আমরা সকলে মিশ্র মানুষ। বিভিন্ন পরিযানের ফলে যেসব জনগোষ্ঠী এই দেশে এসেছে তাদের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এই দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী।
১) ৭০ -৭২ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে এসেছে প্রথম মানুষ। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতেই। এই জনগোষ্ঠীর পরিযানের থেকেই সারা পৃথিবীতে হোমো স্যাপিয়েন্স ছড়িয়ে পড়ে। আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসী ওঙ্গে, সেন্টিনেলিজ, জারোয়ারা ওই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নিকটতম প্রতিনিধি। তাই এই প্রথম পরিযানের মানুষকে বলা চলে ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক’। মাতৃবংশের (maternal lineage) দিক দিয়ে আজকের ভারতীয় ৬০ - ৯০ % ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক’-দের সরাসরি বংশধর। শতাংশের বিভিন্নতা নির্ভর করে অঞ্চল, বর্ণ, জাতের পার্থক্যে। তবে আমাদের অধিকাংশের মাতৃক্রম আছে সেই আফ্রিকা আগত জনগোষ্ঠীর থেকে।
২) হলোসিন যুগের প্রথমে ১২ হাজার বছর আগে ইরান থেকে আসে আরেক দল শিকারী-সংগ্রাহক, এদের বলা যেতে পারে 'প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত’ জনগোষ্ঠী'। ‘আন্দামানী শিকারী-সংগ্রাহক’- দের সাথে সামান্য মিশ্রিত হয়ে এরাই গড়ে তুলেছিল হরপ্পীয় সভ্যতা। সম্ভবত হরপ্পীয় সভ্যতার নেতৃত্ব দিয়েছে এরাই। ওর জানত কৃষিকাজ, নৌ ও সমুদ্র বাণিজ্য , আধুনিক নগর নির্মাণের প্রকৌশল।
৩) ৩.৫ - ৪ হাজার বছর আগে মধ্য-এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে আসে ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এরা ছিল অর্ধ যাযাবর পশুপালক জনগোষ্ঠী। ওদের ভাষা ছিল সুললিত বৈদিক সংস্কৃত।
এই তিন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে তৈরী হয় ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলি।
এছাড়াও, পূর্ব ভারতে দেশের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসে আরও দুটি জনগোষ্ঠী।
৪) ৫ -৭ হাজার বছর আগে প্রাচীন অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠী আসে লাওস থেকে । এরা কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার মূল ভূখণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে।
৫) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ১-২ হাজার বছর আগে আসে প্রাচীন তিব্বতী-বর্মী জনগোষ্ঠী। এরা মূলতঃ যুক্ত বাংলার পূর্ব সীমান্ত ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বসবাস করে। বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এদের মিশ্রণ পশ্চিম বঙ্গের থেকে অধিক পরিমাণে হয়েছে ।
এই ৫টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র শেষ মাইগ্রেশনে নারী ছিল পুরুষের সমান। অন্য সব মাইগ্রেশনে পুরুষের সংখ্যা ছিল বেশী। প্রাচীন অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠী এসেছিল সম্পূর্ণ নারীহীন ভাবে। খেয়াল রাখতে হবে, একমাত্র তিব্বতী -বর্মী জনগোষ্ঠী কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল।
এবার আসি বর্ণবিভাগের কথায়। হিন্দু সমাজ বিভক্ত নানা বর্ণে; আজও অধিকাংশ মানুষ মেনে চলেন বর্ণ ব্যবস্থা।
কতদিন আগে এই বর্ণ প্রথার সৃষ্টি হয়েছে? কবে থেকে বিভিন্ন বর্ণগুলির মধ্যে সামাজিক সংমিশ্রণ বন্ধ হয়ে গেল?
