ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।

সি, আর, দত্ত-৫: কাছে থেকে দেখা
তার নেতৃত্বেই জন্মষ্টমীর মিছিল শুরু
কাকু যখন প্রথম পাবলিক সার্ভিসে আসেন, অর্থাৎ মহানগর পূজা কমিটি’র সভাপতি হ’ন, সবাই যে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছেন, তা নয়? একটি প্রশ্ন তখন বারবার আসছিলো যে, ওনার তো তেমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই? একথা তখনকার সময়ে ভারতীয় দূতাবাসও বলেছিলো। আমাদের তখন উত্তর ছিলো, আমাদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুধাংশু শেখর হালদার’র মত রাজনৈতিক; জাষ্টিস দেবেশ ভট্টাচার্য্য, জাষ্টিস রনধীর সেন-র মত বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব আছেন; জেনারেল দত্ত হচ্ছেন আমাদের সাহসী নেতা। ওনার কি-নাই সেটি পরে দেখা যাবে, আপাতত: ওনার সাহসে সাহসী হয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। তাই হয়েছিলো। যোগ্যতা প্রমান করতে জেনারেল দত্ত বেশি সময় নেননি। 

অবাক কান্ড যে, আশির দশকে তাঁর বিপক্ষে একজন মানুষও সরব ছিলোনা। সবার তিনি নেতা। আর হবেন না-ই-বা কেন? সবাইকে তিনি যথোপযুক্ত সন্মান করতেন। জাষ্টিস দেবেশ ভট্টাচার্য্যের ওপরে কথা বলতে কাকুকে আমি কখনো দেখিনি। সুরঞ্জিতদা, সুধাংশুদা, ব্যারিষ্টার দাসের সাথে তাঁর আচরণ ছিলো ভাই ও বন্ধুসুলভ। কথা কখনই তিনি খুব বেশি বলতেন না, যা বলতেন, হৃদয়ের কথা, সোজা কথা সোজাভাবেই বলতেন। তবে এরশাদের আমলে ১৯৮৪ সালে ‘হিন্দু লীগ’ গঠিত হয়েছিলো, এর নেতা ছিলেন মেজর অনুকূল দেব, এঁরা মহানগর পূজা কমিটি ও পূজা পরিষদের বিরোধিতা করতেন, জেনারেল দত্তের বিরোধিতা করার মত কিছু তাদের হাতে ছিলোনা। প্রেমরঞ্জন দেব এবং সঞ্জীব চৌধুরী এক সময় ঢাকেশ্বরী মন্দির কেন্দ্রীক আমাদের কর্মকান্ডের বিরোধী ছিলেন।

একজন মানুষ যখন মনের কথা সোজাভাবে বলেন, তখন এই সরলতা বা সত্যভাষণ না মেনে অন্যদের উপায় থাকেনা। জেনারেল দত্ত বিরাট বপু, দীর্ঘদেহী, শক্ত-সামর্থ্য, কিন্তু মনটি ছিলো শিশুর মত সরল। তাকে সবাই ভালবাসে নেতৃত্বের জন্যে নয়, তাঁর অনেস্টি বা সততার জন্যে। নেতার দোষগুণ দু’টোই থাকে। এই নেতার কোন বিকল্প ছিলোনা। তিনি ছিলেন পথ-প্রদর্শক, আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন। তিনি পূজা ও ঐক্য পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কিন্তু তাকে কেউ ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে কটাক্ষ করেনা। অথচ তিনি আশির দশকে কোন এক পূজার অনুষ্ঠানে ‘বিজয়া সম্মিলনী’তে কয়েক হাজার মানুষের সামনে এক ভাষণে বলেন, ‘আর যদি আমার ছেলেদের গায়ে হাত দেয়া হয়, তবে রক্তগঙ্গা বইবে’। এরশাদ তখন ক্ষমতায়। জেনারেল দত্ত ছাড়া একথা বলার সাহস তখন কারোই ছিলোনা।

তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে ‘জন্মাষ্টমী’র মিছিল বন্ধ হয়ে যায়, খুব সম্ভবত: ১৯৫০ সালে। বঙ্গবন্ধু’র আমলেও সেটি হয়নি। সন’টি মনে নেই, তবে আশির দশকের প্রথমভাগে ঢাকায় প্রথম আবার জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা হয়, পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে এবং জেনারেল দত্তের নেতৃত্বে।
সেই শোভাযাত্রাটি খুব ছোট ছিলোনা। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন এতে অংশ নেয়। কোথা থেকে শুরু বা কোথায় গিয়ে শেষ হয় মনে নেই, কিন্তু গুলিস্থান থেকে সদরঘাটের দিকে মিছিল যাওয়ার পথে মানুষের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখেছিলাম। সি, আর, দত্ত ও নেতারা সামনে ছিলেন। আমি মধ্যখানে ট্রাকের ওপর মাইকে। সারা রাস্তায় কথা বলতে বলতে, শ্লোগান দিতে দিতে আমার গলা ভেঙ্গে যায়। আমি কিছুটা বিশ্রামের জন্যে মাইক ছেড়ে হাটতে থাকি। কোথা থেকে কাকু এসে হাজির। বেজায় ধমক দিয়ে বলেন, ‘তোমাকে না বলেছি, মাইক ছেড়ে তুমি কোথাও যাবেনা। যেই কথা সেই কাজ। আশির দশকে পূজা বা এসব অনুষ্ঠানের মাইকটি প্রায়শ: আমার হাতে থাকতো। আমি যে ভালো উপস্থাপক তা নয়, সম্ভবত: একজন সাংবাদিকের হাতে ‘মাইক’ অর্থবহ, হয়তো সেই কারণে নিম ভৌমিক, স্বপন সাহা  বা নেতারা তাই চাইতেন। কারণ যাই হোক, মাইকটি আমার হাতে থাকলে নেতারা মনে হয় নিশ্চিত থাকতেন, বিশেষতঃ জেনারেল দত্ত।

এর বিড়ম্বনাও আছে। একবার পূজায় সিএমএলএ (চিফ মার্শাল ল এড্মিনিস্ট্রেটর) এসেছেন। ষ্টেজে বসা জেনারেল এরশাদ, সভাপতি সি, আর, দত্ত এবং অন্য ধর্মীয় নেতারাও ছিলেন। এরশাদের পেছনে ঠায় দাঁড়ানো তাঁর এডিসি। অনুষ্ঠান শুরু। খানিক বাদে এরশাদ তাঁর এডিসিকে কি যেন বললেন, তিনি আমায় বললেন, ‘স্যার বিজি আছেন, স্যারকে তাড়াতাড়ি ভাষণ দেয়ার সুযোগ করে দেন। আমি ফিসফিস করে সভাপতি জেনারেল দত্তকে জানালাম। তিনি রেগে গেলেন এবং আমায় রাগতভাবে বললেন, ‘নো’। আরো দু’একজন ভাষণ দিলেন। এডিসি আবার আমায় তাগাদা দিলেন। আমি বললাম, জেনারেল দত্ত রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি দিতে পারবো না! একটু বাদে আমি আবার কাকুকে বললাম, তিনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে এডিসি আমায় তাগাদা দিচ্ছেন। এবার তিনি সদয় হলেন এবং বললেন, এবার দেবে। তাই দিলাম। আর একবার এরশাদ ঢাকেশ্বরী মেলাঙ্গনে ঢুকে পড়েছেন, আমি দৌড়ে গিয়ে জেনারেল দত্তকে বললাম, এরশাদ এসে গেছেন, তিনি মৃদু ভৎসনা করে বললেন, ‘সো হোয়াট’? আমি দেখেছি, বা অনেকেই দেখেছেন, এরশাদ প্রধান সামরিক প্রশাসক হলেও আর্মির নিয়ম অনুযায়ী জেনারেল দত্তকে ‘স্যালুট’ দিতে বা ‘স্যার’ বলতে হতো। জেনারেল দত্তকে জোরপূর্বক রিটায়ার করানোর এটি হয়তো একটি কারণ। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট্রের সম্পত্তি বিক্রী করতে সম্মত না হওয়াও আর একটি কারণ। তখন সকল সংস্থায় চিঠিপত্রে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম’ লেখা শুরু হয়ে গেছে। সি, আর দত্তের স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো, ওসব চলবে না, চলেও-নি। এজন্যেই তিনি বলতে পাতেন, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। guhasb@gmail.com;

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted