শেষ ট্রেনের যাত্রী
.......................................................
রাতের শেষ ট্রেন ছিলো। স্টেশন খেকে ছাড়ার সময় দরজা অব্দি লোক বাদুর ঝোলা ঝুলছিলো। পাঁচটা স্টেশন পেরিয়ে এসে এখন ট্রেনটা প্রায় ফাঁকা। অফিস ফেরত লোকগুলোর চোখেমুখে ক্লান্তি আর বাড়ি ফেরার ক্লেশে ক্লিষ্ট। শেষ স্টেশনের আগের স্টেশনে আসার পর ১৩ নম্বর কম্পারমেন্টে একটা বস্তা উঠল। এটাই লাস্ট কম্পারমেন্ট। অন্যসময় হলে লোকজন হৈ হৈ করে উঠত, মালের বগিতে তোলো, এখানে কেন! এখন কেউ কিচ্ছু বলছে না। মোটে তো আর পনেরো মিনিটের পথ। ঝগড়া করার মত শক্তি বা ইচ্ছা কারুর ছিলো না।
এ হচ্ছে রোজকার চিত্র। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে এরা রাজধানীতে চাকরি করতে যায়। রোজ সকাল আর সন্ধ্যায় ট্রেনে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য, আরামে সিটে বসে যাবার জন্য এরা রীতিমত মল্লযুদ্ধ করে থাকে। সারাদিন অফিসে বিধস্থ আর ক্লান্ত মানুষগুলো তাদের স্বার্থপরতা আর পরস্পরকে শত্রু জ্ঞান করে এখন এই বাড়ি ফেরার শেষ মুহূর্তে যে যার মত করে চুপ করে বসে আছে। এই কামড়াটা এখন প্রায় শূন্য, মোটে চারজন যাত্রী। ট্রেনটা তার নির্ধারিত বিরতি মেনে লাস্ট স্টেশনে যাবার জন্য চলতে শুরু করেছে।
সিটের মাঝখানে হাঁটাচলার জায়গায় রাখা বস্তাটা প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। একজন ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে বস্তায় কি রাখা হয়েছে সন্দেহ করতে দেখে প্লাস্টিকের বস্তায় এখানে সেখানে ছেঁড়া ফাড়া দিয়ে পাঁচশ আর হাজার টাকার নোট বেরিয়ে আছে! টান দিতেই এক তাড়া নোট বেরিয়ে এলো!
এ কার টাকা? ফিসফিস কন্ঠের ভীতভাবে বলল একজন কেরানি!
সবাই যেন একসঙ্গে এবার বস্তার বিষয়টা দেখতে পেয়েছে। হ্যাঁ, টাকা ভর্তি বস্তা! বস্তাটা কে যেন টেনে হেঁচড়ে তুলল? কেউ মনে করতে পারছে না। বয়েসে তরুণ রুক্ষ্ণ চেহারার দেখলেই মনে হয় কোন অফিসের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ, সে তার অফিসিয়াল ব্যাগ খুলে বস্তার ছেঁড়া দিয়ে টেনে টাকার তাড়া বের করে ভরতে লাগল। কচকচে নতুন নাট। অদ্ভূত হচ্ছে নোটগুলো বান্ডিল করা নয়। যেন বাতাসে উড়ছিলো কেউ ধরে ধরে বস্তায় ভরেছে।
এই কি করছো ছোকরা? মাথা খারাপ নাকি? বয়স্ক কোট প্যান্ট টাই পরা অফিসার চেহারা লোকটি বলল যুবকটিকে।
আপনিও নেন না? চেঁচাচ্ছেন কেন?
কেরানি লোকটি হাতে বাজারের একটা খালি কাপড়ের থলে ছিলো। স্টেশনের কাছেই কাঁচা বাজার। সেখান থেকে তরকারি কেনার কথা ছিলো। এখন সেই থলেতে সে কচকচে সব নোট ভরতে লাগল।
ফর্সা কেতাদুরস্ত দেখতে একজন বলল, প্লিজ, আমার একটা কথা শুনেন, আমরা যদি ডিসিপ্লিন মেনে চলি তাহলে এই পুরো টাকা আমাদেরই হবে এবং সমান ভাগ করে নিতে পারব। এখন শুধু দরকার আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখা আর স্টেশনে ট্রেন থামার পর বস্তাটাকে নিরাপদে নামিয়ে নেয়া।
ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করায় সবাই সবাইকে মোটামুটি চেনে। অন্তত কে কোন অফিসে জব করে কথায় কথায় জানা হয়ে যায়। কেদাদুরস্ত লোকটি একটা বিদেশী ফার্মে জব করে। মাইনে ভালো। ভদ্র আর সুরুচির। বসার জায়গা নিয়ে সে কখনো ঝগড়া করে না। কারোর সঙ্গে তার কখনো কথা কাটাকাটি হয়নি। তবে এক ধরণের শ্রেণী সচেতনতা বজায় রেখে সে ট্রেনে সবার মধ্যে থেকেও যেন আলাদা। আজ সে কথা বলায় সবার মধ্যেই একটা প্রভাব পড়ল। অভিজাতদের প্রতি মানুষের সহজ যে আনুগত্যতা।
বয়স্ক অফিসারটি চিন্তিত মুখে বলল, স্পষ্ট মনে আছে, বস্তাটা যখন উঠেছে তখন বস্তার মধ্যে প্রেসের কাটা কাগজ দেখেছি। বস্তা ফুড়ে বেরিয়ে ছিলো কাটা সব কাগজ।
কেরানিও বলল সেও দেখেছে বাতিল কাগজের বস্তা। কিন্তু কেউ কি দেখেছে বস্তাটি কে এনে রেখেছে?
কেউ মনে করতে পারল না। স্টেশনের আলো ছায়া অন্ধকারে লোকটির মুখ কেউ মনে রাখেনি। সে কখন নেমে পড়েছে সেটাও কেউ খেয়াল করেনি।
বাতিল কাগজ তাহলে টাকা হয়ে গেছে! অলৌকিক নাকি? কেতাদুরস্ত বলল।
বয়স্ক অফিসার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি না। তবে সেটা না ধরেই আমাদের এগুতে হবে। এত টাকা বস্তায় এই রাতে ট্রেনে- নিশ্চিত ব্লাক মানি।
সেই জন্যই এটা আমাদের! নীতিকথা এখানে খাটবে না! রুক্ষ মেজাজের যুবকটি বলল।
নীতিকথা বলছি না। এই টাকা নিয়ে কি হজম করতে পারবেন? আমার বয়স হয়েছে। জীবনে অনেক দেখেছি। তাই বলছিলাম… বয়স্ক অফিসারটি থেমে গেলো, সবার মুখের কথা পড়ার চেষ্টা করল।
আপনি কি করতে চান বলুন তো? কেতাদুরস্ত লোকটি বলল।
শুনুন, আমি ব্যাংকে চাকরি করেছি। টাকা চেক করে দেখেছি একদম আসল নোট তবে কোন ব্যাংক থেকে এটা আসেনি।
তার মানে? কেদাদুরস্ত লোকটি বলল। সবাই চেয়ে রইল বয়স্ক অফিসারটির দিকে।
তার মানে হচ্ছে নোটগুলো অন্য কোথাও ছাপানো হয়েছে কিন্তু কোন ভেজাল নেই!
মাফিয়া! টাকাটা কোথাও চালান হচ্ছে? কেতাদুরস্ত ফিসফিস করে বলল।
সে জন্যই বললাম হজম করতে পারবেন তো?
