কিছু মানুষের অনুরোধে আমি এখানে একটি কাহিনী বলবো । কাহিনী টি বলার আগে তার সম্পর্কে কিছু বলতে চাই,নাহলে বিষয়টি পরিষ্কার কার হবে না।
পৃথিবীর আদি কাব্যগ্রন্থ রামায়ণ । তার সম্পর্কে দু চার কথা বলতে চাই। রামায়ণ কাহিনী বা তার সত্যতা প্রমাণের জন্য পোস্ট টা করিনি। কাব্যটি কবে রচনা,কে বা কারা রচনা করেন ,তার প্রকৃত কাহিনী টি( অবশ্য আমি যতটুকু শুনেছি) কি সেটাই বলতে চাই।
রাম কাহিনীর প্রবক্তা হলেন চ্যবন ঋষি। তিনি ঋষি পুলোস্থ্য পুত্র।
১৯৭৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির আয়োজিত জনসভায় ড.সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন ,রাম কথার প্রধান সংকলক চ্যবন মুনি। বিষ্ণু অবতার হিসেবে রাম কে প্রতিষ্ঠিত করা পরবর্তী কালের ঘটনা,বৌদ্ধ জাতকে রাম কাহিনীর উল্লেখ,রাম ও সীতার ভাই বোন সম্পর্ক, সীতা হরণ কাহিনীর পিছনে গ্রীক পুরাণের প্রভাব রয়েছে।
সুতরাং বাল্মীকি কে সহজেই তিন হাজার বছর আগে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু রামায়ণ লিপিবদ্ধ করা হয় সপ্তম খ্রীষ্ট পূর্ব থেকে শুরু করে চতুর্থ খ্রীষ্ট পূর্বে র মধ্যে,এটা ঐতিহাসিক মত। তবে অনেকের মতে বুদ্ধদেবের জন্মের আগেই রামায়ণ লিপিবদ্ধ করা হয়ে গিয়েছিল। ঘরে ঘরে তার প্রচলন ছিল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তা গীত হতো । স্বয়ং ফা হীয়েন স্বীকার করেছেন,যে বুদ্ধ যুগের আগে দুটি মহাকাব্য বিপুল ভাবে জনপ্রিয় ছিল ভারত উপমহাদেশে।
রামের জন্ম হয় কোশল রাজ্যে ,বর্তমানে আওয়াধ যেখানে অবস্থিত। পূর্ব থেকেই কোশল রাজ্যের রাজধানী র নাম অযোধ্যা ( অপরাজেয় নগরী) । এখানে ছিল ইক্ষাকু কুলোদ্ভব সূর্য্য বংশীয় রাজাদের রাজত্ব। (না না এরা সূর্য দেবের বংশধর না। এদের পূর্ব পুরুষ , মানে ইক্ষাকুর পিতামহ এর নাম বিবস্বান । তার নাম অনুসারে এই বংশ কে সূর্য বংশ বলা হয়।) সূর্য বংশীয় রাজাদের বংশ তালিকা আপনারা ইউ টিউব এ পেয়ে যাবেন। বিস্তৃত আর দিলাম না।
যাই হোক,এই আলোচনার শেষ নেই । আমি আমার শোনা কাহিনী টি বলি,যেটা উত্তর প্রদেশে বহুল প্রচলিত একটি কাহিনী। ঐতিহাসিক রাও অনেকে স্বীকার করেছেন ,কোশল রাজ্যে এক রাম রাজার জন্ম হয়,তবে তিনিই মহাকাব্যের রাজা রাম কিনা সেই বিষয় যুতসই পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
কাহিনী টি শুরু হচ্ছে রাজা রাবণ কে দিয়ে।কোশল রাজ্যের উপকন্ঠে ( বর্তমানে দিল্লী র কাছাকাছি) ছিল বিশ্রবা মুনির আশ্রম । সেখানেই বিশ্রবা ও সুমালী কন্যা কৈকষী ঘরে তিন পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। বিশ্রবা বড় পুত্রের নাম রাখেন দশনন। অবশ্যই তাঁর দশটি মাথা ছিল না, একটিই মাথা ছিল। দশানন সমস্ত শাস্ত্রে পন্ডিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর ব্রহ্ম তেজ চাপা পড়ে ক্ষত্র তেজের কাছে। রাবণ যখন যুবক তখন অযোধ্যার সিংহাসন আলো করে আছেন রঘুকুল বীর দশরথ।
রাবণ চাইলেন দশরথ কে সিংহাসন চ্যুত করে তিনি ই সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু দশরথ ছিলেন মহাবীর ও তাঁর ছিল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। তিনি খুব সহজেই রাবণকে সেই স্থান থেকে বিতাড়িত করেন। তারপর রাবণ ও মন্দদোরী ( তিনিও ইক্ষকু কুলের রাজকন্যা) দক্ষিণে চলে যান। লঙ্কায় তখন রাজত্ব করছেন তাঁর মাসতুতো ভাই। অনেকের মতে,তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই, কিন্তু সেটা ভুল। কারন বেদে আছে,কুবের বর্নে শুদ্র ছিল।
