গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা 'শোন একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি' গানের একটা লাইন যদি খেয়াল করেন দেখবে সেখানে হারানো বাংলাকে আবার ফিরে পাওয়ার কি আকুতি! জন্মভূমিতে আবার ফিরে আসার স্বপ্ন। "এই সবুজের বুকে চেরা মেঠো পথে/আবার যে যাব ফিরে, আমার/হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব"।
এটা ছিলো দেশভাগের কারণে মুসলমানদের হাতে দেশ হারানো হিন্দুদের বাংলাদেশ নিয়ে ফ্যান্টাসি। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ যে মুসলমানদেরই দেশ এটা ফ্যান্টাসিতে ভোগা পূর্ববঙ্গ ফেরত হিন্দুরা বুঝেনি।
এবার কিছু সহ্য করতে না পারা সত্য কথা বলি। অনেকেই শুনতে ভালো লাগবে না তবু বলি। পূর্ববঙ্গ মূলত গরীব অশিক্ষিত মুসলমান কৃষকদের নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল ছিলো। এখানে ধনী জমিদার মুসলমান বাঙালির মুখের ভাষা ছিলো উর্দু এবং নিজের আরব থেকে আসা আশরাফ (বড় জাতের) মুসলমান মনে করত। তাই বামুন শিক্ষিত শ্রেণী দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে যাওয়ায় এদেশের সংস্কৃতিও পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে যায়। বাংলাদেশের যত ঐতিহ্যবাহী পুরোনো স্কুল কলেজ সবই বামুনদের করা। বাংলা সাহিত্য সংগীত সংস্কৃতি জগতের মহারথী তাদের ৯৯ ভাগের জন্ম পূর্ববঙ্গে। দেশভাগের ফলে তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলে সাহিত্য সংস্কৃতিতে যে চরম শূন্যস্থানের সূচনা হয় তা পূরনের যোগ্যতা এখানকার মুসলমানদের ছিলো না। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রাণিত করা গানগুলোর বেশিরভাগ দেশভাগের কারণে বাংলাদেশ ত্যাগ করা বামুন কায়েতদের লেখা ও সুরে! দেশভাগের ফলে এমনকি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনও চিরতরে মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রধানত হিন্দু রেল শ্রমিকরা ছিলো পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট শক্তি। দেশভাগের ফলে তারা চলে গেলে মুসলমান শ্রমিকদের কমিউনিস্ট করা যায়নি। বদরুদ্দীন উমারের লেখা বিশাল আকারের 'ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস' বই দেখতে পারেন সেখানে তিনিও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন মার খাওয়ার কারণ হিসেবে এটাই বলেছেন।
মন্দ হোক ভালো হোক কবীর সুমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য বিনা পয়সায় গান গেয়ে ডোনেশন জোগাড় করে দিয়েছিলেন। সেই তিনি এখন বলেন বাংলাদেশকে তার যা চেনার চেনা হয়ে গেছে! কেন এই আক্ষেপ মাখা অভিযোগ? কারণ সমস্ত সরাসরি অনুমতি থাকার পরও চট্টগ্রামের কিছু সংস্কৃতিকর্মী তার কনসার্ট বাতিলের বিরুদ্ধে রাস্তায় পিকেটিং করেছিল এই বলে যে ইন্ডিয়ার শিল্পীদের এনে এখানে অনুষ্ঠান করা চলবে না...।
এতসব কি জন্য বলছি জানেন? এই যে ভাস্কর্য মূর্তি জায়েজ নাজায়েজ তর্ক, মুসলিম বিশ্বের উদাহরণ দেখিয়ে ভাস্কর্য রক্ষার চেষ্টা এসবই সংস্কৃতি দৈন্যতা। এদেশে কোথায় লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী যাদের দীপ্তি পদচারণায় মাদ্রাসার এইসব *মোল্লারা খাবি খাবে? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারদের প্রজন্মরা কেবল দেশ হারানোর ক্ষতি বুকে চেপে কষ্ট সয়ে গেছেন। সে প্রজন্মের প্রায় কেউই এখন আর বেঁচেও নেই। শান্তি পেয়েছেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতি তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সংস্কৃতি দৈন্যতা তো এখানে পূরণীয় নয়।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................