আমি তাদেরই একজন।

আমি তাদেরই একজন :
-------------------------------
আমার ফেসবুকের এক প্রবাসী বন্ধু লিখেছিল যে, তুরস্কে মানুষজন বেশ বেশি সংখ্যায় ইসলাম ত্যাগ করছেন। সেই পোস্টে আমার আরো এক বন্ধু কমেন্ট করেছে, আগামী ২০০ বছরের মধ্যে ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
না এই ব্যাপারটাতে আমার কোন সন্দেহ নেই, তবে সেটা দুশো বছরে হবে না পঞ্চাশ বছরে হবে সেটা আমি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারি না, কিন্তু বন্ধু আপনার কমেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে, আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন আছে। এই ধর্ম নামক বস্তুটি বিলুপ্ত হওয়ার আগে আর কত নিরীহ মানুষের প্রাণ যাবে, সেটা বলতে পারেন কি ? আজকের বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সকল ধর্মকেই কি এক কাতারে ফেলা যায় সহিংসতার পরিমাপে ? নাকি দৃষ্টিভঙ্গির দাড়িপাল্লার ব্যালেন্স কাটায় কাটায় এক রাখতে, এটি একটি সচেষ্ট প্রক্রিয়া ? এই একই প্রশ্ন যদি ১৯৫০ এ পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিত বেঁচে যাওয়া কোন হিন্দুর কাছে আজকের রাখি. তিনি কি উত্তর দেবেন, পাঠক জানেন নাকি ? চলুন উত্তরের পিছনে সত্যির একটু অনুসন্ধান করি:

১৯৫০ এ পূর্ব পাকিস্তানের জেলায় জেলায় বাঙালি মুসলমানের একতরফা হিন্দু নিধন একটা প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছিল। কোন জেলার মুসলমান এতে এক নম্বরে আসবে, সেটাই ছিল দেখার বিষয় ! ঢাকা-বরিশাল, চট্টগ্রামের পরে সিলেটের হিন্দুদের ওপর নেমে এসেছিল চরম বিভীষিকা। চারিদিকে গন্ডগোল হচ্ছে, হিন্দু নিধন চলছে এবং হিন্দুদের উপর অত্যাচার করলে যে কোন শাস্তি হবে না, এরকম একটা পূর্বাভাস সিলেটের মুসলমানবাসীর কাছে ছিল, তাই হিন্দুর রক্তে হাত রাঙ্গাতে তারা কালবিলম্ব করেনি। এই প্রক্রিয়াতে ডেপুটি কমিশনার মিঃ নোমানী ও হবিগঞ্জের এসডিও র প্রত্যক্ষ মদত ছিল। ২২ শে জানুয়ারি ১৯৫০ হবিগঞ্জের কোর্ট রুমে হঠাৎ করে আগুন লেগে গেল, রটিয়ে দেওয়া হল আগুন লাগিয়েছে হিন্দুরা, যেখানে কিনা সংখ্যালঘু হিন্দু দেশ বিভাজনের পরে সর্বদাই আতঙ্কে থাকত পাকিস্তানে ! ব্যাপারটা কল্পনা করাটাও হাস্যকর। রটানো হল হিন্দুরা পাকিস্তানের শত্রু, তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়, তাই এই সমস্ত কাজ করছে। ২৩ তারিখ,এক জনসভার ঢাকা হল, সেখানে মুসলিম নেতারা উত্তেজিত বক্তব্য রাখলেন: হিন্দুর রক্তে প্রতিশোধ নিতে হবে এইসব কর্মের- এই ছিল তাদের বক্তব্যের সারমর্ম। শুনে সভায় উপস্থিত হিন্দু জনগন থরহরি কম্পমান। একে তো উত্তেজিত বক্তব্য, তার উপরে চারদিকে থমথমে পরিবেশ, সভা শেষ হতে না হতেই বাঙালি মুসলমান ঝাঁপিয়ে পরলো হিন্দুর
উপরে ! সশস্ত্র আনসার ও মুসলমান জনতা কাউকে রেহাই দিল না, এমনকি মহিলাদেরও নয়। হবিগঞ্জ মহকুমার কংগ্রেসের পৌর সভাপতি প্রবীণ নেতা সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসকে নির্মমভাবে কোপানো হল, মাথার বহু স্থানে ক্ষত, কোমরের বিশাল ছুরির আঘাত, হাতের তিনটি আঙুল খুইয়ে তিনি চিকিৎসাধীন হলেন। সভায় একপ্রস্থ হিন্দু কোপানো শেষ হলে পরে, বাঙালি মুসলমান এবার রাস্তায় নামল। সামনে যে হিন্দুকে পাওয়া গেল তাকে অকথ্য মারধর নয়তো অবধারিত কোপানো। সিলেটে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ৯২ বছরের দীরেন্দ্রনাথ দত্তও বাদ পরলেন না ! ঘরে ঘরে হিন্দুরা তখন আতঙ্কে, কখন আক্রমণ হয়। এবারের শুরু হলো সরকারি মদতে হিন্দু দমন। পুলিশ এসে হিন্দুদের বাড়িতে বাড়িতে খানা তল্লাশি চালালো। অচিরেই প্রায় ৩০০ জন গ্রেফতার হল, যাদের মধ্যে ছিল উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, যুবক, অনেকেই। হিন্দু ঘরগুলি প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পরলো, বাড়ির মহিলারা চূড়ান্ত আতঙ্কে ! কেউ কেউ মহিলাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু বৃথা চেষ্টা ! হবিগঞ্জ থেকে বেরোনোর মাত্র এক রাস্তা ছিল, আর সেই রাস্তার মুখে মোটরস্ট্যান্ড আটকে পাহারায় আনসার বাহিনী। ২৩ শে জানুয়ারির ঘটনা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবকটা সংবাদপত্রে লুকোনো হয়েছিল ! কোন প্রতিকার নেই কোন বিচার নেই। বিচার পেতে ঢাকায় যেতে হবে, তাই ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীরে সুরেশবাবু ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করলেন। আইন পরিষদের সভায় যদি হিন্দুদের অবস্থা জানিয়ে প্রতিকার চাওয়া যায় এই আশায়। এবার ইএসডিও নিজেই এসে তাকে বাধা দিল, যাতে সে থানা যেতে না পারে। হবিগঞ্জের ঘটনা কিছুতেই বাইরে যেতে দেওয়া হবে না ! ৫ই ফেব্রুয়ারি পরিষদের মিটিং এর আগের দিন রাত্রি দশটায়, সুরেশবাবুকে গ্রেফতার করে জেলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ওনার সাথে জেলে পচতে থাকলেন ধীরেন্দ্র দত্ত, হীরেন্দ্রলাল দাস চৌধুরী, বীরেশ্বর চক্রবর্তী, অরুন দাস চৌধুরীরা। চমৎকার পরিকল্পনা পাঠক, কি বলেন ?

আগামী ৫০ বছরে না আগামী ২০০ বছরে ধর্ম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমি সঠিক বলতে পারব না, তবে আজ থেকে বহু বছর আগেই ঘটে যাওয়া পূর্বপাকিস্তানে এই মানুষগুলোর উপর নির্মম নির্যাতনের কথা ও তদুপরি দেশত্যাগের ইতিহাস আমি পড়েছি, আর তাই লিখে আপনাদের জানাচ্ছি। পড়তে পড়তে প্রতিটা মুহূর্ত আমার মনে হয়েছে, আমি যেন সেই দিনে ফেরত গেছি, তাদেরই একজন........

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted