ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হচ্ছে একটা আয়না যেখানে বাঙালী মুসলমান তার বীভৎস মুখটা দেখতে পায়!

পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এখানে থেকে গিয়েছিলেন সম্ভবত মুসলমানদের উম্মাহ চেতনার সঙ্গে তিনি উপলব্ধিতে পিছিয়ে ছিলেন।


কারণ ’মুসলমান’ এই পরিচয়ের সঙ্গে ’বাংলা বাঙালীর’ বিরোধ বাস্তব। যদি আপনি আপনার নিজস্ব জাতিসত্ত্বায় তীব্রভাবে হৃদয়ে মননে জড়িয়ে থাকেন তাহলে আপনি ’খাঁটি মুসলমান’ হতে পারবেন না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মুসলমানের সেই হৃদপিন্ডে হাত দিয়েছিলেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সেই অপরাধের ষোলআনা উশুল করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ৮৫ বছরের বৃদ্ধকে এমন নৃসংশভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে যে তার নজির পৃথিবীতে কমই আছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পুত্রসহ আটক ধীরেন্দ্রনাথকে নির্যাতন হতে দেখেছিলেন রমনীমোহন শীল। সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস কুমিল্লায় ১৪ নং ডিভিশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন পাকিস্তানীরা গণহত্যার জন্য যে কয়েকটি ক্যাটাগরি বেছে নিয়েছিলো তার মধ্যে আলাদা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর জেনোসাইড চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু রমনীমোহন শীল নাপিত বলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের চুল দাড়ি কামানোর দায়িত্ব ছিলো তার উপর। দেশভাগের সময়ও মুসলিম লীগের বাঙালী মুসলমান দেশপ্রেমিকরা শিক্ষিত প্রতিদ্বন্দ্বি হতে পারে এমন হিন্দুদের দাঙ্গা হাঙ্গামায় খেদিয়ে নাপিত ময়রা আর জুতা সেলাই করার জন্য কিছু হিন্দুকে রেখে দিয়েছিলো। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মত মানুষরা ’পাকিস্তান’ কায়েমের সৈনিকদের কাছে কখনই প্রত্যাশিত ছিলেন না। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান কৃষকদের পাট বেচা টাকায় কেন পাঠ্যবইতে রাধাকৃষ্ণ পড়তে হবে, সেই টাকায় তারা আরবের কারবালার প্রান্ত পড়বে- এই তেড়িয়া ধর্মীয় চেতনা যখন কবি সাহিত্যিকদের মধ্যেই থাকে সেখানে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে কিছুতে পাকিস্তান চেতনার সঙ্গে যায় না বলাই বাহুল্য। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কি খানিকটা বুঝতেন এই বিষয়গুলি? নইলে পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলি থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে তিনি কেন ভীত হলেন যে তাকে পেটানো হতে পারে? নাতনি অরোমা দত্ত স্মৃতিচারণ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র চাদর পরে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভয় পেলন বুঝি চাদরের নিচে লাঠি নিয়ে এসেছেন পেটাতে। কারা পেটাতে আসবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে? ঢাকায় বাংলা ভাষায় কথা বলা মুসলমানরা তো জাতিগতভাবে সবাই বাঙালী। তবু পেটানোর মত যে ভালোই লোকজন থাকতে পারে সেটা তিনি জানতেন। কারণ মাত্রই আগের বছর দেশভাগ হযেছিলো। মুসলমানদের চেতনা বিশ্বাস তিনি কম দেখননি। পাকিস্তানে গিয়ে বাংলা ভাষাকে উর্দু ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বলেছিলেন যখন তখন পূর্ব পাকিস্তানের একজন বাঙালী এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র পরিমাণ বিপদ আঁচ করতে পারেনি। বিমানবন্দরে তাকে ফুল দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কজন ছাত্র অপেক্ষা করেছিলো তাদের কথা মাথায় রেখেও বলা চলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে অবস্থান থেকে বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে সেদিন পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে লড়েছিলেন সেরকম ভাষা প্রেম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধেনি। চাকরি বাকরি হারানোর ভয়েই পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা বাংলা ভাষার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু পাকিস্তান কায়েমের সঙ্গে এটা ছিলো সাংঘর্ষিক। যে কারণে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষার দাবী পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, “উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের দাবিতে পাকিস্তানের জন্ম এবং তাঁদের ভাষা উর্দু। কাজেই বেশির ভাগ জনগণ যে-ভাষায় কথা বলেন, তাকে প্রাধান্য দিতে যাওয়া ভুল হবে।”

সঠিক বলেছিলেন লিয়াকত আলী। কারণ মুসলমান এই জাতিসত্ত্বা কিসের উপর টিকে থাকবে যদি বাঙালীরা আবার বাঙালী হতে চায়? আরে বাবা রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দই যদি সঙ্গে নিবে তাহলে মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান কেন করলে? পাকিস্তান টিকবে শুধুই মুসলমান পরিচয়ে। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মত ‘হিন্দুরা’ থাকলে পাকিস্তান ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তাই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে মনে করিয়ে দেয়া হলো ইহুদী হলোকাস্টের অনুরূপ হিন্দু হলোকাস্ট ছাড়া পাকিস্তান টিকবে না। রমণীমোহন শীলের স্মৃতিচারণে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেখতে পাই এভাবে, ”বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জেজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশরায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বারবার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, ‘এটা একটা দেখার জিনিস নয়-নিজের কাজ কর।’ এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তাঁর কপালে এই দুর্ভোগ। তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।”

এই ভূখন্ডের প্রথম বাংলা ভাষার দাবীদারকে পাকিস্তানীরা উচিত শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলো তারা কি চায়। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে মুছে ফেলতে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের তার প্রতি উদাসিনতা আসলে কি বুঝাতে চায়? ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আজকের বাংলাদেশে কেউ চেনে? ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক বিস্মৃত নাম! বাংলাদেশের ইতিহাস এখন ৭ মার্চের একটা ভাষণ, তারপর মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে ফেলল! আগে পিছে কিচ্ছু নেই। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে চিনতে জানতে এই রাষ্ট্র রীতিমত রহস্যময় আচরণ করেছে। শুধু রাষ্ট্র নয়, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে সিনেমা বানায়নি। কেউ তাকে নিয়ে নাটক লিখেনি! বাংলাদেশে তিতুমীরকে নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়। কারণ পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানানো হলেও মুসলিম জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করা হয়নি। এখানে সবচেয়ে সেক্যুলার সাজা লোকটিও মুসলিম জাতীয়তাবাদী। এই জাতীয়তাবাদের চেতনায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তো মুছে যাবেই…।

#সুষুপ্ত_পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted