আগে আমরা ইতিহাস বলতে বুঝতাম শুধু লিখিত রাজা বাদশাহদের ইতিহাস, কোন সম্রাট কত সালে কত রাজ্য জিতেছিল, কোন ফেরাউন কোথায় হেরেছিল, বা কোন আবিষ্কারক বা কোন বিজেতা জাতি কোন দেশ বা মহাদেশ আবিষ্কার করে তার অধিবাসীদের ‘সভ্য’ বানিয়েছিল। আমরা, মানুষেরা আগে উদ্বেল ছিলাম আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। প্রকৃতিতে আমাদের প্রজাতির অকল্পনীয় সফলতা দেখে ভেবেছিলাম যে মানুষ কোন এক বিশেষ সৃষ্টি, আমরা কোনভাবেই বাকি প্রাণীজগতের মিছিলের অংশ হতে পারি না – নিশ্চয়ই আমাদেরকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি করা হয়েছে প্রকৃতির সব কিছু। আবার এক ধাপ এগিয়ে সব জাতি, বিশেষ করে সব বিজেতা গোষ্ঠীই বা গোষ্ঠীর একাংশ নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বলে দাবি করেছে। সৃষ্টি হয়েছে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণিভেদ। গ্রিকরা ভাবতো তারাই একমাত্র ‘সভ্য’ জাতি, তাদের আশেপাশের সবাই ‘বর্বর’। তবে শুধু গ্রীকরাই নয়, আরব, চাইনিজ সভ্যতার মত ‘গৌরবের অভ্রভেদী শিখরে ওঠা’ সব ‘সভ্যতাই’ কম বেশি এভাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছে।
সাধারণত যেকোন সময়ের লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতেই সমাজ এবং সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে, সেই সাথে বদলায় তার নৈতিকতার সংজ্ঞা এবং সঠিক বেঠিকের মানদণ্ড। আজকে আমাদের সম্মিলিত জ্ঞান, সচেতনতা এবং উৎপাদন ব্যবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা সম্ভবত প্রথমবারের মত আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে ধর্ম, অধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, জেন্ডার, লিঙ্গের সমানাধিকার দাবি করতে শুরু করেছি। দিল্লি এখনো বহুদূর হলেও সমানাধিকারের অভিমুখে মানবজাতির যাত্রা যখন একবার শুরু হয়েছে গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও হয়তো ততটা অসম্ভব নয়, সেটা অদূর ভবিষ্যৎ বা সুদূর ভবিষ্যৎ যখনি হোক না কেন।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এরকম একটা সমন্বিত উপাখ্যানের মাধ্যমে একটি সংস্কৃতির গোটা অস্তিত্ব এবং মননের মানদণ্ড তৈরির কাজটা আমরা সব যুগেই করে এসেছি, মিথ বা পুরাণ, বিশেষ করে সৃষ্টিপুরাণের মাধ্যমে। মিথ আমার খুব প্রিয় বিষয়। ছোট্টবেলায় প্রাচীন গ্রিক, মিশরীয়, ভারতীয়, ইব্রাহিমীয় উপাখ্যানগুলো পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে যেতাম। বড় হয়ে বুঝেছি বিজ্ঞান এবং দর্শন যেমন আমাদের গল্প বলে, শিল্প সাহিত্য গান যেমন গল্প শোনায়, ঠিক তেমনি মিথও আমাদের জীবনেরই গল্প শোনায়।
আমার মনে হয়েছে আমাদের যাত্রাপথটাকে বোঝার জন্য যে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী দরকার । সেটা হলো কোন কিছুই ফেলনা নয়। ভুল হোক, শুদ্ধ হোক আমাদের অতীতের প্রতিটি পদক্ষেপরই গুরুত্ব আছে। অতীতকে না জানলে বর্তমান এবং ভবিষ্যত কোনটাই ঠিকমতো জানা হয় না। আবার খোলামন নিয়ে জানার চেষ্টা না করলে অতীতের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে হবে – যার কুফল আমরা অহরহই দেখতে পাই।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................