মাওলানা ভাসানী কেন ডানন্থিদের অতি প্রিয়?
……………………………………………………………
আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একই সঙ্গে মাওলানা ও মাওবাদী হওয়াটা তার স্ববিরোধীতার একটি দলিল। ইসলাম মতে দারিদ্রতা আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য দেন। দরিদ্রদের জাকাত দেয়ার কথা ইসলাম বলে। জাকাত হচ্ছে ইসলামে ৫ স্তম্ভের একটি। অর্থ্যাৎ দারিদ্রতা না থাকলে ইসলামের একটি পিলার ভেঙ্গে যাবে। তাহলে ইসলাম রক্ষা হবে কিভাবে?
যে কারণে ইসলামের সঙ্গে কমিউনিজমের এখানে বড় রকমের বিরোধ থেকে যায়। মাথায় টুপি পরে মার্কসবাদ তাই স্ববিরোধীতা। অন্য ধর্মগুলোর সঙ্গে কমিউনিজমের কোন বিরোধ সে অর্থে নেই। আমরা যেমন গোর্কির মা উপন্যাসে খ্রিস্ট বিশ্বাসী মা ও সে সময়ের রাশিয়ার ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের সমাজতন্ত্রের পতাকা তলে আসতে তেমন বিরোধ দেখি না। কিন্তু ইসলাম তো শুধু আধ্যাত্মিক কোন ধর্ম নয়। ইসলাম একটা রাজনৈতিক ধর্ম। এখানে কেমন রাষ্ট্র হবে সেকথাও বলে। কাজেই ভাসানীকে আদর করে ‘রেড মাওলানা’ যারা বলেন তারা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও কিছু জানেন না, কমিউনিস্ট সম্পর্কেও জানেন না। কিংবা জেনেশুনেই একটা খিচুরি পাঁকান!
ভাসানী তার গ্রামে পানিপড়াও দিতেন। তার অসংখ্য ‘মুরিদ’ ছিলো। তিনি খিলাফত আন্দোলন করেছেন। তিনি মুসলিম লীগ করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনের তিনি সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তার অবস্থান পরিস্কার না হলেও ভারতে শরণার্থী থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারে যোগ দেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন ভারতের বলয়মুক্ত একটা মুক্তিফৈজ তৈরি করে যুদ্ধ চলুক। কিন্তু সেরকম কোন বাস্তব সম্ভাবনা তখন ছিলো না। তাকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিলো বলা হয়। সেরকম নজরবন্দি তো খন্দকার মুস্তাকও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে কেন, আজ অব্দি শেষ হতো না, এখনো পাকিস্তান টিকে থাকত, এখনো মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ জঙ্গলে ওখানে ওখানে চরমপন্থা নিয়ে টিকে থাকত যদি ‘রেড মাওলানা’ খন্দকার মুস্তাকের পাকিস্তান কানেকশন ও শেখ মনির ‘মুজিব বাহিনী’ সফল হত। তাজউিদ্দিন আহমদ এই গ্রুপগুলোকে বিচ্ছিন্ন ও ছেঁটে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে একমুখি একটি জনযুদ্ধে রূপ দিতে পারায় বাংলাদেশ নয় মাসে স্বাধীন হতে পেরেছিলো।
ভাষানীর ‘বাংলা আমার, আসাম আমার ত্রিপুরা আমার’ এগুলো আসলে ‘পাকিস্তানের আন্তভূক্ত করতে না পারার আফসোস। এগুলো পাকিস্তানে জায়গা পেলে এসব জায়গার কোন অমুসলিম কি এতদিনে টিকতে পারত? ভাষানী পাকিস্তানে থাকা তফসিলি সম্প্রদায়কে দাঙ্গার মারমুখি ভাগ্য বারণ করা ঠেকাতে পেরেছিলেন? তিনি নিজেই পাকিস্তানে টিকতে না পেরে ভারতে বারবার আশ্রয় নিয়েছিলেন। একবার ইন্দিরা গান্ধিকে ভারতে জমি ও নাগরিত্ব দেয়ার জন্য