পাণ্ডবদের নাম সবাই বলতে পারবেন। কিন্তু পাণ্ডবপুত্রদের নাম জিজ্ঞেস করলে?

পাণ্ডবদের নাম সবাই বলতে পারবেন। কিন্তু পাণ্ডবপুত্রদের নাম জিজ্ঞেস করলে? অভিমন্যু, ঘটোৎকচ..... ব্যাস্, তালিকা শেষ। যাদের একটু চর্চা আছে, তারা বভ্রুবাহন, ইরাবন বলতে পারেন। এর পরেও গোটা আটেক নাম আছে, তা ক'জন জানেন?

বড় গাছের নীচে ছোট গাছপালা টেঁকে না কারণ, বড় গাছের ডালপালা, নীচে রোদ-বৃষ্টি আসতে দেয়না। কিছু বড় গাছের শেকড় থেকে জাগলন (juglone) নামক একরকম রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যা ছোট গাছপালাগুলিকে শেকড় ছাড়তে দেয়না। তাতে ছোট গাছগুলির বাড় যায় কমে। কখনও তারা শুকিয়েও যায়।তেমনি বিরাট ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি, তুলনায় কম শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, চোখেই পড়েনা। তাই, প্রত্যেকে বড় বীর হওয়া সত্ত্বেও, পাণ্ডবদের ছেলেদের কথা বিশেষ শোনা যায়না।

পাঁচ পাণ্ডবের, দ্রৌপদীর গর্ভজাত, একটি করে ছেলে ছিল। এরা হল 'উপপাণ্ডব' অর্থাৎ 'জুনিয়র পাণ্ডব'।

সর্বজ্যেষ্ঠ উপপাণ্ডব হল যুধিষ্ঠিরের ছেলে - প্রতিবিন্ধ্য। মেজভাই, নকুলের ছেলে শতানীক। পরের ভাই, ভীমের ছেলে সুতসোম। চার নম্বর ভাই, সহদেবের ছেলে শ্রুতসেনা। আর কনিষ্ঠ উপপাণ্ডব হল শ্রুতকর্মা, যার পিতা অর্জুন। এরা প্রত্যেকেই বিশিষ্ট বীর। প্রত্যেকেই কুরুযুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিল।মহাভারতে উপপাণ্ডবদের কথা বিশদে বলা হলেও, আমরা, সাধারণ পাঠককুল তাদের কোন খোঁজ রাখিনা, কারণ তাদের বাবারা হল পাণ্ডবরা। শৌর্যবীর্যে অতি দীপ্যমান। প্রাংশু মহীরুহ।

দ্রৌপদী ছাড়াও, যুধিষ্ঠিরের বিয়ে হয়েছিল শৈব্য সম্প্রদায়ের কন্যা দেবিকার সাথে। তাদের একটি ছেলে ছিল, নাম যৌধ্যেয়। নকুলের আরেক স্ত্রী হলেন চেদী রাজকন্যা করেনুমতী। এঁদের ছেলে নিরমিত্র। মদ্রদেশের রাজকন্যা বিজয়া ছিলেন সহদেবের অপর স্ত্রী। তাদের ছেলে সুহোত্র। 

পাণ্ডবসন্তানদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় হল ঘটোৎকচ। বাবা ভীম, মা রাক্ষসকন্যা হিড়িম্বী (হিড়িম্বা নয়। হিড়িম্বা ছিল হিড়িম্বীর দাদা, যে ভীমের হাতে প্রাণ দিয়েছিল।)। ঘটোৎকচের বীরত্ব মহাভারতে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।

আর অভিমন্যু ছিল পাণ্ডবদের ছেলেদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। অর্জুন-সুভদ্রার  ছেলে। ষোল বছরের এই অত্যাশ্চর্য যোদ্ধার মর্মান্তিক মৃত্যু ছিল মহাভারতের একটা টার্নিং পয়েন্ট।

অর্জুনের মণিপুরী স্ত্রী ছিল রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। তাদের ছেলে বভ্রুবাহন। চিত্রাঙ্গদার সাথে অর্জুনের বিয়ের শর্ত ছিল, ওদের সন্তানাদি হলে সে মণিপুর ত্যাগ করতে পারবেনা,মণিপুরের রাজ্যপাট তাকেই সামলাতে হবে। সেইমত, বভ্রুবাহন মণিপুরেই থেকে গিয়েছিল। কুরুযুদ্ধে অংশ নেয়নি সে।

অজ্ঞাতবাসকালে নাগকন্যা (নাগাল্যাণ্ডের রাজকন্যা) উলুপীর সাথেও অর্জুনের বিয়ে হয়। তাদের একটি ছেলেও হয়। নাম ইরাবন। কুরুযুদ্ধে অংশ নিয়ে, যুদ্ধের অষ্টম দিনে ইরাবনের মৃত্যু হয়েছিল রাক্ষস অলম্বুষের মায়াজালে বিভ্রান্ত হয়ে। তবে মারা যাবার আগে কৌরবপক্ষের  অসংখ্য গান্ধার (আফগান) যোদ্ধার প্রাণ নিয়েছিল বীর ইরাবন। শ্রীকৃষ্ণ আগেই জানতেন, সেদিনের যুদ্ধে ইরাবনের মৃত্যু হবে। কিন্তু, ইরাবনের মৃত্যু আটকাতে শ্রীকৃষ্ণ একটুও চেষ্টা করেননি (কেন করেননি, সে আরেকটা কাহিনী।)।

মহাভারত পড়লে দেখা যায়, পাণ্ডবরা ছাড়া, (বিশেষ করে অর্জুন), শ্রীকৃষ্ণ আর কাউকে বাঁচাতে তেমন তৎপর ছিলেননা। তিনি চেষ্টা করলেই ইরাবনের মৃত্যু আটকাতে পারতেন। ঘটোৎকচেরও। পুত্রসম ঘটোৎকচের প্রাণ গেল কর্ণের 'বাসবী শক্তিতে'। ভীমপুত্রের অন্তিম  আর্তচিৎকার কৃষ্ণের বুকে শেল হয়ে বিঁধেছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর মুখে ছিল স্মিত হাসি। কারণ, প্রাণে রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল সখা অর্জুন। কর্ণের 'বাসবী শক্তির' কোন জবাব ছিলনা অর্জুনের কাছে। কর্ণ এই তীরটা সযত্নে বেছে রেখেছিল অর্জুনকে মারার জন্য। 

শ্রীকৃষ্ণ জানতেন, কৌরবদের সমূলে বিনাশ করতে গেলে অর্জুনের বাঁচাটা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। তাই, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভাগনে, অভিমন্যুও যখন ব্যূহ থেকে বেরোনোর রাস্তা না জেনেও চক্রব্যূহে প্রবেশ করছে, তখন বাসুদেব তাকে নিরস্ত করেননি। প্রতিটি মৃত্যুই তিনি রোধ করতে পারতেন। যেমন, অশ্বত্থামার ছোঁড়া ব্রহ্মাস্ত্রে নিহত উত্তরার গর্ভস্থ পরীক্ষিৎকে বাঁচিয়েছিলেন। তিনি অন্যদের ব্যাপারে এতটা নির্বিকার থাকলেন কীভাবে?