রুক্ষ যুবকটি চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল, এই টাকায় হাত দিলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে! বস্তায় যা আছে তার জন্য দাবী নাই। কিন্তু এটা আমি জান থাকতে দিবো না! নিজের ব্যাগ দেখিয়ে বলল সে।
বয়স্ক লোকটি বলল, আমরা সবাই তো যার যার ব্যাগে নিজেদের মত করে টাকা নিয়েছি। আমার মনে হয় বস্তার আশা বাদ দিয়ে আমাদের যার যার মত নেমে পড়া উচিত।
কেরানি বলল, স্যারের কথাই ঠিক। বেশি লোভ করার দরকার নাই। যা পাইছি তাতেই শুকর! কেউ কিছু বুঝার আগেই আসেন নেমে পড়ি।
কেতাদুরস্ত লোকটি বলল, বেশ, তাহলে এটাই ঠিক হলো। তবে আপনারা যখন বস্তার উপর নিজেদের দাবী ছেড়ে দিচ্ছেন আমি সেই রিস্কটা নিতে চাই। আমি বস্তাটা নিতে চাই। আপনারা নেমে পড়বেন। আমি বস্তাটা দেখছি।
বয়স্ক অফিসার লোকটি বলল, দেখুন সাহেব, আমি কিন্তু আপনাকে চিনি। আপনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাইনে পান। একটু বেশি লোভ করে কি বেশি রিস্ক নিচ্ছেন না?
কেতাদুরস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাইরে থেকে আমাকে তেমন দেখা গেলেও আমি তা নই। আগামি মাসের মধ্যে দুই কোটি টাকা আমাকে অফিসের একাউন্টে জমা দিতে হবে। আইপিএলে জুয়া ধরে অফিসের দুই কোটি টাকা খুইয়েছি। অফিসের কেউ কিচ্ছু জানে না। কিন্তু দুইদিন পরেই সেটা আর গোপন রাখা যাবে না। আমাকে জেলে দিবে ওরা। এই টাকাটা যেন আমার জন্যই রাতের ট্রেনে এনে কেউ ফেলেছে!
আপনারা ভালো চাকরি করবেন, ভালো থাকবেন, আর জুয়া খেলে ফূর্তি করে টাকা উড়াবেন আর আমরা সেই দেনা শোধ করব- বাহ্! রুক্ষ যুবকটি ক্রুর হেসে বলল।
কেতাদুরস্ত অবাক হয়ে বলল, মানে?
বস্তার দাবী যে সবাই ছেড়ে দিয়েছে সেটা আপনাকে কে বলল?
কেতাদুরস্ত মাথা ঝাঁকালো। অলরাইট। আমি মোকাবিলা করতে চাই। টাকাটা আমার প্রয়োজন। যেমন করেই হোক সেটা আমারই বেশি প্রয়োজন। আমি লড়তে চাই।
বয়স্ক অফিসারটি বলল, দেখুন, টাকা সবারই প্রয়োজন এবং সবাই মনে করে তার প্রয়োজনটিই শ্রেষ্ঠ। বাকীদেরটা গৌণ।
কেতাদুরস্ত বক্র হাসি দিয়ে বলল, আপনিও মত পাল্টাচ্ছেন নাকি সাহেব?
না, না। আমি সেটা বলছি না। আমার মনে হয় আমরা বিষয়টা জটিল করলে সবাই বিপদে পড়ব। তারচেয়ে সুবিধা মত আমাদের সটকে পড়া উচিত। দেখুন, টাকা আমারও প্রয়োজন।আমার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। সংসারে কেবল আমরা দুটি মানুষ। তাকে বিদেশে চিকিৎসা করতে নিয়ে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার। আমার অফিসে লোন তোলার কোন সিস্টেম নেই। তাছাড়া এটা কোন গুড জব নয়। বুড়ো বয়েসে একটা কাজ জোটেতে হয়েছে। রোজ এই রকম ট্রেন জার্নি করতে হয় অবস্থা নিশ্চয় ভালো হলে নয়। ব্যাংকে চাকরি করেছি। রিটায়ার্ড করার পর একটা ফার্মের কাজ নিতে হয়েছে। চাকরি জীবনের সমস্ত টাকা লাগানো ছিলো শেয়ার বাজারে। সেই টাকা তো এক ধসেই সাদা কাগজ হয়ে গেছে! এখন স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে হবে। জীবনে রাস্তাঘাটে টাকা পড়ে থাকলেও ফিরে চাইনি। আর আজ কাঙালের মত টাকা কুড়ালাম আর ব্যাগে ভরলাম!
রুক্ষ চেহারা যুবকটি এবার শান্তভাবে বলল, বেতনের টাকাটা মাস শেষে হিসেব করে সংসারে দিতে দিতে দেখি হাতে মাস চলার মত টাকাও আমার হাতে নেই। এবছর বন্ধুরা সবাই বেড়াতে গেলো পাহাড়ে। আমি যেতে পারিনি। কারণ আমার সংসারে ভাতের টান! আমার পয়সায় আর নিজের ছোট ভাইবোনদের টিউশানির টাকায় আমাদের সংসার চলে। আমি জানি এভাবেই আমাকে চলতে হবে। এর থেকে মুক্তি নেই। এভাবেই মাস শেষে টানাটানি চলতে চলতে বুড়ো হয়ে যাবো! আজ ট্রেনে যদি আমাকে সেই জাল ছিন্ন করার একটা সুযোগ এসেই যায় তাহলে কেন রিস্ক নিবো না?
কেরানি অভিযোগের মত করে বলল, আমি আপনাগো সবার চাইতে ছোট চাকরি করি। বড় মাইয়াটারে বিয়া দিছিলাম। জামাই ভালো পড়ে নাই। অখন বাপের ঘরে ফেরত আসছে। পোলাটা বিদেশে যেতে চায়। টাকাকড়ি তো কিছু নাই। অখন নেশা ধরছে। নুন আনতে পান্তা ফুড়ায়। পোলাপান সব মিলাইয়া চারজন। আমরা জামাই বউ দুইজন মিইল্লা নুন ভাত খাওয়াই কঠিন। আমারও তো মন চায় জীবনটা বদলাই ফেলি! সুযোগ যখন আসছে ছাড়মু ক্যান?
বয়স্ক অফিসারটি এবার কেতাদুস্তের দিকে চেয়ে শান্ত ভদ্রভাবে বলল, দেখেছেন, এখন কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার প্রয়োজনটিই সবচেয়ে লঘু।
কি করতে চান আপনারা? কেতাদুরস্ত টেনে টেনে কথাগুলো বলল।
আমরা চাই কেউ যাতে কোন রিস্কে না পড়ি তাই চুপচাপ নেমে পড়ব। বস্তার ঝামেলায় না গেলাম।
এই টাকায় আমার কিছুই হবে না! রুক্ষ চেহারার যুবক ফুঁসে উঠল যেন।
সবাই অবাক হলো। কিন্তু চমকালো না। আশ্চর্য যে তার কথাতে বাকীদেরও এখন মনে হতে লাগল- এত অল্প টাকায় তাদের কিছুই হবে না! পুরো বস্তার টাকাটা না পেলে তাদের এ জীবনের অভাব মেটার নয়।
কেরানি ট্রেনের জানালার বাইরে মাথা বের করে কিছু দেখছিলো। সে আতংকিত মুখে ফিরে এসে বলল, তাজ্জব ব্যাপার! ট্রেন তো স্টেশনের আশেপাশেও নাই! বাইরে কিচ্ছু চিনি না! জঙ্গলের মধ্যে দিয়া ট্রেন চলতাছে!
অবিশ্বাসের ভুরু কুচকে রুক্ষ যুবকটি তার সামনের জানালায় দিয়ে বাইরে চেয়ে তারও মুখের রেখা টানটান হয়ে গেলো। বাপরে! এটা কোথায় এসে পড়েছি?
