পূর্ববঙ্গ থেকে রিফিউজি হয়ে আসা বাঙালী শিক্ষিত হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রবলভাবে সেক্যুলার, কমিউনিস্ট হয়ে পড়ল। মুসলিম লীগের গুন্ডাদের হাতে প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে আসা বাঙালী হিন্দু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কেঁদে বুক ভাসালো। আমার মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড মন কিছুতে বুঝতে পারে না কেমন করে তারা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য এতটা আবেগ ধরে রেখেছিলো?

মাপ করবেন লিবারালগণ, জন্মাবধি বাংলাদেশের মুসলিম বাম, সেক্যুলার সকলের কাছেই শুনে এসেছি হিন্দু উচ্চজাতের অত্যাচার গোলামী আজো জারি থাকত যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হত। আর এই বাংলাদেশ কি করে জন্ম হত যদি পাকিস্তান না হত? কাজেই দ্বিজাতিতত্ত্বকে মাথার পিছন দিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়ার মত করে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বছরখানেক আগে বামপন্থি এক গল্পকারের সঙ্গে দেশভাগ নিয়ে তুমুল তর্ক হলো। তিনি বাংলাদেশের মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ডের একজন বামপন্থী সাহিত্যিক, ভারতের আনন্দ পুরস্কার পাওয়া সাম্রাজ্যবাদী ভারত বিরোধী প্লাস হিন্দু দাদাবাবুদের বলয়মুক্ত বাংলাদেশপন্থি। এত কথা বলছি কেন ভাবছেন তো? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বাংলাদেশের পাবনার মানুষ ছিলেন। তিনি যেভাবে বাংলাদেশের জন্য গান বেধেছিলেন সেভাবে কি সেই বামপন্থি বাংলাদেশী গল্পকার পারতেন যদি তিনি সেভাবে দেশত্যাগ করতেন? ঋতৃক ঘটকের মত করে কি জহির রায়হান শরণার্থীদের জন্য রাস্তায় রাস্তায় টাকা তুলতেন? রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশে যেভাবে টাকা উঠেছে, কাপড়চোপড় জোগার হয়েছে সেটার সঙ্গে কেবলমাত্র ৭১-এর কোলকাতার তুলনা চলে। কিন্তু রোহিঙ্গারা মুসলমান না হলে কি বাংলাদেশীদের এত আবেগ থাকত?

জামাত ইসলামের অঘোষিত ফেইসবুক পেইজের নাম ‘বাঁশের কেল্লা’। এ সেই তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। ওহাবীদের হয়ে ওকালাতী করে কমিউনিস্টরা। তিতুমীর মুসলমান জমিদারকেও হামলা করেছে! আবার তাকে হিন্দু জমিদারও সমর্থন করেছে। তিতুমীর তাই খিলাফতের জন্য জিহাদ চালায়নি, সে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী! তিতুমীর সফল হলে সে কৃষকদের অধিকার ফিরিয়ে সমতা আনত। ইংরেজ শাসনের অবসান করে দেশীয় শাসন জারি করত। তাহলে আজকে ভারতকে ইসলামিক শাসনে এনে যদি কেউ ‘ইনসাফ’ আর ‘সুশাসন’ এনে দেয়ার গ্যারান্টি দেন সেটাকেও আমাদের লিবারাল চোখে দেখা উচিত? মনে করুন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শাসনের চাইতে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা গদিনসিন হলে কোন আপত্তি নেই? যতদিন ইয়াসির আরাফাতের পিএলও ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বে ছিলো ততদিন ফিলিস্তিনীদের স্বাধীন রাষ্ট্রে সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জারি রেখেছি। এখানো মনে করি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হোক ইজরাইলের প্রতিবেশী হয়ে। কিন্তু এখন যারা ফিলিস্তিনী আন্দোলনকে লিড দিচ্ছে ‘হিযবুল্লাহ’ ’ইসলামিক পার্টি’ তাদের প্রতি সমর্থন আর স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র চাওয়া কি এক? তালেবানী শাসিত আফগানিস্থান কিংবা আইএস শাসিত সিরিয়ার মত ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রকে সমর্থন করাকে কি কমিউনিস্টদের কিতাবে প্রলেতরিয়েতদের প্রতি সমর্থন বুঝায়?

চারদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের দেখতে পাওয়া আর যাকে তাকে ‘চাড্ডি’ দাগিয়ে দেয়া এক ধরণের কাল্ট অসুখ। কমিউনিস্ট পার্টির অফিসগুলোতে গেলে আগে দেখতাম মাও, লেলিন, গ্রামসি ইত্যাদি ফটোতে ভরা। সোভিয়েত আমলে এরা রাশিয়া ভ্রমণ করে রীতিমত তীর্থ ভ্রমণের মত অনুভূতি পেতো। কমিউনিস্টরা এই দেশে একদম ধর্মের মত করে পার্টি করে। এই পরিসরেই জন্ম নেয় কাল্টের। এখানেই মৌলবাদের আতুরঘর। তিতুমীরকে জামাত হেফাজত ফুরফুরা শরীফ নিজেদের লোক হিসেবে চিনলেও হিন্দু লিবারালদের আরো সময় লাগবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মত কট্টর হিন্দুত্ববাদ জেঁকে বসবে কারণ আগামীতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম লীগের প্রেতাত্মা ফুরফুরা শরীফের না হয় আসাদউদ্দিন ওয়াসিসের শরীরে নতুন জীবন লাভ করবে। মানুষ প্রশ্ন করবে যদি কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা সুশাসন দেয়, ন্যায় বিচার, জনগণের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করে দেয় তাহলে গোটা ভারত কট্টর হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে পরলে সমস্যা কি যদি ইসলামিক শাসনে ‘ইনসাফ’ প্রতিষ্ঠা হলে, কৃষক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলে দোষ নাই-ই থাকে? মুসলিম লীগ তো ধর্মীয় পার্টি ছিলো না। তারা কেবল বলত মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে থেকে বঞ্চিত। তাদের সুরক্ষার জন্যই চাই নিজেদের শাসন। মুসলিম লীগ তো হিন্দুদেরও সমর্থন পেয়েছিলো! নিন্মবর্ণের হিন্দুদের পুরো সমর্থন পেয়ে পাকিস্তান দাবী সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিলো। তফসিলি সম্প্রদায় বলেছিলেন কথিত উচু জাতের হিন্দুদের অধিনে থাকার চাইতে মুসলমানদের অধিনে থাকলে তারা ন্যায় বিচার সাম্য সুরক্ষা সবই পাবে। তিতুমীরের দলে হিন্দু ফাইটার থাকা, কিংবা জমিদারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ গরীব হিন্দুরা যদি তিতুমিরের জমিদার বিরোধীতায় সমর্থন জানায় তো মুসলিম লীগকে সমর্থন করা হিন্দুদের ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকার পর এখন নিশ্চয় পাকিস্তান আইডলোজিকেও আমাদের সমর্থন করা উচিত?

ভারতের কমিউনিস্টদের সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে হতাশা লাগছে। কেরালাতে যেহারে শিক্ষিত মুসলমানদের আইএসে যোগদানের ঘটনা ঘটল, যেহারে সেখানে মুসলমানরা মুসলিম জাতীয়তাবাদে উজ্জ্বিত হচ্ছে তাদের শাসনামলে, তাতে কেরালার হিন্দু খ্রিস্টানরা যদি কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের উপর ঈমান আনতে শুরু করে? পশ্চিমবঙ্গে তাদের স্বাধের ৩০ পার্সেন্ট মুসলিম ভোট আর দিদি দাদা কেউ পাবেন না- সেটা যে ভাইজানরাই পাচ্ছেন তাতে আর কোন সন্দেহ আছে? ফুরফুরা শরীফ না হয় আসাদউদ্দিন- মুসলিম লীগের এই নতুন দুত ভারতের মুসলিম ভোটকে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় নিয়ে গিয়ে তুললে কমিউনিস্টদের কি আপত্তি থাকা উচিত? কারণ ফুরফুরা শরীফের আব্বাস সিদ্দিকী আর আসাদউদ্দিন দুজনই ভারতীয় দলিত হিন্দুদেরও ভাইজান! দুজনই হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে! দুজনই প্রলিতরিয়েতদের নেতা! আর কি লাগে দাদা?

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted