#ভিটে_মাটীর_গল্প ~
লিখেছেন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা জনৈক ব্রাক্ষ্মণ সন্তান।
(কত সহজেই সব কিছু ভুলে সেকু, মাকু হওয়া যায়!)
"দয়া করিয়া এখানে ইলিশ মাছ ফেলিবেন না" চরের উপর নাকি প্ল্যাকার্ডে এইরকম লেখা থাকতো।
পুজোর সময় আমার বাবা কাকারা যখন দেশে ফিরতেন এক জায়গায় এক চরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওরা এমন লেখা দেখতে পেতেন। আসলে কোনো কোনো বছর এতো ইলিশ উঠতো যে বাজারে দাম পাওয়া যেতো না। অগত্যা জেলেরা পথে যেতে যেতে ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ ফেলে দিয়ে যেতো। সেই মাছ পচে উঠলে তার গন্ধে টেকা দায় হয়ে উঠতো। সেই কারনেই ওই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হতো।
অতো বছর পরেও কলকাতায় যা কিছু খেতেন দেশের সেই স্বাদ যেন আর কিছুতেই পেতেন না। বর্ষায় উঠোনে জল জমলে ক্ষেতের থেকে কইমাছ সাঁতরে চলে আসতো, বারান্দায় বসে ছিপ দিয়ে সেই মাছ ধরার গল্প যে কতো শুনেছি।
আমার বাবা আর কাকা যখন আনন্দ করে সেই আলোচনা করতেন মনে হতো যেন সদ্য সদ্য ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার কথা বলছেন তাঁরা।
বাবা বড্ড দুরন্ত ছিলেন, সুপুরি বাগানে গিয়ে পাতা দুলিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছ লাফিয়ে সারা বাগান ঘুরে বেড়ানো, সব উজ্জ্বল হয়ে ছিলো তাঁদের স্মৃতিতে। সেসব গল্প শুনতে শুনতে মনে হতো এক মাটি থেকে আরেক মাটিতে একই গাছ নিয়ে গেলে তার চরিত্র কতো যে পালটে যায়!
ভিনদেশ কলকাতায় আমার গম্ভীর শান্ত বাবা হয়তো তার জন্মভিটায় থাকলে আমরা তার সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ দেখতে পেতাম।
আমার সুদর্শন ঠাকুরদাকে নিয়ে ঠাকুমার গর্বের শেষ ছিলো না, বলতেন, "বিয়ার পর যখন আইয়া দাঁড়াইলাম হগ্গলে কইতে লাগলো কার্তিকের পাশে একখান দাঁড়কাউয়ারে দাঁড় করাইয়া দিসে!"
তখন আমার ঠাকুর্দার মা বলেছিলেন, "আমার বউরে কারো পছন্দ না হইলে এহানে না থাইক্কা বাড়িৎ যাও গা বরং!"
এ নিয়েও ঠাকুমা গর্বিত ছিলেন। আসলে তখনকার মানুষের মনের মধ্যে তেমন ঘোরপ্যাঁচ ছিলো না।
দেশপ্রেম দেখিয়ে আমার জেঠামশাই জ্যাঠাইমা বাংলাদেশেই থেকে যান। ১৯৪৬ সালে মুসলমানদের হাতে সেখানে তাঁরা মারা যাবার কথা আমার ঠাকুমাকে জানানো হয়নি। বাবা কাকা আগের মতই ঠাকুমার নামে মানি অর্ডার করে বলতেন জেঠামনি পাঠিয়েছেন। আমার জেঠতুতো ছোড়দা কোলকাতায় বাইক দুর্ঘটনায় মারা যান, সেকথা ঠাকুমার কাছে গোপন রাখা যায়নি। তিনি তখন কেঁদে বলেন সেই খবর যেন আমার মা জেঠামনি আর বড়মাকে না জানানো হয়। কী বিচিত্র এই জীবন! ঠাকুমা জানলেন না যাদের কাছ থেকে এই চরম খবর লুকিয়ে রাখতে বলা হচ্ছে তাঁরাও আর এই পৃথিবীতে নেই।
স্বর্গীয় প্রসন্নকুমার দাশগুপ্ত, মানে আমার ঠাকুরদা, ফরিদপুরের মানুষ হয়েও বরিশালে ওকালতি করতেন, সেইযুগেও এখনকার মতোই যেখানে বেশি পশার হবার সুযোগ সেখানেই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার আশায় মানুষজন আস্তানা নিতেন।
আমার ঠাকুরদা সবদিকেই অত্যন্ত উজ্জ্বল হওয়া সত্ত্বেও এক উদাসী মানুষ ছিলেন। ওনার মুহুরী এমন অনেককেই নিয়ে আসতেন তারা দরিদ্র হওয়ায় নিজেদের খরচে মামলা চালাতে পারবেন না, ঠাকুরদা তাদের দুঃখের অংশীদার হয়ে বিনা খরচে তাদের হয়ে কেস লড়তেন। পরে জানা যেতো মুহুরী কিন্তু তাদের কাছ থেকে ঠিকই টাকা আদায় করেছেন। আমার বাবা পড়াশোনা করেছিলেন তৎকালীন রিপন কলেজ, এখন যেটা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ বলে পরিচিত, সেখানে। বাবার রেলে চাকরির সুবাদে ঠাকুরদা ঠাকুমা দেশভাগের অনেক আগেই কলকাতায় চলে আসেন।
ঠাকুর্দার কথায়, "সুধীরের ম্যানেজমেন্টে আমরা খুব ভালো থাকবো।"
তা ছাড়া আমার কাকা ছিলেন আমার অকৃতদার, তার আদরের আহ্লাদে আমরা বড়ো হয়েছি। অগাধ পাণ্ডিত্য ছিলো তাঁর সব বিষয়ে। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। তিনি ছিলেন মাতৃঅন্তপ্রাণ। শেষ বয়সে আমার ঠাকুরদা প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র বড়দিদি ছাড়া আমরা কেউ তখন জন্মাইনি।
দিদির হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে ঠাকুমা এসে বলতেন, "এই ন্যাও, মাইয়াটা তোমার জইন্য চা আনসে।"
ঠাকুরদা বলতেন, "মাইয়াডা কবা না, কও কইন্যারত্ন।"
সেই প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থাতেও ঠাকুরদা মিল্টনের "Paradise Lost" পুরোটা বলতে পারতেন।
হয়তো তখন কোনো এক অন্য "স্বর্গ হতে বিদায়" তাঁর স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকতো! তাঁদের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের জানানো হয়নি যে, তাঁদের সেই ফেলা আসা সোনার বাংলা এখন ইসলামিক বাংলাদেশ হয়ে গ্যাছে, যেখানে হিন্দুদের কোন ঠাঁই নেই।
(সংগৃহীত পোস্ট)
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................