পঞ্চতত্ত্বে পঞ্চরূপে এক অনন্তের;
উপাসনাকেই পঞ্চমত বলে
সনাতন ধর্মে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের উপাসনা পঞ্চমতে ও পথে বিভজিত যথা- শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রধানত শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব তিনটি মত-পথের সম্প্রদায় বিদ্যমান।
নিজ নিজ উপাস্য সম্প্রদায় ব্যতীত এ পঞ্চমতের সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধা এবং সম্মান পোষণ করা উচিত। পক্ষান্তরে কোন আন্তঃসম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়। সাকার নিরাকার বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় স্বরূপে এক ঈশ্বরই সর্বত্র বিরাজমান। এ বিষয়টি তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের একাদশ অনুবাকের একটি শ্রুতিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে।
নিজ নিজ উপাস্য সম্প্রদায় ব্যতীত এ পঞ্চমতের সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধা এবং সম্মান পোষণ করা উচিত। পক্ষান্তরে কোন আন্তঃসম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়। সাকার নিরাকার বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় স্বরূপে এক ঈশ্বরই সর্বত্র বিরাজমান। এ বিষয়টি তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের একাদশ অনুবাকের একটি শ্রুতিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে।
তস্য শিখায়া মধ্যে পরমাত্মা ব্যবস্থিতঃ।
স ব্রহ্ম স শিব স হরিঃ সোঽক্ষরঃ পরম স্বরাট।।
"জীবের হৃদয়ে পরমাত্মা অবস্থিত। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শিব, তিনিই হরি, তিনিই ইন্দ্র। তিনি অক্ষর, স্বয়মদীপ্ত রাজা, তিনিই জীবের শ্রেষ্ঠ গতি।"
প্রত্যেক পূজা সহ, বিবাহ, শ্রাদ্ধ সকল সংস্কার বিধির পূর্বে প্রথমে পঞ্চদেবতার বিধিবৎ পূজা করতে হয়। পরে প্রধান পূজা করতে হয়।অর্থাৎ যে দেবতার পূজা, তাঁর পূজা করতে হয়। পঞ্চমতের প্রতিনিধিত্বকারী পঞ্চদেবতা হলেন : গণেশ, সূর্য, বিষ্ণু, শিব এবং আদ্যাশক্তি দুর্গা। পরমেশ্বরের সাকার এ পঞ্চরূপের পঞ্চদেবতাকে কেন্দ্র করেই শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব সনাতন এ পঞ্চমত প্রতিষ্ঠিত। এ পঞ্চমতের যে কোন একটি মতকে কেন্দ্র করেই ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হয়ে মুক্তি পাওয়া যায়। সকল পথই ঈশ্বরের পথ।মধ্যযুগের সমাপ্তিকালের কবি রামপ্রসাদ সেন এক ব্রহ্মকে বহু ভেবে দ্বিধান্বিত না হতে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সকল রূপই তাঁর রূপ।
"শাক্তে বলে তুমি শক্তি, শিব তুমি শৈবের উক্তি,
সৈরি বলে সূর্য্য তুমি, বৈরাগী কয় রাধিকাজী,
গাণপত্য বলে গণেশ, যক্ষ বলে তুমি ধনেশ,
শিল্পী বলে বিশ্বকর্মা, বদর বলে নায়ের মাঝি,
শ্রীরামদুলাল বলে, বাজি নয় এ যেন ফলে
এক ব্রহ্ম দ্বিধা ভেবে মন আমার হয়েছে পাজি।"
প্রথম গণেশ: ভগবান গণেশকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় গাণপত্য মত। ঋদ্ধি- সিদ্ধি সহ যুক্তিপ্রদান করেন ভগবান গণেশ। গাণপত্য মতের প্রধান মন্ত্র হল- ওঁ গং গণেশায় নমঃ।পঞ্চদেবতার প্রত্যেকটি দেবতাকে প্রথমে ধ্যানমন্ত্রে আহ্বান করতে হবে। এরপরে প্রত্যেক দেবতার স্বতন্ত্রমন্ত্রে দশোপচারে পূজা করে প্রণাম মন্ত্র পাঠ করতে হবে।দশোপচারে একই পদ্ধতিতে পঞ্চদেবতাকে পূজা করতে হবে। গণেশের প্রধান মন্ত্র "ওঁ গং গণেশায় নমঃ" মন্ত্র দিয়ে দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।
১.এতৎ পাদ্যং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
২. ইদমর্ঘ্যং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৩.ইদং আচমনীয় জলং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৪.ইদং স্নানীয়জলং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৫. ইদং পুনরাচমনীয় জলং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৬.এষ গন্ধঃ ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৭. এতৎ পুষ্পং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৮.এষ ধূপঃ ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
৯.এষ দীপঃ ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
১০.এতৎ নৈবেদ্যং ওঁ গং গণেশায় নমঃ।
এই দশোপচারে পূজা পর্যায়ক্রমে অন্য শিব , জয়দুর্গা , বিষ্ণু ও সূর্য পঞ্চদেবতার সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ভগবান গণেশের পূজার ধ্যানমন্ত্র হল:
ওঁ খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরং
প্রস্যন্দম্মদগন্ধ লুব্ধ মধুপব্যালোল গণ্ডস্থলম্ ।
দন্তাঘাত বিদারিতারি রুধিরৈঃ সিন্দুরশোভাকরং