চিঠিতে কাকুতি মিনতি করে আর্জি জানিয়েছিলেন। চিঠিতে ভাসানী লিখেন, “আমার বাল্যজীবনের আদর্শ ৮৯ বছর যাবত অটুট রাখিয়াছিলাম। স্বৈরাচার এহিয়া সরকারের অমানুষিক অত্যাচারে উহা লঙ্ঘন করিতে হইল। বর্তমানের রাজনীতিবিদ কংগ্রেসের কর্মীদেরকে যে যাহাই বলুক কিন্তু তাহাদের মত বিলাসিতাশূন্য জীবনযাপন ও নির্মল চরিত্র অনেকেরই নাই। আমি চিরদিন সাধারণ গৃহে সাধারণভাবে নির্জন পল্লীতে থাকিয়া দেশের সেবা করিয়াছি। কিন্তু এবারই তাহার ব্যতিক্রম হইল। গত ৭ মাস শহরে প্যালেসেস সার্কিট হাউস বাস-আহারাদি বিলাসপূর্ণ। তাই আমার মৃত্যুকাল পর্যন্ত যাহাতে বাল্যজীবনের আদর্শ বহাল থাকে তাহারই জন্য ৫ একর জমি ও সাধারণ ধরনের ৪ খানা ঘরের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ীর গ্রামে। তাই আমার বৃদ্ধা স্ত্রীর আশা তাহার শেষ দাফন ধুবড়ীর কোন গ্রামে হয়। আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভারতের সহিত কনফেডারেশন। এই তিন কাজের সাধন ইনশাল্লাহ আমার জীবিতকালে দেখার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পোষন করি। বাধা যতই আসুক, আমার আন্তরিক আশা ও বিশ্বাস আপনাদের আশীর্বাদে অবশ্যই পূর্ণ হইবে। আমার আন্তরিক আশীর্বাদ আপনার আদর্শানুযায়ী সমাজতন্ত্র শুধু ভারতে নহে এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হইবে। যখন দরকার মনে করেন দিল্লীতে ডাকাইলেই হাজির হইব”।
চীনপন্থি হওয়ার কারণে ভাসানী ছিলেন ভারতের সন্দেহের তালিকায়। তবু তাকে ভারত সরকার ১৯৭২ পর্যন্ত ভিআইপি মর্যাদায় নানাবিধ সুবিধা প্রদান করেছে। তার থাকা খাওয়া ও চিকিৎসার সমন্ত ব্যয় ভারত সরকার বহন করে। শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য সেসময় প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া প্রতি মাসে হাত খরচা হিসেবে ভারত সরকার ভাসানীকে দুই হাজার টাকা ভাতা প্রদান করে।
সেই তিনিই দেশ স্বাধীনের পর ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট নিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অমুসলিম নাগরিকদের দেশ ছাড়ার বিগত পঞ্চাশ বছরের স্রোত ভাসানীর বাংলা আসাম ত্রিপুরার জন্য মায়াকান্না আসলে মানুষের জন্য নয়, মাটির জন্য। মুসলমানের আওতায় না আনতে পারার জন্য আফসোস। মনিং নিউজ ৮ অক্টোবর ১৯৭২ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ‘রেড মাওলানা’ ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতিকে তুলে দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে কুরআন হাদিসকে ভিত্তি করে রচনা করার দাবী জানান। ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনে ভাসানীর ন্যাপ ভারত বিরোধীতার নামে চরম সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালায়। সাপ্তাহিক একতার এপ্রিল ১৯৭৩ তথ্যমতে সেসময় ন্যাপ থেকে ‘হিন্দুরা যদি বাঁচতে চাও বাংলা ছেড়ে চলে যাও’ শ্লোগান দেয়া হয়। হিন্দুরা একচেটিয়া আওয়ামী লীগের ভোটার। ভাসানী আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্ছেদ ঘটিয়ে বাংলার মাটিতে ‘মুসলিম বাংলার’ পতাকা উড়ানোর কথা বলেন। স্টেটসম্যান ১৫ মে ১৯৭৩ প্রকাশিত নিউজে ভাসানী নির্বাচনের আগে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেন, হিন্দুরা যদি ভেবে থাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তাহলে ভুল ভেবেছে। তাদের ভাগ্য হবে বিহারীদের মত। জয় বাংলা তাদের বাঁচাতে পারবে না।
মাওলানা ভাষানী কি আজো প্রাসঙ্গিক? মোটেই নয়। বাংলাদেশের এমন একজন জাতীয় নেতাকে পাওয়া যাবে না যিনি অনুপ্রাণিত করতে পারেন। তারা সকলেই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন বা অনিবার্য মনে করতেন। তাদের কেউ এই তত্ত্বকে ভুল অন্যায় বলে পরিত্যাগ করেছিলেন তেমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। বাংলাদেশের মহান এইসব নেতাদের জন্মই হয়েছিলো অবিভক্ত ভারতবর্ষের খিলাফত আন্দোলন থেকে। এই খিলাফত আন্দোলন ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন লক্ষ উদ্দেশ্য কি ছিলো এবং মুসলমান সমাজ ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে যে কোন মাথাই ঘামায়নি, তাদের সমস্ত আগ্রহ ইসলামের খিলাফত রক্ষা করা তা আবুল মনসুর আহমদ অকপটে তিতা সত্যের মত প্রকাশ করছেন। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের আর কোন রাজনীতিবিদ নিজ সম্প্রদায় নিয়ে এতখানি নির্মম সত্য বলেছিলেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেন-
‘১৯২৮ সালে বাংলার হিন্দু মুসলমান নেতৃবৃন্দ্রের এক সভায় সার আবদুর রহিম ও ডা: বিধান চন্দ্র রায়ের মধ্যে যে কথা কাটাকাটি হইয়াছিল সেদিক পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। ঐ সভায় ডা: রায় বলিয়াছেন: মুসলমানরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয় না; শুধু প্রতিনিধিত্ব ও চাকুরি-বাকরিতে অংশ নিতে চায়। সার আবদুর রহিম অবশ্যই সেকথার জবাব দিয়াছিলেন। কিন্তু একটু ধীরভাবে চিন্তা করিলে স্বীকার করিতে হইবে, ডা: রায়ের ঐ অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিলো না। বস্তুত আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব্ ও সরকারী চাকুরিতে মুসলমানদের দাবী দাওয়া মানিয়া লওয়ার ব্যাপারে হিন্দু নেতৃত্বের কৃপনতা ও দ্বিধার যথেষ্ঠ কারণ ছিলো। ডা: রায়ের কথাটা তার ব্যক্তিগত মত ছিলো না। ওটা ছিলো সাধারণভাবে হিন্দুদের ও বিশেষভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বের অভিযোগ। এমন যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তিনি পর্যন্ত বলিয়াছেন: দেশকে ভালো না বাসিয়া দেশের স্বার্থে কোন কাজ না করিয়া মুসলমানরা শুধু ফললাতে সিংহের ভাগ বসাইতে চায়। ‘সিংহের ভাগ’ কথাটা অতিশয়োক্তি নয়, মোটের উপর সত্য কথা। ঐতিহাসিক যত কারণ আর পরিপাশ্বিক যত যুক্তি থাকুক না কেন, এই যুগের বাস্তব অবস্থা ছিলো এই যে, মুসলমানরা সাধারণভাবে ও শিক্ষিত সম্প্রদায় বিশেষভাবে নিজেদের মাতৃভূমিকে আপন দেশ মনে করি না। তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে-কামে এটা