বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে কাজ করা, আর মান্দারগাছে পিঠ ঘষা একই। তবু করব।

বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে কাজ করা,
আর মান্দারগাছে পিঠ ঘষা একই

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় হল এমন একটি সম্প্রদায় যাদের ইতিহাস বিস্মৃত জাতিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা চলে।এ ইতিহাস বিস্মৃতির কারণে তারা অসংখ্য স্বজাতি বৈরি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কালখণ্ডে। যে সিদ্ধান্তগুলোর অভিঘাতে পরবর্তীতে জাতিগতভাবে তারা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ায়, একই ভুলের পুনরাবৃত্তি তারা পূর্বেও করেছে আজও করে চলছে।



তাই দুঃখ করে বলতে হয়, বিনাশেও যাদের বুদ্ধি হয় না, তাদেরই আরেক নাম বাঙালি হিন্দু বা তথাকথিত সেকুলার হিন্দু। এরা যদি বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা নিতে পারতো তবে তারা জাতিগতভাবে হয়ত কিছুটা হলেও আজ সুরক্ষিত হতে পারতো।সে শিক্ষা-দীক্ষায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের থেকে এগিয়ে থাকার পরেও প্রতিনিয়ত পরাজিত হয়েছে, শুধুমাত্র কাণ্ডজ্ঞানহীন আসার লোকদেখানো কর্মকাণ্ডের কারণে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় সে শুধু ভুলই করে গেছে। যে ভুলের খেসারৎ সে প্রতিনিয়ত দিয়ে চলছে, আরও কতকাল খেসারৎ দিতে হবে তা সেও জানে না এবং কেউ জানেনা।আশেপাশের মানুষ যতবেশি অন্ধকারে ডুব দিয়েছে, বাঙালি হিন্দু ততই আলোর রাজ্যে যেতে চেয়েছে। মহৎ থেকে মহোত্তম হতে চেয়েছে।সে শুধু কোয়ালিটির পেছনেই দৌড়েছে, কিন্তু দিনশেষে দেখা গেল যারা শুধুমাত্র "পয়দা কর, ফায়দা লোটো"- এ আদর্শে চলে জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধি করেছে তারাই আজ কোয়ান্টিটির জোরে জয়ী। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন একটি ভোট, তেমনি রাস্তার একজন টোকাই বা অর্দ্ধপাগল তারও একটি ভোট। ভোটের হিসেবে দুজনেই সমান। এ কারণেই গণতন্ত্রকে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সহ অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মূর্খের শাসন বলে অভিহিত করেছেন। যেহেতু দেশের অধিকাংশ লোকই মূর্খ; তাই এ গণতন্ত্রের নামে মূর্খরাই সর্বত্র রাজত্ব শুরু করে যাকে 'মূর্খতন্ত্র' বলে। অবশ্য গুরু প্লেটোর গণতন্ত্রকে 'মূর্খতন্ত্র' সংজ্ঞায় অবিহিত করার সাথে শিষ্য অ্যারিস্টটল সম্পূর্ণ একমত ছিলেন না। গণতন্ত্রে ভাল-মন্দ দুটি দিকই আছে। যদিও গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন বলা হয়েছে, এরপরেও বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রবিহীন আমরা চিন্তাই করতে পারি না। রাজতন্ত্র গত শতাব্দীতেতেই পরিত্যক্ত হয়ে, পৃথিবীর কয়েকটি দেশ বাদে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র নামে নামমাত্র টিকে আছে। সমাজতন্ত্রও তার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত তৈরি করতে না পেরে জৌলুশ হারিয়ে স্তিমিত হয়ে গেছে। তাই একমাত্র ভরসা, ভাল-মন্দ মিশ্রিত সবেধন নীলমণি গণতন্ত্র।

জাতিগতভাবে বাঙালি হিন্দু হতভাগা হয়ে লক্ষ্মীছাড়াদশা হয়ে আর কিছুই হোক বা না হোক অন্ততপক্ষে মহান হতে পেরেছে। অনেকে এই ঠুনকো মহান হতে গিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও দ্বিধা করেনি। এই তথাকথিত মহান ব্যক্তিবর্গ মৃত্যুর পরে মূর্তি হয়ে ভাস্কর্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আর যাই হোক অন্ততপক্ষে মূর্তি বা ভাস্কর্য হয়ে রাস্তার আশেপাশে নিজের অবস্থিতি জানাতে পেরেছে। কিন্তু বাঙালিদের অপর একটি অংশে মহান ব্যক্তিদের যেমন মৃত্যু পরবর্তীতে মূর্তি হওয়ারও উপায় নেই; তেমনি মূর্তি হয়েও শান্তি নেই মৌলবাদীদের মূর্তি বিরোধী রক্তচক্ষুর কারণে।

