বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা আমির খান 'মহাভারত' সিনেমা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। ঐ সিনেমায় তিনি নিজেই শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। একজন মুসলমান "মহাভারত" সিনেমায় কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করবেন –এনিয়ে কথিত "ধর্মের রক্ষকরা" তীব্র আপত্তি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে।
বিষয়টি উদ্বেগের। এরকম অসহনশীল ধারণা সনাতন ধর্মের পরিপন্থী। মহাভারতের কোনো চরিত্রে মুসলমান কেউ অভিনয় করলে যাদের গা চুলকায় তারা সনাতন ধর্মের কিছুই বোঝেনা। ধর্ম মানলে এরা এত নিকৃষ্টমানের হিংসুক কিভাবে হয়? হিংসা ছড়ানো ধর্ম নাকি? খারাপ কাজ ধর্ম নাকি?
মুসলমান মহাভারতের কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেনা –এমন কথা কোন শাস্ত্রে লেখা আছে? কেউ কেউ বলছেন, যারা সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করেনা এবং এই ধর্ম নিয়ে হাসিতামাশা করে, তাদের মহাভারত সিনেমা বানানো বা সেখানে অভিনয় করার অধিকার নেই।
প্রথমত, সংশ্লিষ্ট সিনেমার স্ক্রিপ্ট না দেখে বা সিনেমাটি বানানোর আগেই আপনি বলতে পারেন না, তারা হাসিতামাশা করছে। দ্বিতীয়ত, কেউ যদি সমালোচনা করতে চায় এমনকি কি হাসিতামাশা (satire) করতে চায়, সে অধিকার তার আছে এবং তার জবাব দেওয়ার অধিকার আপনারও আছে। স্যাটায়ার শিল্প সাহিত্যের অংশ। সনাতন ধর্ম শিল্পবিরোধী কখনো নয়। সনাতন ধর্ম নিয়ে হাসিতামাশা করলে কিচ্ছু যায় আসেনা। এতে ধর্মের কোনো ক্ষতি হয়না।
ধর্ম কোনো ছাঁচে গড়া পাত্র নয়। ধর্মকে যারা নিজস্ব ছাঁচে দেখতে অভ্যস্ত, তাদের ধর্ম টিকবে না। পরিবর্তনশীলতাই জীবনের ধর্ম। সমাজও পরিবর্তনশীল। সনাতনধর্ম পরিবর্তনশীল হওয়ার কারনেই এটি সনাতন... শাশ্বত। এখানে বহুমতের স্থান আছে, ক্রিটিসিজমের জায়গা আছে। পুরাতন অনেক কিছুই অগ্রহণযোগ্য, যা শাস্ত্রে থাকলেও আজ অচল। সুতরাং হাসিতামাশা করলেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, বরং প্রগতির পথ আবর্জনামুক্ত হচ্ছে।
ধর্ম নিয়ে হাসিতামাশা মুসলমান করলে আপনাদের কষ্ট লাগে, হিন্দু কেউ করলে অসুবিধা নেই –এই যে বোধ, এর নাম সাম্প্রদায়িকতা। এর নাম ধর্ম নয়।
কেউ কেউ বলেছেন, সনাতন ধর্ম নিয়ে হাসিতামাশা করার মাধ্যমে অনেক হিন্দুকে মুসলমান বানানো হচ্ছে। এটি ভুল ধারণা। হাসিতামাশা করলে কেউ ধর্মান্তরিত হয়না। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ ভিন্ন এবং প্রেক্ষিতও ভিন্ন ভিন্ন। ইসলাম এবং সনাতনধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করে, উভয় ধর্মের তুলনামূলক বিচার করে কেউ ধর্মান্তরিত হয়েছে এমন উদাহরণ দেখিনি।
কেউ কেউ বলছেন, যাদের আমরা সাম্প্রদায়িক বলি, তারাই সনাতন ধর্মকে রক্ষা করছে! হায় হায়! ধর্মের দুর্গতি যদি এতদূর গড়ায় তবে আত্মঘাতের আর বাকি নেই। আপনি কি মনে করেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সাম্প্রদায়িক ছিলেন? গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সাম্প্রদায়িক ছিলেন? না-কি প্রেমিক ছিলেন? শুধু মানব প্রেম নয়, "জীবে প্রেম" –গোটা জগৎসংসারের প্রতি মোহহীন প্রেমময়তা সেখানে। "ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়।" সনাতন ধর্মকে সাম্প্রদায়িক মহল রক্ষা করছে, না-কি মহান ব্যক্তিরা এর রক্ষাকর্তা? বড় কিছু করতে হলে বড় প্রেম লাগে, দরদী হতে হয়।