সিন্ধু সভ্যতাতে কি বর্ণ বিভাগ ছিল? সামাজিক শ্রেণীবিভাগ ওখানে নিশ্চই ছিল, তবে বর্ণ প্রথার কোন প্রমান পাওয়া যায়নি।
বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী অনুমান করা হয় এক হাজার থেকে আটশত সাধারণ পূর্বাব্দর মধ্যে বর্ণ বিভাজন হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু সাহিত্য নয়, বর্ণ বিভাগের বিজ্ঞান ভিত্তিক, ডিএনএ ভিত্তিক কিছু গবেষণা হয়েছে, আমি সেই সব নিয়ে এখানে আলোচনা করব।
২০১৩-তে প্রিয়া মুরজানী, কুমারস্বামী থঙ্গরাজ মার্কিন জিনবিদ ডেভিড রাইখের তত্ত্বাবধানে এক যৌথ গবেষণা করেন দেশীয় বিভিন্ন জাতের উৎস সন্ধানে।
এই গবেষণায় উপমহাদেশের ৭৩টি (৭১ ভারতীয় ও ২টি পাকিস্তানী) জাতিগত ও ভাষাগত ভিন্ন গোষ্ঠীর ৫৭১ জন মানুষের থেকে স্যাম্পলিং করে ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতির মানুষ, আদিবাসী মানুষ, এমনকি আন্দামানের বিভিন্ন আদিবাসী মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের মানুষ, আদিবাসী মানুষ এই গবেষণার আওতায় ছিল।
এই গবেষণার প্রতিপাদ্য ছিল, দেশের বিভিন্ন জাতি ও ভাষা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মিশ্রণগুলির সময়কাল নির্ণয় করা। দেখা গেছে, এই ৭৩টি গোষ্ঠীর মিশ্রণের সময়কাল আজ থেকে ৪২০০ থেকে ১৯০০ বছরের মধ্যে হয়েছে। এমনকি ভিল, চামার ও কল্লারের মতো প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীও এই মিশ্রণ থেকে রেহাই পায়নি। এদের সকলের মধ্যে পাওয়া গেছে ইন্দো-ইউরোপীয় জিন। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে এই মিশ্রণটি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ভারতের প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
এই গবেষণার ফল ওরা প্রকাশ করেছেন। আমি নিচে কিছু অংশ সংক্ষিপ্তাকারে দিলাম।
১) আজকের দিনে বিশুদ্ধ অবিমিশ্র মানুষ পাওয়া যায় নি। আজকের ভারতীয়রা মূলত উপরের তিন মূল জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। তবে এই মিশ্রণে বর্ণের, জাতের, অঞ্চলের ভিত্তিতে অনুপাতের তারতম্য আছে।
অর্থাৎ কোন এক সময়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা সারা ভারতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয়েছে। কখন হয়েছিল এই মিশ্রণ?
২) ওরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, আজ থেকে ৪,২০০ বছর আগে থেকে ১,৯০০ বছর আগে পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় পূর্ব পুরুষদের মধ্যে মিশ্রণ হয়েছে। কোন জাত, বর্ণ এর থেকে রেহাই পায়নি।
এবার মেলান ইতিহাসের সাথে। হরপ্পীয় অধিবাসীরা কোন প্রাকৃতিক/ভৌগোলিক/রাজনৈতিক কারণে দেশের দক্ষিণ দিকে নেমে গেছে আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে। তারপর ওখানকার মানুষের সাথে মিশ্রিত হয়ে গেছে।
প্রায় ওই একই সময়ে, আজ থেকে ৩,৫০০ বছর আগে রাশিয়ার স্তেপভূমি থেকে ইউরেশিয়রা ভারতে ঢুকে গেছে। ৪২০০ বছর আগে থেকে ১৯০০ বছর আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ ২২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ১০০ সাধারণ অব্দ পর্যন্ত সারা ভারতে ক্রমাগত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। ওই সময়ে ধীরে ধীরে সিন্ধু সভ্যতার বি-নগরায়ণও হয়েছে। অর্থাৎ শহর গুলির জায়গায় এসেছে গ্রাম। একই সময়ে গঙ্গার দক্ষিণ দিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যায়। অর্থাৎ আজকের পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও বাংলায় মানুষের ঘন বসতি হয়েছে। এবং এই সময়েই দেশে বৈদিক ধর্ম ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দৃঢ় আবির্ভাব হয়। আর জিনোম বিজ্ঞানের সাহায্যে গবেষণা করে ওরা দেখেছেন যে এই একই সময়ে মানুষের মিশ্রণ হয়েছে, অর্থাৎ ওই সময়ে বর্ণের বাইরে বিবাহ সমাজে প্রচলিত ছিল।