বর্তমানে হিন্দুদের নিয়ে কাজ করা আর মান্দারগাছে পিঠ ঘষা একই ; রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হওয়া ছাড়া গতি নেই। সম্প্রদায় নিয়ে যারাই বেশী স্বার্থহীন কাজ করবে তাদেরই স্বজাতীয়দের পক্ষ থেকে কুৎসিত বিকৃতআনন্দরূপ নিন্দা, গঞ্জনা এবং অহেতুক অপবাদের শিকার হতেই হবে। এরা ফুল দিতেও দ্বিধা করে না, আবার জুতা দিতেও দ্বিধা করে না। কারো পায়ে পরতেও সময় লাগে না, আবার প্রয়োজন ফুরালে ঘাড়ধাক্কা দিতেও সময় লাগে না। যদিও অনেক বিরক্ত হয়ে এই কথাগুলো লিখছি; কিন্তু কথাগুলো শতভাগ সত্য। ধর্মের জন্যে হিন্দুরা যে টাকা খরচ করে না, তা নয়। কিন্তু যা করে তা অধিকাংশই জাতির কোন কাজে লাগে না। টাকাগুলো অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়। এ খাতগুলো হল:

ক. অপ্রয়োজনীয় নামকীর্তন মহোৎসব , যে স্থানে কীর্তন একটা হলেই চলে, সেখানেই লোকদেখানো পঁচিশ-ত্রিশটি মহোৎসব করতেই হবে এবং খিচুড়ি খাওয়ার মহোৎসবের নামে টাকার শ্রাদ্ধ করতেই হবে।

খ. পূজাগুলো সাত্ত্বিকভাবে করলে খরচও কম এবং দেবতারাও প্রসন্ন হন। কিন্তু আমরা সাত্ত্বিক পূজার বদলে যেভাবে রাজসিক, তামসিকভাবে পূজার আয়োজন করি তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে আমরা দেবতাদের আশীর্বাদ এবং অনুগ্রহের বদলে অভিশাপই লাভ করি।

গ. স্বজাতির চিন্তা না করে বিভিন্ন বাবা, গুরু, স্বঘোষিত অবতারদের এবং তাদের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদের জন্মমৃত্যুর দিনে ধর্মীয় মহোৎসবের নামে সারাবছরব্যাপী কোটিকোটি টাকা খরচ করা হয়। এ অহেতুক খরচটি অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক। যারা ধর্ম, সমাজ, জাতির কল্যাণে সত্যিকারভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের জন্যে হিন্দুদাতাদের ভাণ্ডার হয়ে যায় শুন্য। পরিণামে যারা লোককল্যাণে কাজ করে তারা একসময়ে হতাশ হয়ে পথে ক্ষান্ত দেয়। যারা মানুষের জন্যে কাজ করে না সমাজ তাদের নিয়ে আলোচনা করে না বা সমালোচনা করে না। কিন্তু যারা জাতির জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যায় তাদের অনেকের ভাগ্যেই অধিকাংশ সময়ে জোটে অকারণ বিভিন্ন অপবাদের কলঙ্কতিলক।

ঘ. বিয়ের সময়ে লোকদেখানো অতিরিক্ত খরচ করা হয়। একেকটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়েতে গড়ে প্রায় ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়। অনেক সময়ে এর বেশিও খরচ করা হয়। অথচ সাধ্য এবং সামর্থ্য অনুসারে বিয়ের আয়োজন করা হলে, এসব অপ্রয়োজনীয় অনাকাঙ্ক্ষিত লোখদেখানো খরচ থেকে ছেলেপক্ষ এবং মেয়েপক্ষ উভয়ই মুক্তি পেতে পারে।

ঙ. জেলে সম্প্রদায়, মুচি সম্প্রদায়, আদিবাসী হিন্দু সম্প্রদায়, সিলেটের চা শ্রমিক সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে কি পরিমাণে গরিব, অসহায় এবং নির্যাতিত মানুষ আছে, তা শুধুমাত্র এ নিয়ে যারা কাজ করে তারাই একমাত্র জানে। এই অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ না করে শুধুমাত্র ভানধরা মানবতাবাদী দিয়ে জাতির পাঁচ পয়সারও উপকার হয় না।

বেদের মধ্যে বিশেষ করে ঋগ্বেদে অসংখ্য মন্ত্রে নিঃশর্ত দানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।ঋগবেদের প্রথমমণ্ডলে দানদেবতা সূক্তে (০১.১২৫.০৬) বলা হয়েছে নিঃশর্ত দানের জন্য দাতাগণ লাভ করেন দৈবী আর্শীবাদ যুক্ত জীবন এবং জরা মরণ রহিত অমরত্ব। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের মত দশম মণ্ডলেও দান প্রসঙ্গে ভিক্ষু ঋষিদৃষ্ট সম্পূর্ণ একটি সূক্তই আছে। সূক্তটির নাম 'দানদেবতাসূক্ত'। দান সনাতন ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একারণেই যজুর্বেদীয় বৈদিক সমাবর্তন ভাষণেও একাধিকবার দানপ্রসঙ্গ উক্ত হয়েছে।

মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ
সত্যং ব্রবীমি বধ ইৎস তস্য।
নার্যমণং পুষ্যতি নো সখায়ং
কেবলাঘো ভবতি কেবলাদী।।
(ঋগ্বেদ: ১০.১১৭.০৬)

