সংস্কৃতির গুরুঠাকুররা কিন্তু আঁটকে ছিলো চন্ডীমন্ডপেই।

#কোনটা_সংস্কৃতি

শ্রীচৈতন্যদেব যখন প্রথম ধর্মীয় মিছিল ( আসলে রাজনৈতিক‚ পরে এই নিয়ে লেখালেখি হবে ) শুরু করেন তখন কিছু মানুষ মহা হৈচৈ করেছিলো এটা আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে। না মু.সলিম শাসকদের কথা বলছি না। তারা রাজনৈতিক ভয় পেয়েছিলো‚  মিছিল নিষিদ্ধ করেছিলো‚ সেসব অন্য প্রসঙ্গ।  কিন্তু হিন্দুদের মধ্যেও গূহ্যতান্ত্রিক অর্থাৎ শাক্তরা এটা ভালো ভাবে দেখেনি। জগাই মাধাই আক্রমণ করেছে বৈষ্ণবদের‚ চৈতন্যও এদের পালটা শিবির বদল করিয়ে নেয়। বাট সেসব অন্য কথা। মোদ্দা কথা হলো এই যে ইহা বাঙ্গালী সংস্কৃতি নয় জাতীয় কান্নাকাটি তখন উঠেছিলো।

বিবেকানন্দ আমেরিকা যাবেন। লক্ষ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও মিশনারীদের ভারত বিরোধী প্রোপাগান্ডা ভেঙ্গে হিন্দু ধর্মের আসল চেহারা সবার সামনে তুলে ধরা। তিনি যখন সমুদ্র পার হন তখনও কিন্তু একদল মানুষ চেঁচিয়েছিলো এটা আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে। (ব্রিজি মেডোজকে লেখা চিঠি। ২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩)
বিবেকানন্দ সেসব উপেক্ষা করেই আমেরিকা পৌঁছান‚ হিন্দুত্বের জয় পতাকা তুলে ধরেন। সংস্কৃতির গুরুঠাকুররা কিন্তু আঁটকে ছিলো চন্ডীমন্ডপেই।

ঋষি অরবিন্দের নেতৃত্বে যখন বাঙ্গালীরা ভিক্ষাবৃত্তির রাজনীতি ছেড়ে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিলো স্বাধীনতা আদায়ের জন্যে‚ কালীমূর্তির সামনে গীতা হাতে শপথ নিতো দেশের স্বাধীনতা আনার‚ তখনও একদল মানুষ চেঁচিয়েছিলো এটা আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে। কংগ্রেসের (প্রধানত বাঙ্গালীদের) চরমপন্থী - নরমপন্থী বিচ্ছেদ‚ সুরাট দ্বন্দ্ব - এসব তো ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই জানেন।
ইহা আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে রব সেদিনও উঠেছিলো।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন রাম মন্দিরের দাবিতে আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিলো‚ বাঙ্গালীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো জাতির অষ্মিতা পুনরুদ্ধারের জন্যে‚ তখনও প্রচুর শেয়ালের হুক্কাহুয়া উঠেছিলো ইহা আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে। আগে চান্স পেয়ে দেখা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের মধ্যে একজন স্বয়ংসেবককে মেরে আধমরা করে দিয়েছিলো সেদিনের বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধামাধারীরা। যে‚ এটা পশ্চিমবঙ্গ!  এখানে শাসক দলের হাতে বিজন সেতুতে হিন্দু সন্ন্যাসীদের পুড়িয়ে মারা হয়। আর এখানেই মন্দিরের জন্যে আন্দোলন? এটা তো আমাদের সংস্কৃতি নয়।

বিদ্যাসাগর বললেন বিধবা বিবাহ দেওয়া উচিৎ। বিবেকানন্দ তো আরও একধাপ উপরে উঠে জানিয়ে দিলেন মেয়েদের ভালো মন্দ মেয়েদেরই ঠিক করতে দাও‚ পুরুষের সেখানে নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই ( আমি কি বেধবা? দ্রস্টব্য) সেদিনও কিন্তু কিছু সংস্কৃতির গুরুঠাকুররা চেঁচিয়ে উঠেছিলো বিধবা বিবাহ আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে। 