বন্দে শৈলসুতাসুতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং কামদম্ ।।
গণেশের প্রণাম
ওঁ দেবেন্দ্র- মৌলিমন্দার মকরন্দ কণারুণাঃ ।
বিঘ্নং হরন্তু হেরম্বচরণাম্বুজরেণবঃ ।।
দ্বিতীয় সূর্য: ভগবান সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌর মতটি প্রতিষ্ঠিত। সূর্যরূপী নারায়ণই সৌর মতবাদে প্রধান ইষ্ট। ভারতের বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে সৌর সম্প্রদায়ের আধিক্য দেশী দেখা যায়। সৌর মতবাদে সূর্য উপাসনায় মন্ত্র হল- ওঁ নমো ভগবতে শ্রীসূর্যায়।
ভগবান সূর্যের ধ্যানমন্ত্র :
ওঁ রক্তাম্বুজাসনমশেষ গুণৈসিন্ধুং
ভানুং সমস্ত জগতামধিপং ভজামি ।
পদ্মদ্বয়াভয়বরান্ দধতং করাব্জৈ- র্মাণিক্যমৌলিমরুণাঙ্গরুচিং ত্রিনেত্রম্ ।।
প্রণামমন্ত্র:
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং ।
ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোঽস্মি দিবাকরম্ ।।
তৃতীয় বিষ্ণু: ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবং তাঁর শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ সহ বিবিধ অবতার স্বরূপকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব মতটি প্রতিষ্ঠিত। সারা ভারববর্ষেই বৈষ্ণব মত ব্যাপ্ত। পঞ্চমতের পূজায় বৈষ্ণব মতের পূজার মন্ত্র হল-ওঁ বিষ্ণবে নমঃ।
ভগবান বিষ্ণুর ধ্যানমন্ত্র হল:
ওঁ ধ্যেয় সদা সবিতৃমণ্ডল-মধ্যবর্তী
নারায়ণঃ সরসিজাসন-সন্নিবিষ্টঃ।
কেয়ুরবান্ কনককুণ্ডলবান্ কিরীটী
হারী হিরন্ময়বপুর্ধৃতশঙখচক্রঃ।।
ভগবান বিষ্ণুর প্রণামমন্ত্র:
ওঁ নমো ব্রাহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ ।।
পাপোঽহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপসম্ভবঃ ।
ত্রাহি মাং পুণ্ডরীকাক্ষং সর্বপাপহরো হরি ।।
চতুর্থ শিব: ভগবান শিবকে কেন্দ্র করে সংস্থাপিত হয়েছে পঞ্চমতের অন্যতম শৈব মতবাদটি। ভারতের উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, কাশ্মীর, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, নেপালে শৈব সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাধিক্য অধিক। সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী ভগবান শিবের বারোটি স্বয়ম্ভু লিঙ্গমূর্তি বিরাজমান। এ পবিত্র স্বয়ম্ভু লিঙ্গমূর্তিকে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়। শৈব মতবাদের প্রধান মন্ত্র হল - ওঁ নমঃ শিবায়।
ভগবান শিবের ধ্যান
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং
রত্নাকল্লোজ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্ ।
পদ্মাসীনং সমস্তাৎ স্ততমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং
বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।
প্রণামমন্ত্র :
ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে ।
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতিঃ পরমেশ্বরঃ ।।
পঞ্চম আদ্যাশক্তি দুর্গা: ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা থেকেই শাক্ত মতের উৎপত্তি। আদ্যাশক্তি মহামায়া প্রধান মূর্তিই হল দুর্গা। এছাড়া দেবীর ত্রিগুণভেদে ত্রিমুর্তি হল সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং কালী । এই যে কোন একটি রূপকে অনুসরণ করে শাক্ত সাধন পথে অগ্রসর হওয়া যায়। পঞ্চদেবতা পূজায় আদ্যাশক্তি দেবীর মন্ত্র হল- ওঁ দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা।
আদ্যাশক্তি দুর্গার ধ্যান
ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাং।
শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্ ।
সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পুরয়ন্তীং।
ধ্যায়েদ্ দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ।।
প্রনাম মন্ত্র
ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বাথসাধিকে ।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোঽস্তুতে।।
আমরা যে পূজাই করি না কেন সকল পূজার শুরুতেই পঞ্চমতের প্রতিনিধিত্বকারী পঞ্চদেবতার পূজা অগ্রে করতে হয়। এতে সাধকের উপলব্ধিতে আসে সকল মত-পথই যে এক অচিন্ত্য অনন্তের পথে যায়। এতে সাধকের মধ্য থেকে উপাস্যদের নিয়ে সকল প্রকারের বিদ্বেষ ভাব দূরীভূত হয়ে যায়। মনের সাম্প্রদায়িকতা চলে গিয়ে বৈচিত্র্যময় পরমেশ্বরের একত্ববোধ হয়। পঞ্চমতের মধ্যে ঈশ্বরের যে রূপেরই উপাসনা করবে, সেই রূপকেই ব্রহ্মস্বরূপে ইষ্ট নির্দিষ্ট করতে হবে। তবেই সাধক সাধনায় অগ্রসর হতে পারবে এবং পরিশেষে জীবের আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি লাভ করতে পারবে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................