কঠর হয়েছে। নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের কীর্তনের দলকে মারধোর করে মুসলমান কাজির দল, আবার পুরীতে গিয়ে স্বয়ং চৈতন্যদেব খুন হয়ে যান পুরীর পান্ডাদের হাতে। এগুলোকে আলাদা আলাদা করে কেটে প্রদর্শন করে যে যার মত তৎকালীন সময়ের সামাজিক চিত্র আঁকতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক নিরপেক্ষতা হারান। যে কারণে কেউ কেউ বাংলার মুসলিম শাসনে পাঁচশো বছরে একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধেনি বলে জাহির করে আবার কেউ মুসলিম শাসনকে চরম অভিশাপ হিসেবে প্রদর্শন করতে চেষ্টা করেন। যেটি বলতে হবে ইংরেজ আসার আগে ভারতবর্ষ বা বাংলায় পাশাপাশি হিন্দু মুসলমান বসবাস করলেও আসলে কেউ কারোর হতে পারেনি। এমনকি পরিস্থিতি কখনো কখনো নাজুক হয়ে পড়ত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কোন বাস্তব কারণই ছিলো না। উদারতরা বলতে যা শোনা যায় তা আসলে কায়েমী স্বার্থ থেকে শরিকদের বঞ্চিত করতে কখনো কখনো শাসন কার্যে হিন্দুদের স্থান দেওয়া হতো। ইলিয়াস শাহের পদাতিক বাহিনীর অধিকাংশই ছিল হিন্দু যারা বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ করেছিল স্থানীয় হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে। একে তাই অনেকেই ধর্ম সংস্পর্শহীন রাজনীতি হিসেবে দেখার দাবি করেন। কিন্তু ঘটনা মোটেই সেরকম ছিল না। ইলিয়াস শাহ বংশের অন্যতম অমাত্য ছিলেন রাজা গণেশ। সুলতানী আমলের ছয়শ বছরের ইতিহাসে গণেশই ছিলেন একমাত্র অমুসলিম শাসক। কিন্তু তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন সুফিরা। গণেশের পুত্র জাদু পিতার বিরুদ্ধে সিংহাসন দখল করতে শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলায়। নিজেকে সিংহাসনের যোগ্য করতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘জালালউদ্দিন শাহ’ নাম নিয়ে মুসলমানদের সহায়তায় হিন্দু রাজা গণেশকে পরাজিত করে সিংহাসনে বসেন। ত্রয়োদশ শতকের জাফর খাঁ গাজি থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের মুর্শিদকুলী খাঁ পর্যন্ত সকলেই মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। এদের কারুর কারুর যেমন আলীবর্দি খা, মুর্শিদকুলী খানদের শাসনকার্যে হিন্দুদের উচ্চপদে থাকার নজির রয়েছে। একই সময়ে রচিত চৈতন্যভাগবতের আছে, ‘বক্ষে রাখিল ঠাকুর তবু না ছাড়িল।/ চন্দ্রশেখরের মুণ্ডু মুঘলে কাটিল/।
চন্দ্রশেখর ছিলেন চৈতন্যদেবের একজন ভক্ত। তার গৃহদেবতা স্বর্ণের তৈরি ভেবে মুসলমান সৈন্যরা তা কেড়ে নিতে হামলা চালায়। সুলতানী আমলে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যখন মসজিদগুলোর সংস্কার কাজ চলে। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়েই যে মসজিদগুলো নির্মাণ তা ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত হয়েছিলেন। মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থের দুটো লাইনে তখনকার মুসলিম শাসকদের মনোভাব কি ছিল তার কবিতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন এভাবে- “আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই/সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই”। কবিতাটা রচিত সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কালে যখন সেনাপতি মানসিংহ প্রাতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন জাহাঙ্গীরের হয়ে। সে যুগে মুসলিম শাসনে কি পরিমাণ মুসলিম বিদ্বেষ বেড়েছিল তার কিছু দলিল পাওয়া যায় অষ্টদশ শতকে ভারতচন্দ্রের লেখা ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে। নবাব সিরাজদ্দৌলার নানা আলীবর্দি খানকে ‘দুরাত্মা’ উল্লেখ করা হয়েছে অন্নদামঙ্গলে। উড়িষ্যায় হিন্দু ধর্মের প্রতি দমন পীড়ন করার কারণে নন্দি ক্রুদ্ধ হয়ে উক্তি করেছিল, ‘মারিতে লইলা হাতে প্রলয়ে শূল/করিব যবন সব সমূল নির্মূল’। এই কাব্যের আরেক জায়গায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের জবানে বলা হয়েছে, ‘দেহ জ্বলিয়া যায় মোর বামন দেখিয়া/বামনেরে রাজ্য দিতে বল কি বুঝিয়া…/ আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই/সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই’।
কাজেই মধ্যযুগে হিন্দু মুসলমানের ‘পাশাপাশি বসবাসের’ যে চিত্র সাহিত্যে আমরা পেলাম তাতে কি করে এটাকে সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক বলা যাবে? দীনেশচন্দ্র সেন যিনি হিন্দু-মুসলমানের প্রীতিময় সম্পর্ক দেখাতে ভালোবাসতেন তিনিও ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘মুসলমান রাজা এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ সিন্ধুকী (গুপ্তচর) লাগাইয়া ক্রমাগত সুন্দরী হিন্দু রমনীগণকে অপহরণ করিয়াছে। ষোড়ষ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের জঙ্গলবাড়ির দেওয়ানগণ এবং শ্রীহট্টের বানিয়াচঙ্গের দেওয়ানেরা এইরূপ কত যে হিন্দু রমণীকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়াছেন তাহার অবধি নাই! পল্লী গীতিকাগুলিতে এই সকল করুণ কাহিনি বিবৃত আছে’।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................