এই কদিন আগের ঘটনা। দেশভাগের সময় থেকে  সম্ভবত এই প্রথম বাংলাদেশের হিন্দুদের মুখে পালটা গর্জন শোনা গিয়েছিলো। কুরুক্ষেত্রের হাতিয়ার‚ গর্জে উঠুক আরেকবার বলে।  দেখেছেন নিশ্চয়ই সবাই ভিডিওটা। তখনও প্রচুর হিন্দু (দুই পারেরই) চেঁচামেচি জুড়েছিলো এইভাবে স্লোগান দেওয়া আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে।  তাইতো‚ বাঙ্গালী হিন্দুরা মার খাবে‚ কাঁদবে‚ হয়তো বা নালিশ করবে আবার ভুলেও যাবে‚ এটাই তো আমাদের সংস্কৃতি! কিন্তু পালটা যুদ্ধের আহ্বান? ছ্যা ছ্যা! এটা তো আমাদের সংস্কৃতি নয়।

মহারাজা প্রতাপ আদিত্য স্বপ্ন দেখলেন মুঘল শাসন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের! স্বাধীন বাঙ্গালী সাম্রাজ্যের! চলতে লাগলো যশোহর তথা সমগ্র বাংলা জুড়ে পুরোদস্তুর সামরিক তৎপরতা! ইতিহাস সাক্ষী সেদিনও বসন্ত রায় ও তার অনুগামীরা হৈহল্লা জুড়ে দিয়েছিলো স্বাধীনতা ও স্বাধীন সামরিক অস্তিত্ব বাঙ্গালীর সংস্কৃতি নয় বলে। 

ইতিহাস খুঁজলে এমন বহু বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে। বাঙ্গালী জাতির মধ্যে যখনই কোনো গতিশীলতা আনার চেষ্টা হয়েছে‚ জড়তা ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছে‚ তখনই একদল গুরুঠাকুর সেজে চিল চিৎকার জুড়ে  দিয়েছে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্যে। মান ইয়া না মান‚ ম্যায় তেরা মেহমান।   তারাই ঠিক করে দেবে কোনটা আমাদের সংস্কৃতি! আর কোনটা নয়। অথচ তাদের নিজেদের যোগ্যতা কি? কেউ জানেনা।

এই যে বর্তমানে ইহা বাঙ্গালী সংস্কৃতি নয় বলে যে হুজুগ উঠেছে‚ কখন বজরঙ্গবলী পুজোর বিরুদ্ধে ( স্বয়ং বিবেকানন্দ নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন বজংবলী পুজোর) কখনো রাম নবমী পালনের বিরুদ্ধে‚ কখনো অস্ত্র মিছিলের বিরুদ্ধে তো কখনো আবার বাঙ্গালী হিন্দুর ধর্মীয় আত্মসচেতনতার বিরুদ্ধে! 
এগুলো আর কিছুই না‚ সেই চিরাচরিত গুরুঠাকুর আর চন্ডীমন্ডপ কালচারেরই আপডেটেড ভার্সান মাত্র।

বাঙ্গালী যে ম্যাদামারা সিভিলিয়ান জাতির ঔপনিবেশিক তকমা ঝেড়ে ফেলে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে‚ রেজিমেন্টেড হচ্ছে‚ আত্ম সচেতন হচ্ছে - এই নতুন নবজাগরণকেই মেনে নিতে পাচ্ছে না এইসব গুরু ঠাকুরেরা। ঠিক যেভাবে একদিন মেনে নেয়নি চৈতন্য আন্দোলনকে‚ বিবেকানন্দের প্রসার-প্রচেষ্টাকে‚ বিদ্যাসাগর - রামমোহনের সংস্কারকে কিংবা প্রতাপ আদিত্যের স্বাধীন যুদ্ধকে।

সব সময়ই নতুন সমাজ তৈরী হতে শুরু করলেই ভয় পেয়েছে জড়তাগ্রস্থ প্রাচীনতন্ত্রের ধারক বাহকরা। ভয় পেয়েছে আগামী সমাজে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের! আর তাই প্রতিবার তারা মৃত্যুকালীন আর্তনাদ করেছে এই পরিবর্তন আমাদের সংস্কৃতি নয় বলে।

আর এখনো সেইজন্যেই এত হৈচৈ - সেই জন্যই এত আগ বাড়িয়ে সংস্কৃতির ঠিকাদারি নেওয়া‚ সেই জন্যেই আমাদের এত আক্রমণ! 

কিন্তু আমরা তো জানিই -

আমরা চলি সমুখপানে,
     কে আমাদের বাঁধবে।
রইল যারা পিছুর টানে
     কাঁদবে তারা কাঁদবে। :-)

✍️ :  সৌভিক দত্ত

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted