আধুনিক যুগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হলে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে হয়, কিন্তু একসময় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষ, দলে দলে ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে এসে পড়াশোনা করতো। মরুদস্যুদের উপর্যুপরি আক্রমণের মুখে ভারতবাসী- বিশ্ববিখ্যাত সেই বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ হারিয়েছে, স্বাধীনতা হারিয়েছে, অনেকগুলো রাষ্ট্র হারিয়েছে; অবক্ষয় এখনো থামছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে - ভারতের সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালসমূহ ভারতবাসীকে এমন শিক্ষায় কেন শিক্ষিত করে তুলতে পারল না, যে শিক্ষা দিয়ে জাতি রক্ষা করা যায়, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ধরে রাখা যায়?
মহাবিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ হচ্ছে, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের অধ্যাপকমণ্ডলী, বস্তুবাদী শিক্ষাকে গৌণ মনে করতেন এবং ধর্মশিক্ষাকে একচ্ছত্র প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করা প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতগণ, পার্থিব শিক্ষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, সারাদেশে পরলৌকিক-শিক্ষা প্রচার করে বেড়িয়েছেন, স্বর্গলাভ ও পরজন্মের পন্থাগত মতপার্থক্য নিয়ে- যুগের পর যুগ তর্ক-বিতর্ক করেছেন, গবেষণা করেছেন, অগণিত পুস্তক রচনা করেছেন; কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কীভাবে টিকে থাকা যায়, তার উপায় উদ্ভাবন করা তো দূরের কথা - যারা জাগতিক বস্তুবাদী জ্ঞানচর্চা করতেন, রাজশক্তি কঠোরহস্তে তাদের কন্ঠ স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
মধ্যযুগে আরব সম্প্রসারণবাদীদের আগ্রাসনের মুখে ইতালির পণ্ডিতগণ ভাবতে থাকেন, এই প্রবল পরাক্রান্ত অমানবিক আক্রমণকারীদের প্রতিহত করে, কীভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে সামনে অগ্রসর হওয়া যায়। ইতালীয় মনিষীদের সেই নবচিন্তা বা রেনেসাঁ - দারুণভাবে প্রভাবিত করে, ফ্রান্স-ব্রিটেন এবং পরবর্তী সময়ে জার্মানিসহ সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের চিন্তাশীল মানুষদের।
ইউরোপীয় চিন্তানায়কগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ধর্মাশ্রয়ী পশ্চাৎগামী রাষ্ট্রপদ্ধতি উচ্ছেদ করে- বস্তুবাদী জ্ঞাননির্ভর আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে, সফল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ইউরোপীয় মনীষীদের বস্তু-জ্ঞানের সেই রাষ্ট্রবিপ্লব- ইউরোপকে বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে এবং ইউরোপ সম্প্রসারিত হয়েছে উভয় আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে।
এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম জাপান, ইউরোপীয় আধুনিক বস্তুবাদ আত্মস্থ করে, উন্নত-ধনী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ব্রিটিশ বেনিয়ারা, ইউরোপীয় আধুনিক বস্তু-জ্ঞান ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল বিধায়, হিন্দুজাতির ধ্বংসাবশেষ খণ্ডিত ভারত রাষ্ট্রটি এখনো টিকে আছে। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শের না এলে, ভারত রাষ্ট্রটি এতদিনে, সিরিয়া-ইয়ামেন-সোমালিয়া-লিবিয়ার মতো ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত হয়ে, খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যেত।
ইদানিং ভারতে বেশ কিছু প্রভাবশালী সংগঠন প্রচার চালাচ্ছে, 'ইউরোপীয় বস্তু-জ্ঞান সাংঘাতিক খারাপ, ওই জ্ঞান মানুষকে বিষয়মুখী ভোগবাদী করে তোলে- যা ঈশ্বর প্রাপ্তির পথে প্রধান অন্তরায়'। এই মতবাদীরা বিশ্বাস করে, 'ইংরেজি নয়- উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত সংস্কৃত এবং ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে, প্রতিটি হিন্দুর জীবনের ধ্রুবতারা হওয়া উচিত ধর্মশিক্ষা'।
সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে, ইউরোপীয় বস্তু-জ্ঞান বিরোধীরা আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। আমি বলি, 'আমার পক্ষে একটুও নড়াচড়া করা সম্ভব নয়; কেননা আমার হাত-পা বাঁধা। জীবন রক্ষার জন্য আমাকে প্রতিদিন ইউরোপীয়দের আবিষ্কৃত একাধিক ঔষধ খেতে হয়'। তারা বলে, 'আপনাকে একটি ঔষধও খেতে হবে না'। তাদের মতে, 'প্রতিদিন ভোর বেলা খালি পেটে এক পেয়ালা করে গাভীর মূত্র পান করলে, সমস্ত অসুখ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়'।
এই সর্বরোগহরপন্থী ধর্মীয় সংঘের প্রভাবে, আমার পরিচিত এক তরুণ দম্পতি, মাছ-মাংস-ডিম-পি়ঁয়াজ-রসুন খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে; এমনকি আমিষের ভাগ বেশি থাকায় মসুরি ডাল পর্যন্ত এরা খায় না। সম্প্রতি তারা সন্তানদের কিণ্ডারগার্টেন স্কুল ছাড়িয়ে, সংস্কৃত-মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়েছে। এই তরুণ দম্পতি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, 'হিন্দুদের উচিত আধুনিকতা পরিহার করে, মূল বা গোড়ায় ফিরে যাওয়া'।
সময়ের প্রয়োজনে নিজেকে যে বদলায়, সে আধুনিক। কিন্তু মূল বা গোড়াটা কোথায়? মানুষের উৎপত্তি মাতৃগর্ভ থেকে। সুতরাং কেউ যদি মূল বা গোড়ায় ফিরে যেতে চায়, তাহলে তাকে তো মাতৃগর্ভে ফিরে যেতে হবে। সেটা কী সম্ভব?
কৃত্তিবাস ওঝা
২৭/১১/২০২০খ্রিঃ
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................