যুগে যুগে বিষ্ণু অবতীর্ণ হয়েছেন, ত্রেতাযুগে রাম, তো দ্বাপরযুগে কৃষ্ণ হয়ে। রামের মত, কৃষ্ণের আবির্ভাবও  ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য। গীতায় আছে, 'ধর্মসংস্থাপনার্থায়, সম্ভবামি যুগে যুগে'। তাই তাঁর সবকাজে উদ্দেশ্য ছিল একটাই - ধর্মের জয়, অধর্মের পরাজয়। নিজেই গান্ধারীর, যদুবংশবিলোপের অভিশাপ মাথা পেতে নিয়েছিলেন। ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অনেক উৎসর্গের প্রয়োজন হয়, তা যতই মর্মবিদারক হোক না কেন।

তাই অবতারের কোন আনন্দ নেই, আসক্তি নেই, দুঃখ নেই। মামা-ভাগনের পারিবারিক সম্পর্ক অতি তুচ্ছ ব্যাপার তাঁর কাছে।

অর্জুনপুত্র ইরাবনের মৃত্যু ছিল সেই 'বলিদান' যা পাণ্ডবদের জয় সুনিশ্চিত করেছিল, অভিমন্যু বা ঘটোৎকচের প্রাণদান আর দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রের মৃত্যু - সে-ও তাই। 

যুদ্ধশেষে কুরুক্ষেত্রে অষ্টাদশ ও অন্তিম রাত। কৌরব বংশ সমূলে বিনষ্ট। যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব শিবিরগুলি জনমানবহীন। জ্বলন্ত মশালের আলোয় অসংখ্য ক্ষণজীবী পতঙ্গদের আনাগোনা।

শ্রীকৃষ্ণ প্রস্তাব দিলেন, দুর্যোধন হত, তার শিবির শূন্য। রাতটা ওই শিবিরেই কাটানো যাক (প্রস্তাবটা শুনতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।)। কৃষ্ণের প্রস্তাব মানেই পাণ্ডবদের কর্তব্য। সেইমত, পাঁচ পাণ্ডব, দ্রৌপদী, কুন্তী এবং শ্রীকৃষ্ণ আশ্রয় নিলেন দুর্যোধনের শিবিরে।

সেই রাতেই, পাণ্ডব শিবিরে  হানা দিল সাক্ষাৎ মৃত্যু। সদ্য পিতৃহারা, উদ্ভ্রান্তপ্রায় অশ্বত্থামার শানিত খড়গ প্রাণ নিল নিদ্রিত পাঁচ পাণ্ডবপুত্রের। প্রাণ হারাল, বাধা দিতে আসা শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্নও।

এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ফলে, হস্তিনাপুর তথা ভারতের রাজ্যভার সামলানোর জন্য পাণ্ডবপরবর্তী প্রজন্মের আর কেউ রইল না। তাই, শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে নিষ্ক্রান্ত হলে,  ভারতশাসনের ভার গেল পাণ্ডবদের নাতি, অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিতের হাতে। সাথে পরামর্শদাতা হিসেবে থেকে গেল একমাত্র জীবিত কৌরব যুযুৎসু। 

আসলে, ভারতের সিংহাসন নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাটাই বিনষ্ট করে দিয়েছিলেন কৌশলী কৃষ্ণ। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। পাণ্ডবপুত্ররা সবাই বেঁচে থাকলে, সেযুগের নিয়মমত, ঘটোৎকচই হত ভারতসম্রাট। ঘটোৎকচ ছিল অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক রাক্ষস। এমন একজনকে ভারতসম্রাট হিসেবে মানাটা একটু সমস্যার হত। আর উপযুক্ততম ব্যক্তি ছিল অভিমন্যু। কিন্তু সে ছিল সর্বকনিষ্ঠ। সবচেয়ে ছোট ভাই হবে সম্রাট, আর বড় ভাইয়েরা  সব মেনে নেবে, এটাও একটু কষ্টকল্পনা ছিল।

তাই পাণ্ডবপরবর্তী প্রজন্মটাকে পর্যায়ক্রমে একেবারে নিঃশেষ করে দিলেন কৃষ্ণ। কারণ, ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যা দরকার তা-ই করেছিলেন তিনি। দরকারমত নির্দয়, নির্মমও হতে হয়েছিল তাঁকে।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted