ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মিথ্যা নিয়ে আজ কিছু লিখব। ইংরেজ আমলে মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিলো, মুসলমানরা ছিলো সব গরীব, হিন্দুরা মুসলমানদের বাঙালী বলে স্বীকার করত না... এই ভাষ্যগুলি আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাসে এমনভাবে ছিলছাপ্পা মারা যে এর বিপরীতে প্রমাণ দেখালেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তা বিশ্বাস করুক বা না করুক, সত্য লিখে রাখা যখন দায় তখন সেটাই করা উচিত।
১৮৮২ খিস্টাব্দে ৩ ফেব্রুয়ারি ভারতবাসীর শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ধারণ করতে গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপন একটি কমিশন গঠন করেন উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে। সেই কমিশনে মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে নবাব আবদুল লতিফ লিখিতভাবে কমিশনকে জানান, “নিম্নশ্রেণীর মুসলমান” যারা জাতিগতভাবে হিন্দুদের থেকে পৃথক নয় তাদের জন্য শিক্ষা গ্রহণ বাংলা ভাষায় চলতে পারে তবে সে ভাষায় হিন্দু প্রভাবিত সংস্কৃতি ভাষার পরিবর্তে আরবি ফারসি শব্দ বেশি করে দিয়ে বাংলা ভাষার আদল পরিবর্তন করতে হবে। আর উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমান যারা আরবি তুর্কি ইরান থেকে আসা মুসলিম বিজেতা, শাসনকর্তা, ধর্মগুরু আলেম ইত্যাদি শ্রেণীর বংশধর তাদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ প্রশ্নই আসে না। তারা উর্দু ফারসিতে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করবে। তারা যে বাঙালী নয় সেকথা আবদুল লতিফ কমিশনের কাছে সাফ জানিয়ে দেন।
মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুরা পাশাপাশি বসবাস করে মূলত এই আত্মপরিচয় মুসলমানদের কাছ থেকে জেনেই মুসলমানদের যদি তারা বাঙালী মনে না করে থাকে তাহলে দোষটা কাদের? অথচ শরত চন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসে “বাঙালী ছেলেদের সঙ্গে মুসলমান ছেলেদের ফুটবল খেলা” লাইন পড়ে আহত হয়েছিলেন কাজি মোতাহার হোসেন। আজো হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমদের সম্পর্কে কমবেশি এরকম ধারণা রয়ে গেছে। একই সঙ্গে নবাব আবদুল লতিফের মত আত্মপরিচয় থেকেও তো মুসলমানরা বেরিয়ে আসেনি। তাহলে দোষটা তাদের ঘাড়ে পড়ছে?
শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা ও গরীব পরিচয় পুরোটাই ধাপ্পা। প্রথমত মুসলমান উচ্চশ্রেণীর আবদুল লতিফদের সংখ্যা ভারতবর্ষে নেহাত কম ছিলো না। জমিদার হিসেবে তাদের প্রভাব ও প্রতাপ ছিলো অনেক। গরীব কৃষক হিন্দু মুসলমান দুই জা্য়গাতেই তো সমান ছিলো। শিক্ষাদীক্ষায় তারাই পিছিয়ে ছিলো। উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর মুসলমানরা সবাই শিক্ষিত ছিলো। কিন্তু তারা অচল শিক্ষা মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে উনিশ ও বিংশ শতকে পিছিয়ে পড়েছিলো ভারতবর্ষের অন্য সম্প্রদায় থেকে। কিভাবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে হিন্দুদের উপর নিজেদের পিছিয়ে থাকার দোষ দেয়া হয়েছে তার একটি উদাহরণ দেই। বিদ্যাসাগরের জন্মের আট বছর আগে মারা যান ইতিহাস বিখ্যাত দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসীন। এই ধনী মানুষটি তার সমস্ত সম্পত্তি উইল করে যান শিক্ষা খাতে। ১৯৩০ খিস্টাব্দে মহসীনের ফান্ডের অর্থ দাঁড়ায় অকল্পনীয়, ৫১,০০০ টাকা! সে যুগে এটা বিপুল বিশাল অর্থ। এই অর্থ দিয়ে হুগলি কলেজে বিনা খরচে লেখাপড়া চলত। কিন্তু মুসলমান নেতারা দেখললেন স্কুল কলেজে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের পিছনে কেন আমরা অর্থ ব্যয় করতে যাবো? হাজি মুহাম্মদ মহসিন যদিও তার উইলে শিক্ষা বিস্তারে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলের জন্য তার অর্থ খরচ করতে উল্লেখ করে গিয়েছিলেন, তবু নবাব আবদুল লতিফ মহসীন ফান্ড যাতে হিন্দুদের জন্য এলাও না হয় তার জন্য মুসলিম জনমত ক্রমশ উত্তেজিত করে তুলতে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে সরকার ১৮৭২ খিস্টাব্দে হুগলি কলেজ থেকে মহসীন তহিবল তুলে নেয়। সেই অর্থে পরে হুগলি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে একটি করে মাদ্রাসা তৈরি করা হয় মুসলমান ছেলেদের লেখাপড়া করার জন্য। এই যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ফেলে কুরআন হাদিস উর্দু ফারসি শিখে পিছিয়ে পড়া, তার জন্য কি করে হিন্দু বা ইংরেজ সরকার দায়ী হন? মাথাটা একটু খাটান। কাদের দোষ দিচ্ছেন? নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিজেরা বেছে নিয়ে যদি পিছিয়ে পড়েন তার দায় কার? ভারত স্বাধীন হবার পরও মুসলমানদের শিক্ষানীতি কি হবে সেই প্রশ্নে মুসলমানরা মাদ্রাসা শিক্ষা বেছে নিলো। উল্টো দিকে নেহরু বাকী ভারতবর্ষের জন্য আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা বেছে নিলেন। টোল উঠিয়ে দিলেন। অপরদিকে স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা ব্যাঙের ছাতার মত মাদ্রাসা বানালো তাদের শিক্ষার জন্য। নেহরু যদি সকলের জন্য একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করত তাহলে স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা দাঙ্গা বাধিয়ে দিতো। এটাকে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখত। তাদেরকে কুরআন হাদিস থেকে দূরে রাখার জন্য এটাকে হিন্দুদের চক্রান্ত বলত। কাঁচি দিয়ে এভাবেই নিজের পশ্চাদেশ কেটে ইহুদীদের, হিন্দুদের, ইংরেজদের দায়ী করা এই সম্প্রদায় আজো এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। আত্মপরিচয়ে আজো তাদের কিবলা আরব তুর্কি ইরান। এখনো তারা তুর্কি প্রেসিডেন্টের খোমা দেখলেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাস নামের ভিনজাতি হানাদারদের গর্বে গর্বিত হয়। ভারতবর্ষকে, যদি শুধু বাঙালী মুসলমানদের কথাই বলি, বাংলার নিজের সব কিছুকে অস্বীকার করে আরবি তুর্কিদেরকে নিজেদের নিজস্বতা বলে তাদের সকল কিছু গ্রহণ করে আত্মহনন আজো চলমান। এখনো বাঙালী মুসলমান আরবি তুর্কি ফারসি নাম রেখে দাবী করে এটা তাদের নিজস্বতা!
এখানে মুসলমানদের আত্মহননে সঙ্গে কিঞ্চিত বামপন্থি ঐতিহাসিকদের দায় আছে এটা না বললে অসম্পূণ থেকে যায়। ভারতীয় বাম ঐতিহাসিকরা তাদের ইতিহাসে মুসলমানদের এই আত্মপরিচয়, মুঘল তুর্কি আফগান শাসকদের নিজেদের পূর্বপুরুষ জ্ঞান করে যে ভারতের সঙ্গে একটা শেকড়হীনতার মনস্তত্ব অনুভব করে তার সমালোচনা না করে উল্টো মুসলিমদের শাসন ও তার উত্তরাধিকার সাজা সম্প্রদায়িক পরিচয়কে বাহবা দিয়েছে। কল্পিত মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার জন্য হিন্দু ও ইংরেজদের দায়ী করেছে। এগুলো করে মুসলমানদের কোন লাভ হয়নি। অন্যকে দোষ দিয়ে তো তারা নিজেদের এগিয়ে নিতে পারেনি। কারণ তারা জানেই না কোথায় তারা পিছিয়ে। তাদের আসল শত্রু যে তারা নিজেরা এটা যারা দেখিয়ে দিচ্ছে তারাই একালের "ইসলাম বিদ্বেষী" "মুসলিম বিদ্বেষী"!...
#সুষুপ্তপাঠক
#susuptopathok
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................