আমি যখন ছোট, আমাকে নিয়ে মা তার বোনের শ্বশুর বাড়ি যেত। শ্বশুর ছিল পীর। পীরের ছিল অনেক মুরিদ। সেখানেই দেখেছি সেই পীর কী করে ফতোয়া দেয়, দুনিয়াদারির লেখাপড়ার বিরুদ্ধে ফতোয়া, দুনিয়াদারির চাকরি বাকরির বিরুদ্ধে ফতোয়া, টেলিভিশন, ক্যামেরা ইত্যাদি ব্যবহারের বিরুদ্ধে ফতোয়া, শাড়ি, গয়না, সাজগোজ সব কিছুর বিরুদ্ধে ফতোয়া।
কেউ ছবি আঁকতে পারবে না, কেউ গান গাইতে পারবে না, কেউ নাচতে পারবে না। কেউ ইস্কুল কলেজে যেতে পারবে না। সারাদিন ঘরে বসে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করবে, তসবিহতে দরুদ পড়বে, নামাজ রোজা করবে। শেষ জমানা এসে গেছে, দজ্জাল এসে যাচ্ছে, এই সময় বিয়ে টিয়েও নাকি করা উচিত নয়। বিয়ে বিরোধী ফতোয়া দিয়ে তিনি তাঁর মুরিদদের বিয়ের বয়সী কন্যাদের দিয়ে গা হাত পা মালিশ করাতেন।
কয়েক বছর পর পীরের নাতনি হৈচৈ করে বিয়ে করার পর মুরিদদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল, তাদের কন্যাদের বিয়ের বয়স তখন পার হয়ে গেছে। পীরের মৃত্যুর পর মুরিদেরা সব ধীরে ধীরে বদলে গেল। তারা পীরবাড়ির মাদ্রাসা থেকে ছেলে মেয়ে উঠিয়ে দুনিয়াদারির ইস্কুল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল।
ইস্কুল কলেজ পাশ করে ছেলেমেয়েরা দুনিয়াদারির চাকরি বাকরিও করতে লাগলো। সবাই রেডিও, টেলিভিশন, ক্যামেরা টেলিফোন ইত্যাদি দুনিয়াদারির জিনিস ব্যবহার করতে শুরু করলো। আরবের পোশাকের বদলে দিশি পোশাক বা শাড়ি গয়নাও পরতে শুরু করলো, কিন্তু আল্লাহ রসুলে বিশ্বাস করা , নামাজ রোজা, হজ ইত্যাদি পালন করা এসব ঠিক রইলো আর সব ধার্মিকের মতো।
এ থেকে কী বুঝলাম? বুঝলাম যে 'পাগল যেমন নিজের বুঝটা বোঝে', ধার্মিকও সেটা বোঝে। নিজের আরাম আয়েশটা , সুযোগ সুবিধেটা, টাকা কড়িটা বেশ বোঝে। ধর্মের কথা বলে দুনিয়াদারির কিছু থেকে তাদের বঞ্চিত করা যায় না।
সেই কারণে আজকের মোল্লারাও দিব্যি টেলিফোন টেলিভিশন , ক্যামেরা কম্পিউটার সবই ব্যবহার করছে। এদিকে তারা কিন্তু চিৎকার করে আমাদের বলছে, প্রাণ দিতে পারলেই ছবি আঁকবে। প্রাণ দিতে পারলেই প্রাণীর মূর্তি তৈরি করবে। তাহলে তারা ক্যামেরা কেন ব্যবহার করে, ক্যামেরায় ক্লিক করলে যে ছবিটি আসে, সেটায় কি তারা প্রাণ দিতে পারে?
তারা যদি সত্যিকার ইসলামই প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তো ক্যামেরা, টেলিভিশন, টেলিফোন, কম্পিউটার --- যেসবে প্রাণীর ছবি দেখা যায় -- সেসবের বিরুদ্ধে আজ আন্দোলন করার কথা। করে না কেন? কারণ এতে তাদের সুবিধে নষ্ট হবে। বিজ্ঞানের সুবিধে নিয়ে তারা বিজ্ঞানবিরোধী প্রচারণা চালায়, তাদের রাজনৈতিক ইসলামের জন্য। তাদের জিহাদি কর্মকান্ডের জন্য।
এই যে বাংলাদেশে জিহাদি মোল্লারা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বলছে, কেন বলছে? এতে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা আছে, তাই বলছে। তারা ওয়াজ ক'রে ক'রে, বিভিন্ন মঞ্চে বক্তৃতা ক'রে ক'রে ধর্মভীরু মানুষের মগজধোলাই করে ফেলেছে। মসজিদ মাদ্রাসায় এনে এত দিনে কোটি লোককে বোকা বানিয়ে ফেলেছে। এই কোটি লোককে রাস্তায় নামিয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। তারা নিজেই বলছে, তাদের দৌড় এখন আর মসজিদ পর্যন্ত নয়, তাদের দৌড় পার্লামেন্ট পর্যন্ত।
তারা যদি আদৌ ভালো লোক হত, মসজিদ মাদ্রাসায় যারা ইয়াবা লুকিয়ে রেখে ব্যবসা করে, অগুনতি মানুষকে যারা মাদকাসক্ত করে, যারা বাচ্চাদের ধর্ষণ করে, খুন করে -- তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতো। ঘোর দূর্নীতি, আর অন্যায়ের পঙ্কে ডুবে থাকা মসজিদ মাদ্রাসার ইমাম এবং শিক্ষকদের শুদ্ধ করার চেষ্টা করতো। কিন্তু তারা তা করবে না। যে ভাস্কর্য বা মূর্তি কারো কোনও ক্ষতি করে না, তার বিরুদ্ধে তারা লেগেছে, তাদের হাতে হাতুড়ি শাবল চাপাতি ছুরি এসব হাতিয়ার আছে, তবে সবচেয়ে বড় যে হাতিয়ারটি তারা ব্যবহার করে, সেটির নাম ইসলাম। তাদের হাত থেকে এই হাতিয়ারটিই সবার আগে কেড়ে নিতে হবে।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................