মনে হওয়া মোটেই অযৌক্তিত ছিলো না যে মুসলমানরা নিজেদের দেশের চেয়ে মধ্যপাচ্যের মুসলিম দেশগুলিকেই বেশি আপন মনে করে। প্রথমত: মুসলমানদের নিজস্ব কোন চিন্তাধারা ছিলো না। যদি কিছু থাকিয়া থাকে সেটা প্যানইসলামিযম। ‘মুসলিম হায় হাম সারা জাহি হামারাই যেন ছিলো তাদের সত্যকার রাষ্ট্র দর্শন। ১৯২০-২১ সালে খিলাফত অসগযোগ আন্দোলন যে ভারতীয় মুসলমানদের অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনে পরিণত হইয়াছিল সেটা খিলাফত ও তুর্কি সাম্রাজ্যের জন্য যতটা ছিল, ততটা ভারতের স্বারাজের জন্য ছিল না। এটা হাতে-নাতে প্রমাণ হইল দুই বছর পর। ১৯২৩ সালে যখন কামাল পাশা দেশ হইতে খলিফাকে তাড়াইয়া খিলাফতে অবসান ঘোষিত করিলেন তখনই ভারতের মুসলমানদের উৎসাহে ভাটা পরিল। খিলাফত কমিটি মরিয়া গেল, মুসলমানরা কংগ্রেস ছাড়িয়া দিল। এতে তারা এটাই বুঝাইল যে খিলাফতই যখন শেষ হইয়া গেল তখন দেশের স্বাধীনতায় তারা আর ইন্টারেস্টেড নয়’।
রেড মাওলানা বা অমুক তমুক আসলে সবাই মুসলমানের নেতা। ফরহাদ মজহার যার মুরিদ তার আদর্শ নিয়ে কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে? ইনকিলাব সংগ্রামের মত কাগজ ভাসানীকে নিয়ে গদগদ তার কারণ ভাসানী ডানপন্থিদের রাজনীতিতে একজন গ্রহণযোগ্য নেতা যাকে এক কথায় কেউ ফেলে দিতে পারে না। ভাসানীকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছেন। জয়নুল আবেদিন ছবি এঁকেছে। আমি একবিংশ শতাব্দীতে বসে বিগত শতাব্দীর সমস্ত রাজনৈতিক আবেগ শূন্য জেনারেশন হিসেবে এগুলোকে বড় করে দেখি না। কারণ জিন্নাহকে নিয়ে কবি সুফিয়া কামাল কবিতা লিখেছিলেন। সমকালের মানুষ যা দেখতে পায় না ভাবীকালের প্রজন্ম আবেগশূন্য চোখে তা দেখতে পায়। ভাসানীর কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন, জেলখাটা, দরিদ্র অসহায়দের কন্ঠস্বর হওয়া, গ্রাম গঞ্জে সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা তাঁকে ভারতীয় জাঁদরেল কমিউনিস্টদেরও মুগ্ধ করেছে। তিতুমীর বা হাজি শরীয়তুল্লাহকেও বহু কমিউনিস্ট বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী বলে ইতিহাস রচনা করেছেন। কিন্তু এই দুইজন মূলত ভারতকে দারুল ইসলাম করতেই কৃষকদের নিয়ে হিন্দু উচ্চবর্ণের জমিদার ও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো। কমিউনিস্টরা জিহাদী বা ইসলামী খিলাফততে বড় করে দেখে না। তাদের কাছে গরীব মানুষকে নিয়ে অধিকার আদায়ই বিপ্লব। জাতীয়তাবাদীদের কাছেও এ কারণে শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিব তাদের স্ববিরোধীতা, তাদের মুসলিম লীগ ও দ্বিজাতিতত্ত্বকে সমর্থন বড় করে দেখে না। তাদের নিজ দেশের মানুষের জন্য জুলুম নির্যাতন সহ্য করাটাই বিরাট ব্যাপার। এসব নেতাদের এক কথায় ফেলে দেয়াটা প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই এই লেখার বিরোধীতা করা অনেক প্রগতিশীল, কমিউনিস্ট, নাস্তিক, জাতীয়তাবাদীরও যে উদয় ঘটবে তা বলাই বাহুল্য।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................