বিস্ময়ে কারোর মুখে কথা নেই। ট্রেন চলছে এমন একটা নির্জন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে, এটা কোথায়, কেউই ঠাওড় করতে পারল না।
মাফিয়ারা মনে হয় ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। বয়স্ক অফিসার বিস্ময়ে বলল।
ওরা টাকাটার জন্য ট্রেন হাইজ্যাক করেছে। এখন ট্রেন থামিয়ে কামড়ায় আসবে আর আমাদের সব ক’টাকে গুলি করে মারবে। ভালোই হবে! মরে গেলে এক প্রকার বেঁচেই যাবো… কেতাদুরস্ত বলল।
কেরানি আফসোস করে বলতে লাগল, আপনাদের প্যাঁচাল শুনতে গিয়াই আমার ফাডা কপাল ফাডাই থাকল। তখন যদি নাইমা পড়তাম…!
রুক্ষ যুবকটি বয়স্ক অফিসারের দিকে চেয়ে বলল, মাফিয়া মাফিয়া করছেন তখন থেকে, আপনিই সেই মাফিয়া! এই টাকা আপনিই নিয়ে যাচ্ছেন। এতক্ষণ আমাদের নিয়ে মুশকরা করলেন তাই না? আমরা পাগলের মত টাকা ব্যাগে সরালাম সেটা খুব মজা করে দেখেছেন!
বয়স্ক অফিসার হাসল। কিছু বলল না। অন্ধকারে তার হাসির মানে বুঝা গেলো না।
হঠাৎ সবার মনে হলো ট্রেন থেমে গেছে। সুনসান নিরব একটা প্লাটফর্ম। প্লাটফর্মের দুইপাশে ধূ ধূ প্রান্তরের শেষে ঘন বনের আভাস। এটা কোন দেশ? নাকি অন্য কোন পৃথিবী? কামড়ার দরজার সামনে বাইরে হাসিমুখে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে তাকে বলে না দিলেও মনে হয় স্টেশন মাস্টার।
সুস্বাগতম যাত্রীরা! ভালো মানুষের মত দেখতে সুদর্শন মাঝ বয়েসী স্টেশন মাস্টারটি তাদের উদ্দেশ্যেই যেন এই মাঝরাত্রীরে স্টেশনে অপেক্ষা করে ছিলো। চারজন যাত্রীর বিহ্ববল চাউহিতে যেন তিনি কিছুটা কৌতুক অনুভব করছেন।
আমার কোথায় এসেছি? আমাদের তো এখানে আসার কথা ছিলো না। বয়স্ক অফিসারটি বিস্ময় ভেঙ্গে প্রশ্ন করলেন।
আসলে আপনারা ইচ্ছে করলে আপনাদের কাঙ্খিত স্টেশনেও ফিরে যেতে পারেন। তবে কামড়ার ভেতরে রাখা টাকাগুলো এখানে রেখে যেতে হবে। আপনারা চাইলে এখানেও থেকে যেতে পারেন। এই অর্থ দিয়ে এখানে নিশ্চিন্তে আরামের জীবন কাটাতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে কিছুতে আপনাদের পূর্বের ঠিকানায় আর ফেরা হবে না। কোন রকম যোগাযোগ সম্ভব হবে না। বলতে গেলে নতুন এক জীবন আপনাদের এখানে কাটাতে হবে। সব রকম ব্যবস্থাই আমরা করব। অর্থকষ্ট ব্যাপারটা কি জিনিস বাকী জীবন আর অনুভব করবেন না।
স্টেশন মাস্টার থেমে আগের মত হাসলেন। চারজন যাত্রী নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এ স্বপ্ন নয় তো?
জ্বি না ভদ্রমহোদয়গণ, এটা স্বপ্ন নয়। নতুন জীবন বা বলতে পারেন সংশোধন করে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার একটা প্রজ্যাক্ট।
আপনারা কি এলিয়েন? অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছেন? কেদাদুরস্ত সাহস করে বলল।
জ্বি না সাহেব, আমরা তেমন কেউ নেই। আসলে আমি বা আমরা কে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় এই মুহূর্তে। আপনাদের খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনারা কি নতুন জীবনের সুযোগ নিতে চান? যদি চান তাহলে এই ট্রেনটা খালি ফিরে যাবে চিরদিনের মত। আর যদি আপনারা আগের জীবনে ফিরতে চান তাহলে এখনি বলুন, আপনাদের নিয়ে ট্রেনটা আপনাদের স্টেশনে ফিরিয়ে দিবে। তবে টাকাগুলো আপনাদের সঙ্গে যাবে না।
স্টেশন মাস্টার একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে হাসি মুখে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ঠিক পাঁচ মিনিট, নিজেদের মধ্যে আপনারা কথা সেরে নিন। তারপর আমাকে সিদ্ধান্ত জানান।
বয়স্ক অফিসারটি বাকী তিনজনকে বলল, ভালো সুযোগ। জীবনে কেউ কোনদিন পেয়েছে কিনা সন্দেহ। এখানে থেকে গেলে বাকী জীবনটা প্রচুর্যের মধ্যে থাকা যাবে। অর্থচিন্তার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে- কি বলেন সবাই?
কেরানি বলল, আমরা ছোট মাইয়াটা? তারে আনা যাবে না? আসার সময় সবরি কলা আনতে বলছিলো, সে তো অপেক্ষা করে থাকব? এই কষ্ট আমি কেমনে ভুলমু বাকী জীবন?
যদি তোমার এই কষ্টের অপমানের জীবন থেকে মুক্তি চাও তো তোমার মেয়েকে ভুলতে হবে। পাক ওরা কষ্ট! তুমি নিজে বাঁচো! বয়স্ক অফিসার শুষ্কভাবে হাসলেন।
কেরানি চোখে বেদনা খেলে গেলো? সে বিচার চাওয়ার মত বাকী দুজনের দিকে তাকালো।
রুক্ষ চেহারার যুবকটি বলল, আমি বহুবার বিদেশে যাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। যখন বিদেশের জন্য চেষ্টা করেছিলাম তখন মনে হয়েছিলো নিজের জন্য দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি আসলে তখন অনেকগুলো মানুষের জন্যই দূরে যেতে চেয়েছিলাম। তাদের ভালো রাখার জন্য। আজ যখন আমার একা নিজের ভালো থাকার সুযোগ এলো, একমাত্র একা আমি নিজে ভালো থাকার সুযোগ, তখন কেন কষ্ট হচ্ছে? আমার চিরচেনা মানুষগুলোই যদি না থাকে তাহলে একটা টাকার বিছানায় শুয়ে কি হবে? আমার বুড়ো বাবা মায়ের কি হবে?
আপনার অনুপস্থিতে ঠিকই ওরা ঘুরে দাঁড়াবে। আপনি তো পথে এ্যাক্সিডেন্ট করে মরেও যেতে পারেন। তখন ওরা কি বেঁচে থাকবে না? রোজ রোজ ধুঁকে ধুঁকে মরার চাইতে এইভাবে এই নতুন ভূবনে বাঁচাই কি ভালো না? বয়স্ক অফিসার আগের মত হাসলেন।
তাহলে আপনি থেকে যান। রুক্ষ যুবকটি বলল।
বয়স্ক অফিসারটি আগের মত আবার হাসলেন। দেখুন, আমার স্ত্রীর আমি ছাড়া কেউ নেই। আমাদের কোন সন্তান হয়নি। স্ত্রীর বেস্ট ক্যান্সার। হয়ত বাঁচবে না। তাছাড়া আমিও তো মরে যেতে পারি! সে হিসেবে আমার এখানে থেকে গেলে আর কি খারাপ হবে? আমার স্ত্রীর কপালে যা হবার হবে। আমি মরে গেলে যেমন হবে এটাকে সেভাবে নিলেও হয়। কিন্তু তার মুখটা কল্পনা করে আমি ফিরে যাবার কথাই ঠিক করেছি। হয়ত স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারবো না। হয়ত বাকী জীবনটা নিঃসঙ্গ কাটাতে হবে। তবু আমাকে ফিরতে হবে…। আচ্ছা, আপনি, আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে আপনি একমাত্র লোক যিনি এখানে থেকে যেতে পারেন। জেল হওয়ার চাইতে এখানেই নতুন জীবন শুরু করুন। দুই কোটি টাকা শোধ করতে না পারলে অপমান জেল জিরিমানা তো নিশ্চিত!