কিন্তু ১০০ সাধারণ অব্দর পর থেকে অন্তর্বিবাহ বা একই বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। এই যে ১৯০০ বছর আগে থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বহির্বিবাহ বন্ধের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তার প্রতিফলন কিন্তু পাওয়া গেছে সাহিত্যেও। ঋগ্বেদের সময় হলো ১৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ, এখানে বর্ণ ব্যবস্থার উল্লেখ প্রায় নেই। একমাত্র পুরুষসুক্ত মন্ত্রে এর উল্লেখ আছে, যেটা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করা হয়।
যেহেতু সমস্ত জাতের মধ্যে এই মিশ্রণ পাওয়া গেছে, তার থেকে এই অনুমান করা যায় যে, যে ভাবে আজকে বর্ণ/ জাত ব্যবস্থা ও সামাজিক শ্রেণী বিন্যাস চলছে, ইউরেশিয়রা আসার পরেও সমাজে ঠিক এভাবে বর্ণ বিন্যাস ছিল না। তখন স্পষ্টতই বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহ হত। হয়তো বর্ণ বিভাগ ছিল পেশার বিভাগ, এবং এই পেশা পরিবর্তন করা যেত।
অর্থাৎ বর্ণ জন্মভিত্তিক ছিল না, ছিল কর্মভিত্তিক।
গবেষকরা বলছেন যে স্তেপ মাইগ্রেশন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বর্ণব্যবস্থা ও সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ থাকতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতর পুরোহিত মর্যাদার জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পিতৃক্রমে স্তেপ উৎপত্তির প্রমান বেশি পাওয়া যায়।
ইতিহাসের কোন যুগে এই মিশ্রণ বন্ধ হলো?
মনু স্মৃতি লেখা হয়েছে, এই ৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ১০০ সাধারণ অব্দের মধ্যে। আর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এই সময় থেকেই বহির্বিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তখন থেকে নিজের বর্ণের মধ্যে বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়।
তবে আর্যরা ছিল শ্বেতকায়, এবং দেহ বর্ণের এই অহংকার কিন্তু ঋগ্বেদেও বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। ওরা কখনও কৃষ্ণ বর্ণের মানুষের বসতিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, কখনও বা পঞ্চাশ হাজার কৃষ্ণ বর্ণ মানুষকে হত্যার কথা সগর্বে ঘোষণা করেছে।
পরবর্তী বেদ গুলির সময় থেকে প্রাগার্য মানুষ, রাক্ষস, গরিব আর্য এদের সবাইকেই যথেচ্ছ ভাবে দাস বলা শুরু হয়। শূদ্রের উল্লেখ বহুবার এসেছে পরবর্তী বেদগুলিতে। অর্থাৎ তখন সামাজিক পৃথকীকরণ প্রবলতর হচ্ছিল।
মাত্র ১৯০০ বছর হিন্দুরা বহির্বিবাহ করে না। তার আগে দিব্বি বিভিন্ন বর্ণ, জাতের মধ্যে মিশ্রণ হয়েছে। অর্থাৎ বর্ণ বিভাগ বৈদিক ধর্মের কোন মূলসূত্র বা অপরিহার্য অংশ নয়।
তাই এমনকি বিভিন্ন বর্ণ ও জাতের মানুষের মধ্যেও জেনেটিক মিল অত্যন্ত বেশি।
তথ্যসূত্র -
১) সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’, ১ - ৪ খন্ড: গাংচিল, ২০১২
২) রামশরণ শর্মা, 'প্রাচীন ভারতে শূদ্র': কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, প্রথম সংস্করণ, ১৯৮৯
৩) Moorjani, Priya, et.al.,‘Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India’: Am Journal of Human Genetics, Sep 5; 93(3): 422–438, 2013, doi: 10.1016/j.ajhg.2013.07.006
৪) Majumder, Partha P., et.al., ‘A Genomic View of the Peopling and Population Structure of India’: Cold Spring Harb Perspect Biol. 2015 Apr; 7(4): a008540,
৫) Narasimhan, V. M., et. al., ‘The formation of human populations in South and Central Asia’: Science, Vol. 365, Issue 6457, 06 Sep 2019
৬) Chaubey, Gyaneshwer, et. al., ‘Population Genetic Structure in Indian Austroasiatic Speakers: The Role of Landscape Barriers and Sex-Specific Admixture’: Mol Biol Evol.; 28(2), Feb 2011
৭) Oppenheimer, S.,‘Out-of-Africa, the peopling of continents and islands: tracing uniparental gene trees across the map’: The Royal Society Publishing, 19 March 2012
Madhusree Bandyopadhyay
31/01/2021
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................