দক্ষিণ ভারতের অনেকাংশ ,জাভা,সুমাত্রা ও লঙ্কা অনেক খানি জুড়ে ছিল তাঁর রাজত্ব। স্বর্ণ লঙ্কার প্রভু ছিলেন কুবের। রাবণ তাঁকে সিংহাসন চ্যুত করে নিজে গদিতে বসেন। রাজ্যহীন কুবের তখন উত্তর ভারতে চলে আসেন এবং সাধনা করে ব্রাহ্মণ্য ত্ব প্রাপ্ত হন। পরবর্তী কালে তিনি দেবতা রূপে পূজিত হন। বিশ্বামিত্র ও কুবের এর ব্রাহ্মণ হওয়া থেকেই বোঝা যায় রাম কাহিনীর পটভূমি একেবারে বৈদিক যুগে,যে সময়ে বর্ণ প্রথা বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠেনি।
এদিকে দশরথ তাঁর পুত্র দের বিয়ে ঠিক করলেন বিদেহ রাজা জনকের দুই কন্যা ও তস্য ভ্রাতার দুই কন্যা র সাথে। এখানে তারকা রাক্ষসী বধ ও রামের হরধনু ভঙ্গ দুটি ঘটনা বাল্মীকি বা পরবর্তী কালের অনামী লিপিকার দের নব্য সংযোজন।
কিছুদিন পর রাম পিতৃ সত্য পালনের জন্য সীতা ও লক্ষ্মণ সহ বনে যান। এই খবরটি রাজা রাবণ পান। তিনি প্রতিহিংসা পরবশ হয়ে একাকিনী সীতা কে হরণ করেন। সূর্পনোখা কাণ্ডটি বাল্মীকির কল্পনা প্রসূত। রাবণ ও সীতা আদম ব্রিজ দিয়েই লঙ্কা যান।পুষ্পক বিমানে নয়। সেটা পরবর্তী লেখক দের কল্পনা প্রসূত।
এরপর রাম ও লক্ষ্মণ সীতা কে খুঁজতে খুঁজতে দক্ষিণে পৌঁছন। সেখানেই কিষ্কিন্ধ্যা রাজ হনুমান,সুগ্রীব ,অঙ্গদ প্রভৃতি দের পরিচয় হয়। এরা বাঁদর বা বানর প্রজাতির নয়। তাঁরা বনবাসী নর বা মানুষ। বলা যেতে পারে অনার্য। রাম কে সাহায্য করতে তাঁরা এগিয়ে আসেন।
রামেশ্বরম এর ব্রিজ টির কথা স্থানীয় লোকেরা সবাই জানতো। তাঁরাই সেই প্রাকৃতিক ব্রিজ এর ওপর পাথর দিয়ে কৃত্রিম ব্রিজ তৈরী করেন এবং অতর্কিতে লঙ্কা আক্রমণ করেন। রাবণ ,মেঘনাদ,কুম্ভকর্ণ নিহত হন। বিশ্রবার মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র ও কন্যা লঙ্কা পাড়ি দেন। রাবণের কনিষ্ট ভ্রাতা বিভীষণ রাবণের মত সুপণ্ডিত ও জ্ঞানী না হলেও সৎ ও সরল ছিলেন।
তাঁর সাহায্যেই সীতা উদ্ধার হয়। সীতা হরণ করলেও রাবণ যথোপযুক্ত সন্মান দিয়েই সীতা অশোক বনে রেখেছিলেন। এরপর রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ অযোধ্যায় ফিরে আসেন। সীতার অগ্নি পরীক্ষা,সীতাকে রামের ত্যাগ,বাল্মীকির আশ্রমে গমন ,ওখানে লব কুশের জন্ম - এগুলো পরবর্তী কালের সংযোজন।
হনুমানের লঙ্কা দহন কাণ্ডটি বাল্মীকি বা অন্য কারো কল্পনা কিনা বলতে পারবো না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি,কাহিনীটি র যিনি প্রবক্তা ,ঋষি চ্যবন ,তিনি দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন। সে সময় তিনি অতি বৃদ্ধ ছিলেন।
এখানে একটা কথা বলতে চাই, অনেক পণ্ডিতের মতে মহাভারত পূর্বে রচিত এবং রামায়ণ পরে। কথাটা একশো ভাগ খাঁটি। কারণ মহাভারত রচয়িতা ব্যাস দেব মহাভারতের চরিত্র,কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণের চরিত্র নন। তিনি একটি প্রচলিত ঘটনা বা কাহিনী কে কাব্যে রূপান্তরিত করেন ।।।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................