"যে ব্যক্তি দুঃস্থদের সাহায্য করেনা, অজ্ঞানী এবং অন্তঃদৃষ্টিহীন তার সকল উন্নতিই বৃথা, সকল সম্পত্তিই অনর্থক।যে অন্যদের সাহায্য করেনা, অন্যকে অভুক্ত রেখে কেবল নিজে খায় সে মূলত পাপই ভোজন করে।"

ধর্মে এত সুন্দর করে দান সহ মানবিক সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও; আমরা যখন সেই দৈব নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে পালন করি না। অবস্থাদৃষ্টে তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, সবই যেন বৃথা প্রয়াস। শক্ত চৈত্রের মাটির ঢেলাতে নতুন সবুজ বৃক্ষের আহ্বানের এই প্রয়াসে আমরা শেষপর্যন্ত সফল হবো তো? ব্যাঙকে একপালায় যেমন মাপা যায় না, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে যায় পালা থেকে ; সেই ব্যাঙ মাপার মতোই প্রায় অসাধ্য হিন্দুজাতিকে একত্র করার কাজটি যতই কষ্ট হোক দিনশেষে আমাদের করতেই হবে। এবং সেই কাজে অগ্রসৈনিক ভ্যানগার্ড হতে হবে শিক্ষিত একঝাঁক সরল হৃদয়ের তরুণদের। অগ্রসৈনিক তরুণদের সরল হৃদয়ের হতে হবে এই কারণে যে, কোনরকম চালাকি, ছলচাতুরী দিয়ে জগতে কোন মহৎকর্মই সম্পন্ন হয় না।তাই জাতির ঐক্যবিরোধী হতচ্ছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া দশা কাটিয়ে আসুন সবাই একে অন্যের হাতধরাধরি করে এক চিরকাঙ্ক্ষিত স্বর্ণাভ ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমরা এক নতুন দিগন্তরেখা উন্মোচন করি ; আর তা না হলে উপায় নেই, পেছনে শমন ছোঁকছোঁক করে আমাদের খাওয়ার জন্যেই বসে আছে।

আমরা অধিকাংশ সময়ে বিপদের পূর্বাভাস পেলেও তা সময়কালে বুঝতে পারি না এবং সেই ভবিতব্য পূর্বাভাসকে বিশ্বাস করি না।এ কারণেই বিপদ যখন আস্তে আস্তে আমাদের গায়ের উপর এসে উপস্থিত হয়, তখন বুঝতে পারি আমরা বিপদগ্রস্ত। পূর্বে কেউ যদি বিপদের সম্ভাবনার কথা বলে, তবে তাকে আমরা শত্রু মনে করে তার প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করি। তাই বিপদ যখন গায়ে চলে এসে পিঠের ছাল ছড়াতে শুরু করে তখন আর মৃত্যুর প্রতীক্ষা পূর্বের স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। এ প্রসঙ্গে একটি বাংলা ছড়া স্মর্তব্য। আমি মনে করি বাঙালি হিন্দুদের জন্য বিশেষ করে বর্তমান কালের জন্য ছড়াটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

"আজ বুঝবি না, বুঝবি কাল,
কপাল চাপড়াবি, আর পারবি গাল।
যেদিন বুঝবি, নিজের হাল
সেদিন থাকবে না,পিঠের ছাল।"

অধিকাংশ সময়ে নিজেদের ভাল-মন্দ আমরা বুঝতে পারিনা। ঘোরের বশে আবদ্ধ থেকে আমরা অনেক কাজই করে ফেলি। পরবর্তীতে বুঝতে পারি যে আমরা কি ভুল করেছি। তখন আর উপায় থাকেনা, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় আমাদের। বহু বছরের বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসনের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দুর চরিত্রে দাসসুলভ মানসিকতা দৃশ্যমান। তারা সাপের সাথে এক পাতে ভাত খাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। সাধারণ বুদ্ধিতে একটু উপলব্ধি করে না যে, বিষাক্ত সাপের সাথে একপাতে ভাত খাওয়া যায় না। তবে এতে ভয়ের কিছু নেই, আমাদের বিশ্বাস করতে হবে- "রাত যত গভীর হয়, প্রভাত ততই কাছে আসে।" এ কথাটি সত্য যে, বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বহু মানুষকে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে যুগেযুগে। এরপরেও আমাদের থেমে না গিয়ে পথে নামতে হবে। মনে রাখতে হবে, পথই পথিককে পথ দেখিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যায়। পথে বিষাক্ত সাপ হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু ভয় পাওয়া যাবে না। ভয় পেলে গন্তব্যে কখনো পৌছানো যাবে না। পথে বিষাক্ত সাপ থাকবেই, সে সাপকে পায়ে পদদলিত করেই মাভৈঃ মাভৈঃ বলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো, অন্যথায় নয়। থেমে যাওয়ার নামই মৃত্যু, এগিয়ে চলার নামই জীবন। আমরা যদি বিষাক্ত সাপের ভয়েতে পথেই না নামি, তবে আমরা নিজের তো দূরে থাক জগতের কারোই কোনদিন কল্যাণ করতে পারবো না।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted