বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত দেশপ্রিয়র বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এরকম বাড়ির উপর আঘাত করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কুশিক্ষা ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন হয়। একজন বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীর জন্য স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ঐতিহাসিক নিরুত্তাপ থাকবেই। সেরকমই একটি সৎ ও নির্জলা সত্য উচ্চারণ দেখিয়ে বাকী আলাপটা পরে করছি -
‘১৯২৮ সালে বাংলার হিন্দু মুসলমান নেতৃবৃন্দ্রের এক সভায় সার আবদুর রহিম ও ডা: বিধান চন্দ্র রায়ের মধ্যে যে কথা কাটাকাটি হইয়াছিল সেদিক পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। ঐ সভায় ডা: রায় বলিয়াছেন: মুসলমানরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয় না; শুধু প্রতিনিধিত্ব ও চাকুরি-বাকরিতে অংশ নিতে চায়। সার আবদুর রহিম অবশ্যই সেকথার জবাব দিয়াছিলেন। কিন্তু একটু ধীরভাবে চিন্তা করিলে স্বীকার করিতে হইবে, ডা: রায়ের ঐ অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিলো না। বস্তুত আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব্ ও সরকারী চাকুরিতে মুসলমানদের দাবী দাওয়া মানিয়া লওয়ার ব্যাপারে হিন্দু নেতৃত্বের কৃপনতা ও দ্বিধার যথেষ্ঠ কারণ ছিলো। ডা: রায়ের কথাটা তার ব্যক্তিগত মত ছিলো না। ওটা ছিলো সাধারণভাবে হিন্দুদের ও বিশেষভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বের অভিযোগ। এমন যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তিনি পর্যন্ত বলিয়াছেন: দেশকে ভালো না বাসিয়া দেশের স্বার্থে কোন কাজ না করিয়া মুসলমানরা শুধু ফললাতে সিংহের ভাগ বসাইতে চায়। ‘সিংহের ভাগ’ কথাটা অতিশয়োক্তি নয়, মোটের উপর সত্য কথা। ঐতিহাসিক যত কারণ আর পরিপাশ্বিক যত যুক্তি থাকুক না কেন, এই যুগের বাস্তব অবস্থা ছিলো এই যে, মুসলমানরা সাধারণভাবে ও শিক্ষিত সম্প্রদায় বিশেষভাবে নিজেদের মাতৃভূমিকে আপন দেশ মনে করি না। তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে-কামে এটা মনে হওয়া মোটেই অযৌক্তিত ছিলো না যে মুসলমানরা নিজেদের দেশের চেয়ে মধ্যপাচ্যের মুসলিম দেশগুলিকেই বেশি আপন মনে করে। প্রথমত: মুসলমানদের নিজস্ব কোন চিন্তাধারা ছিলো না। যদি কিছু থাকিয়া থাকে সেটা প্যানইসলামিযম। ‘মুসলিম হায় হাম সারা জাহি হামারাই যেন ছিলো তাদের সত্যকার রাষ্ট্র দর্শন। ১৯২০-২১ সালে খিলাফত অসগযোগ আন্দোলন যে ভারতীয় মুসলমানদের অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনে পরিণত হইয়াছিল সেটা খিলাফত ও তুর্কি সাম্রাজ্যের জন্য যতটা ছিল, ততটা ভারতের স্বারাজের জন্য ছিল না। এটা হাতে-নাতে প্রমাণ হইল দুই বছর পর। ১৯২৩ সালে যখন কামাল পাশা দেশ হইতে খলিফাকে তাড়াইয়া খিলাফতে অবসান ঘোষিত করিলেন তখনই ভারতের মুসলমানদের উৎসাহে ভাটা পরিল। খিলাফত কমিটি মরিয়া গেল, মুসলমানরা কংগ্রেস ছাড়িয়া দিল। এতে তারা এটাই বুঝাইল যে খিলাফতই যখন শেষ হইয়া গেল তখন দেশের স্বাধীনতায় তারা আর ইন্টারেস্টেড নয়’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, আবুল মনসুর আহমদ)।
এজন্যই চট্টগ্রামের সূর্যসেন এক বিস্মৃত নাম বাংলাদেশে। এ কারণেই বাংলাদেশের বৃটিশবিরোধী বিপ্লবীদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িঘর দখল ও শত্রুসম্পত্তি করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনষ্ট করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রগতিশীল পন্ডিত ব্যক্তিবর্গই বাঙলী মুসলমান হিসেবে স্বাতন্ত্র্য জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান কাম বাংলাদেশে বিগত ৭০ বছরের অধিক সময় থেকে যে বিনির্মাণ প্রক্রিয়া সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে তাতে এই ধরণের ইতিহাস রক্ষা করার জন্য জাতিগত যে আবেগ প্রয়োজন তা এখানে কখনই গড়ে উঠেনি। মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য যদি লড়ত তাহলে হাজার উশকানিতেও মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তান করতে গিয়ে দেশভাগ হত না। তারা খিলাফত আন্দোলন করেছে। তারা বাঁশের কেল্লা বানিয়েছে সেই খিলাফত বানানোর জন্য। সেটা ভারতের স্বাধীনতার জন্য ছিলো না। বাম ও কংগ্রেসের কাল্পনিক হিন্দু মুসলমানের মিলিত বৃটিশবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসের বিপরীতে আবুল মনসুর আহমদ এক উলঙ্গ সত্য উচ্চারণ করে বাকীদের নাঙ্গা করে দিয়েছেন। সারা বাংলাদেশেই ঐতিহাসিক বাড়ি ও ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিচিহ্ন বিনষ্ট করার পিছনে মনজগতের এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যে অনেকটা দায়ী সেটা সামনে তুলে ধরলে উল্টো সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়!
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................