বাম ও জুনায়েদ সাকি, ভিপি নূর, ডা. জাফরুল্লাহ, এইরকম যারা আছেন- ইনাদের মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা কি ধর্মনিরপেক্ষ? তারা যে স্পষ্ট ভাষায় মোদীকে মুসলিম নির্যাতনকারী হিসেবে বিরোধীতার কথা বলছেন সেটা কি মুসলিম জাতীয়তাবাদের কারণে নয়? যদি না হবে তাহলে দুই মাসে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ৫০০ বিক্ষোভকারী সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে মেরেছে। তারা বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে লং মার্চ নিয়ে গেলেন না কেন? মিয়ানমার যখন ‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের’ নির্যাতন করেছিলো তখন তো তারা সরব ছিলো। কিন্তু একদিনে ১০০ জন মানুষকে মিয়ানমার সরকার মেরে ফেলার পরও তাদের মানবতাবাদ জেগে উঠল না কেন? ভারতে নাগরিক বিল বিরোধী মিছিলে পুলিশের হামলার সময়ও তো তারা সরব ছিলো। ইসলামিক দলগুলো, হেফাজত ইসলামের মোদী বিরোধীতা তাদের মুসলিম জাতীয়তাবাদ থেকে তাই সেটা নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই। বাকীদের মুসলিম জাতীয়তবাদ হলেও দোষের বলছি না। যে কেউ মুসলিম জাতীয়তাবাদী হতে পারে। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের সব বড় বড় নেতাই মুসলিম জাতীয়তাবাদী ছিলেন। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলো মুসলিম জাতীযতাবাদে। এখন যারা বিজেপিকে ঘৃণা করেন তারা জেনেও না জানার ভান করে থাকেন যে মুসলিম লীগ আর বিজেপি একই রকম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দল। মোদীকে যেমন গুজরাট দাঙ্গার জন্য দায়ী করেন ঠিক কোলকাতা দাঙ্গার জন্য সরওয়ার্দিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু সরওয়ার্দি বাংলাদেশের মহান জাতীয় নেতাদের একজন।
বাংলাদেশে হিন্দু ও ভারত বিরোধী জনমানস যে প্রবল সেটা রাজনীতিবিদরা ভালো করেই জানতেন তাই ভোটের আগে বা নিজেদের দল গঠনের সময় সেই হিসাবটা মাথায় রাখতেন। মুসলিম লীগ থেকে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ জন্ম গ্রহণ ও নামকরণের ইতিহাস বলছেন অলি আহাদ, “দেখা গেলো, আমরা কতিপয় ছাত্র ব্যতীত আর সকলেই আওয়ামী মুসলিম লীগ নামকরণের ঘোর পক্ষপাতি। তাহাদের যুক্তি আমরা সকলেই মুসলিম লীগ। আকরস খাঁ, নূরুল আমীন, চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও লিয়াকত আলী পরিচালিত মুসলিম লীগ হইল সরকারী মুসলিম লীগ এবং আমাদেরই হইবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ।”-(জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ)।
অর্থ্যাৎ, ভাষানী, আতাউর রহমান, শামসুল হক ইত্যাদি বড় নেতারা সকলেই নিজেদের 'জনগণের মুসলিম লীগ' বলেই দল গঠন করেছিলো। মানে উনারা দ্বিজাতিতত্ত্ব ত্যাগ করেন নাই? আওয়ামী মুসলিম লীগ পরে যেটা সংশোধন করে ‘আওয়ামী লীগ’ হয় তাদের কিন্তু মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কোন ঘোষণা বা আদর্শের ঐতিহাসিক প্রমাণও নেই। উল্টো ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিল খিলাফতবাদী ইসলামিক দলগুলোকে সঙ্গে করে এবং যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় ‘নীতি’ হিসেবে স্পষ্ট করে বলা হয়: “কুরআন ও সুন্নাহত মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে”।
তারা যে পাকিস্তানের মূল আদর্শ ধারণ করেন সেটা জনগণের কাছে প্রমাণ করতেই কিন্তু এই নীতি ঘোষণা। কারণ বিপক্ষে মুসলিম লীগের হয়ে তখন জিন্নার বোন ফাতেমা জিন্না প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছিলেন, “এই নির্বাচন মুসলমান ভোটারদের উচিত কমিউনিস্ট ও হিন্দু ষড়যস্ত্রকারীদের প্রতিহত করতে মুসলিম লীগের প্রার্থীদের নির্বাচিত করা”।
দেশভাগের পর ভারত যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সেক্যুলার রাষ্ট্র সেখানে ফাতেমা জিন্নার এই ধরণের বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক বা ঘৃণামূলক মনে করার মত জাতীয় কোন নেতাই পাকিস্তানে ছিলো না। কারণ এখানে মুসলিম জাতীয়তাবাদ এমনভাবে চর্চা হয় যে সেখানে হিন্দু ও ভারতের ষড়যন্ত্রকে বিশ্বাস না করলে আপনি পাকিস্তানে বা মুসলিম জাতিতে কি করে বিশ্বাস রাখবেন? যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর শেরে বাংলা কোলকাতা সফরে গিয়ে দুই বাংলার সংস্কৃতি ঐক্য অটুট থাকবে এরকম কথার কথা বলে ব্যক্তিগত সফর শেষ করে পাকিস্তানে ফেরার আগেই তিনি এদেশে রীতিমত ভিলেন হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ শেরেবাংলা হিন্দুয়ানী শিরকের সঙ্গে মুসলমানদের ঐক্য অটুট থাকার কথা বলেছেন...।
সেক্যুলার ভারত সেই ঘোর পাকিস্তান আমলে মুসলমানদের নিজের দেশ পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য রাতদিন ষড়যন্ত্র করছে- এখানকার মুসলিম জাতীয়তাবাদী উভয় পক্ষই সে বিষয়ে একমত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগেও এখানে প্রচন্ড ভারত বিরোধীতার মূলে ছিলো সাম্প্রদায়িক জাতি ভাবনা। তাই এখন যারা বলছেন বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে মোদীকে না ডেকে তাদের প্রেসিডেন্টকে ডাকলে তাদের কোন আপত্তি ছিলো না- এরাই আসল গিরগিটি! কারণ চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এলে এদের খুঁজেও পাবেন না! ইউঘুর মুসলিমদের কথা যেমন পাকিস্তানের ইমরান খান জানেনই না তেমনি বাংলাদেশের মোদি বিরোধীরাও চীন মিয়ানমারকে দেখতে পান না সময় মত। কারণ এখানে মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মরে যাবে হিন্দু ও ভারতকে কমন শত্রু বানাতে না পারলে। বাংলাদেশে হেফাজত ইসলামের মত ইসলামিক মৌলবাদ যেমন আছে তেমনি জুনায়েদ সাকি, ভিপি নূরদের নতুন ‘মুসলিম লীগ’ হয়ে উত্থান সেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ জন্মের সময়কার আবহই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
#সুষুপ্ত_পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................