ধরুন আমি একজন মেডিকেল সায়েন্সের ছাত্র। আমাকে নিউরো সায়েন্স শেখাচ্ছেন একজন খ্রিস্টান, বা একজন মুসলমান বা একজন ইহুদি। আমি যে বই অধ্যয়ন করছি তা হয়তো একজন অতিঘোর নাস্তিকের লেখা। আমি যে বিদ্যার চর্চা করছি তার সূত্র হয়তো দিয়ে গেছেন একজন চীনা। নব নব জ্ঞানের সৃজনকারীরা নানাজন নানা বিশ্বাসের হতে পারে।
কিন্তু তিনি আমার শিক্ষাগুরু। তিনি কি খান, কি পোশাক পরেন, কোথায় তার জন্ম, তিনি কোন জাতের, তিনি কোন ধর্মের –এইসব চিন্তা করে আমি তাকে দূরে ঠেলব? সম্পর্কের বিচার কি এই? আমার প্রতিবেশী, আমার বন্ধু, আমার মানবিক বোধ, স্নেহ-প্রেম-ভালবাসা, সুখদুঃখের স্মৃতি –এই সবকিছু নিয়ে আমি মানুষ। এখান থেকে বিচ্যুত হলে আর ধর্ম থাকে না। আর যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত সে ধর্মকে রক্ষা করবে কিভাবে?
বাংলা ভাষায় সর্বোত্তম মানের কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, ভক্তিগীতি কে লিখেছেন? তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। মুসলমান বিবেচনায় তাকে সরিয়ে দেবেন? শ্যামাসঙ্গীত গাইবেন না? যাদের হৃদয়ে এত হিংসা, তারা আর যাই হোক ধার্মিক হতে পারেন না, ভাল মানুষ হতে পারেন না। যে শিক্ষা মানুষকে অমানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করে তা যদি ধর্ম হয়, তবে যতদ্রুত সম্ভব সে ধর্মের অবসান হওয়া উচিত।
শিবমহিম্নঃ স্তোত্রে বলা হয়েছে, "রুচিনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।" অর্থাৎ, হে প্রভু, যেরূপ সকল নদী বিভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়ে একই সমুদ্রে পতিত হয়, রুচির বৈচিত্র্য হেতু মানুষও তেমনি সরল ও কুটিল প্রভৃতি নানা পথে তোমার দিকেই ধাবিত হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে বারবার এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন।
শ্রীমদভগবদগীতাও এই সত্যেরই পোষকতা করছে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাং স্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।" অর্থাৎ, যে যেরূপ মত আশ্রয় করে আসুক না কেন আমি তাকে সেভাবেই অনুগ্রহ করে থাকি। মানুষ সর্বতোভাবে আমারই অনুসারী।"
আপনি বা আমি নিশ্চয় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের চেয়ে সনাতন ধর্ম বেশি বুঝি না। তিনি বলেছেন, "যত মত তত পথ।" এই বহুত্ববাদিতাই সনাতন ধর্মের প্রাণ। সনাতন ধর্মে নাস্তিক্যবাদও পরিত্যক্ত কিছু নয়। নাস্তিক্যবাদও সনাতন ধর্মেরই অংশ। কেউ যদি মহাভারতের সমালোচনা করে, তাতেও বাঁধা নেই। কারণ মহাভারত নিজেই বহুমাত্রিক মতাদর্শ ধারণ করে এবং মতাদর্শগত পারস্পরিক ধারণা নিয়ে বিতর্ক করে। মহাভারত, তথা সনাতন ধর্ম বহুমাত্রিক। একে ডগমাটাইজ করার চেষ্টা সনাতন ধর্মের অনুকূল নয়।
গীতায় আরও বলা হয়েছে- ‘‘যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার এবং ক্ষমাশীল, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত" (গীতা ১২/১৩-১৪)। সুতরাং যারা হিংসা ছড়াচ্ছেন তারা কোনমতেই ভগবানের প্রিয় হতে পারেন না। তারা ধর্মচ্যুত।
ভারতে আমির খান মহাভারতের উপর সিনেমা করতে চাচ্ছেন, এজন্য তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে–তাও আবার হিন্দুধর্ম বাঁচানোর নাম করে –এধরণের সংবাদ যখন বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় আসে তখন আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়। পৃথিবী কোথায় যাচ্ছে, আর এই হিন্দু-মুসলিম ফ্যানাটিকরা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে! সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................