কেতাদুরস্ত বলল, ঠিক বলেছেন। সেকথাই ভাবছিলাম। আমি থেকে গেলে কেমন হয়? আমি এখানে থেকে গেলেও টাকা লোপাটের খবর সবাই জানবে। আমি এখানে দারুণ রাজকীয় একটা জীবন শুরু করতে পারি। সাবেক জীবনের ছায়াও এখানে মারাতে পারবে না। কিন্তু এখানে তো আমার কেউ নেই! জেলখানার ভয়েও যদি এখানে থেকে যাই এটাও তো আমার জন্য জেলখানা। টাকার প্রাসাদের আমি এক কয়েদি! আমার মেয়ে, আমার স্ত্রী, এমনকি রোজ গলির মুখে যে ছেলেটার কাছ থেকে সিগারেট কিনি সেও আমার কত আপন, কিন্তু এখানে কেউ নেই। যদি আমি ফিরে যাই সেটা তাদের জন্যই ফিরে যাবো। এমনকি তাদের জন্যই জেলে যাবো। যদি ফিরে যাই, শূন্যের কাছাকাছি একটা সম্ভাবনাও থাকবে সব অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়ার। কিন্তু এখানে থেকে গেলে সে সুযোগও মিলবে না। তবু ভেবে দেখলে এখানে আমি তো খুব ভালো থাকব। কিন্তু একা কি করে ভালো থাকা যায়? একটা জিনিস জীবনে আজ শিক্ষা হলো, একা কোনদিন ভালো থাকা যায় না। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হয়। এতবড় সুযোগ পেয়েও কেন আমরা নতুন জীবন নেইনি কারণ আমাদের বিগত জীবনের সবাইকে নিয়েই আমরা নতুন জীবনের সুযোগ নিতে চাই। জানেন, কয়েকদিন ধরে আত্মহত্যার কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম অফিসের টাকার হিসেব দিতে না পারলে আত্মহত্যা করব। এখন মনে হচ্ছে, না, আমার প্রায়শ্চিত্ত দরকার। কত বছর জেল হবে জানি না। জেল থেকে বের হবার পর তো কারোর কাছে ফিরতে পারব। আমার মেয়ে তো অপেক্ষা করে থাকবে। এত সুন্দর অপেক্ষার চেয়ে কি করে এইখানে ’একা একা ভালো থাকা’ ভালো হয় বলুন তো?...
কেতাদুরস্ত থামতে সবাই চুপ করে রইল। যেন এবার প্রতেক্যের নিজের সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া। জীবনের এপার ওপার মাত্র মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বদলে যাবে। জীবনের মোড় ঘুরে যাবার মুহূর্তগুলো এমনি তড়িৎ সিদ্ধান্তেই ঘটে যায়…।
ট্রেনের ঘন্টা বেজে উঠল। হুঁশ করে ইঞ্জিন চালু হলো। স্টেশন মাস্টার হাসি মুখে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন। প্লাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন চলতে শুরু করছে। গভীর কালো জঙ্গল পেরিয়ে ট্রেন কখন যে চিরচেনা আলো ঝলমল প্লাটফর্মে এসে থামল টেরও পায়নি কেউ। রুটি কলার দোকান, চা সিগারেট, দুপাশে হকার মারিয়ে চারজন তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেলো আজকের মত।
#সুষুপ্ত_পাঠক
#সুষুপ্ত_পাঠক_এর_ছোটগল্প
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................