যে মানুষটা ছিলো বলেই আজ আমরা বেঁচে আছি………

যে মানুষটা ছিলো বলেই আজ আমরা বেঁচে আছি………

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি! পরকীয়া করে ধরা বউয়ের হাতে ধোলাই খাওয়া এক দিল্লিনিবাসী প্রোফেসর দেখলাম শ্যামাপ্রসাদের ছবি বিকৃত করে পাতা জুড়ে হাবিজাবি লিখে গেছে শ্যামাপ্রসাদকে কেন পশ্চিমবঙ্গের স্রস্টা বলা যাবে না সেই নিয়ে।  মানে একটা স্বঘোষিত বাঙ্গালীবাদী কতবড় অতৃপ্ত প্রেতাত্মা হয়ে গেলে বাঙ্গালী হিন্দুর হোমল্যান্ড  পশ্চিমবঙ্গের জন্ম নিয়ে কিছু উদযাপন না করে একজন মনীষীর ছবি বিকৃত করে নোংরামি করতে পারে! 

যাকগে‚ আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য ওই কর্তিতসঙ্গমী প্রোফেসর না। তবে কিছু হিন্দুত্ববাদী‚ যারা এখনো ওর আসল চেহারা চেনে না তারা কয়েকজন একটু ভড়কে গেছে দেখলাম। যে সত্যিই শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের জনক কিনা এই নিয়ে…………

তাদের উদ্দেশ্যে জাস্ট এইটুকুই বলব যে বিধবা বিবাহের প্রস্তাব তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর্। কিন্তু তা আইনে পরিণত করেছিল ব্রিটিশ সরকার।  তাই বলে ব্রিটিশ সরকারকে কেউ বিধবা বিবাহের জনক বলে না।

দক্ষিন আফ্রিকায় ২৭ বছর জেলে বন্দী ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই সময়কার আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই তার কোনো ভূমিকা ছিলো না‚ কিন্তু তাও তার মুক্তির পর তাকেই জাতির জনক বানিয়েছিল আফ্রিকানরা। কারণ ম্যাণ্ডেলার আদর্শেই সেই ২৭ বছর সেখানে আন্দোলন চলেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই শেখ মুজিব পাকিস্তানে ছিলো। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রটাও মুজিব পড়তে পারেননি। কিন্তু তাই বলে মুজিবের বাংলাদেশের জাতির পিতা হওয়া আটকায় না। সেখানে কেউ মুজিবের ফটো বিকৃত করে নোংরামি করে না। কারণ পুরো মুক্তিযুদ্ধই চলেছিল মুজিবের দেখানো পথ ধরে।

চীনে সান ইয়াৎ সেনের পার্টি কুওমিনটাং এর সাথে সরাসরি রক্তক্ষয়ী লড়াই করে ক্ষমতায় এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। অর্থাৎ সান ইয়াত সেনের দল ছিলো কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু। কিন্তু তাই বলে একদলীয় শাসন চলা চীনেও সান ইয়াত সেনের আটকায়নি 'আধুনিক চীনের জনক' আখ্যা পাওয়া। কারণ চীনের আধুনিকীকরণ শুরুই হয়েছিল সান ইয়াত সেনের হাত ধরে। যারই ফলাফল বর্তমানের এই সুপার পাওয়ার চীন। 

মোদ্দা কথা হলো এই যে আমরা মানুষ‚  জন্তু জানোয়ার না। জন্তু জানোয়ারদের ভেতর সেই নেতা হয় যে সবথেকে ভালো লড়াই করে। আর মানুষের ভেতর সেই নেতা হয় যে পথ দেখায়‚ যে আদর্শের জন্ম দেয়‚ যে উদ্বুদ্ধ করে।  আর ঠিক এই কারণেই বাকি জীবদের ছাড়িয়ে শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছে মানুষ। সে শারীরিক উপস্থিতির থেকেও আদর্শিক বা বৌদ্ধিক উপস্থিতিকে আগে জায়গা দেয়। একজন বাঙ্গালী হাজার বছর আগে জন্মানো শশাঙ্ককে স্মরণ করে উদ্বুদ্ধ হতে পারে কিন্তু একটা বুনো কুকুরের নেতা একমাত্র তার দলের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাটাই। এই জন্যেই মানুষের আদর্শ আছে‚ জন্তুজানোয়ারের নেই।

শ্যামাপ্রসাদের ব্যাপারে বলি। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুর জন্যে পশ্চিমবঙ্গ তৈরির ধারণাটাই এসেছিল শ্যামাপ্রসাদের হাত ধরে। এবং অবশ্যই অবশ্যই হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরে। অন্যরা ভারত ভাগ নিয়ে মশগুল ছিলো। পাকিস্তান ভাগ নিয়ে ভেবেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। তবে শ্যামাপ্রসাদ শুধু সবার প্রথমে ধারণাটুকুই দেননি‚ নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাকে সাফল্যমন্ডিত করার লক্ষ্যেও লড়ে যান।

 
২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার গোরক্ষপুর অধিবেশনে দেশভাগে সময় ‘স্বধর্ম রক্ষার কারণে রক্তস্নানের জন্যে’ হিন্দুদের প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন এল. বি. ভোপটকর। মহাসভা এই উদ্দেশ্যে একটি কমিটিও গঠন করে ফেলে। অর্থাৎ দেশভাগ হলে হিন্দুদের কি হবে‚ তারা নবগঠিত পাকিস্তানে কিভাবে বাঁচবে এইসব ভাবনাচিন্তা প্রথম এসেছিল হিন্দুত্ববাদী শিবির থেকেই। এবং বলে রাখা উচিৎ যে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ । নেহেরু তখন ক্ষমতার ভাগাভাগিতে মত্ত ছিলো। দেশ ভাগ হলে তার মৃতদেহের উপর দিয়ে ভাগ হবে বলেও দেশভাগের সময় বহাল তবিয়তে জ্যান্ত ঘুরঘুর করছে গান্ধী। কমিউনিস্টরা তাদের 'অধিকারী থিসিস' অনুসারে ভারতকে আরও কয়েকভাগে ভাগ করা যায় কিনা সেই ধান্দায় ব্যস্ত। একমাত্র হিন্দুদের ভালোমন্দের কথা ভাবছে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা।

১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন এবং তিনি প্রচণ্ড বেগে সারা বাংলা চষে বেড়াতে লাগলেন এবং বড় বড় জনসভায় ভাষণ দিয়ে মানুষকে বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে লাগলেন। তিনি কংগ্রেসের কাছে আবেদন রাখলেন যে, তারাও যেন এই দাবিকে সমর্থন জানায়। পাকিস্তান ভাগের উদ্দেশ্যে ১৯৪৭-এর ১৫ই মার্চ কলকাতায় হিন্দু মহাসভা একটি দু’দিন ব্যাপী আলোচনা সভার আয়োজন করে।  এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হল যে বাংলা প্রদেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠন করতে হবে। এই সভায় একটি কমিটিও গঠিত হল যাদের কাজ হবে একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করা যা সরকারের কাছে পেশ করা হবে।

এরপরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সাতচল্লিশের এপ্রিল মাসে বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার তারকেশ্বর অধিবেশন। সেখানে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাগকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার এই অধিবেশনে গোটা বাঙ্গালা থেকে ৪০০ জন প্রতিনিধি  উপস্থিত ছিলেন। দর্শক ছিলো ৫০ হাজার। সেই অধিবেশন। সভাপতি হিসাবে ভাষণে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন,

"it is a question of life or death for the Bengali Hindus. " - অর্থাৎ বাংলা ভাগ হলো "বাঙালি হিন্দুর মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন"। 

কিছুদিন পরে দিল্লীতে গিয়ে একটি সভায় শ্যামাপ্রসাদ জানিয়ে দিলেন, পাকিস্তান যদি নাও হয়, তাহলেও বাঙলার হিন্দুদের জন্য একটা আলাদা প্রদেশ চাই: Even if Pakistan is not conceded….we shall demand the creation of a new province composed of the Hindu majority areas in Bengal.

অর্থাৎ দেখুন‚  সাতচল্লিশের গোড়াতেও. কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ অন্যদের মতো ভারতভাগের কথা বলছেন না; কিন্তু হিন্দুদের বাঁচানোর জন্যে মুস*মান প্রধান বাংলা ভাগ করে হিন্দুদের হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ তাঁর চাই। 

১৯শে মার্চ ১৯৪৭-এ এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন :

//“প্রদেশটি যে গুরুতর সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে বাংলার বিভাজন। এর ফলে যে যে অঞ্চলে বাংলার দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য আছে সেখানে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিকশিত করার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে, তারা উভয়ই শীঘ্র উপলব্ধি করবে যে, দুটি (প্রস্তাবিত) প্রদেশে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উভয়েরই স্বার্থের অনুকূল হবে”// 
    [Lar, 1947,1, 48; quoted in Gordon, Brothers against the Raj, 574-5]।

এছাড়াও ঘোষণা করে আসলেন যে গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে পাঠানোর চক্রান্তের প্রতিবাদ স্বরূপ ২৩ শে এপ্রিল বাংলা বনধ পালন করা হবে। সেই বনধ স্বতস্ফুর্তভাবে পালিত হয়েছিল। যদিও স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্ট পার্টি সেই বনধে অংশ নেয়নি। 

সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘শনিবারের চিঠি’-র ১৩৫৩ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় লেখা হয় – ‘

//‘সম্প্রতি বাংলার কয়েকজন নেতা, পশ্চিমবঙ্গ নামে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করে এই সমস্যার সমাধানে প্রয়াসী- কারণ বাংলার লীগ শাসনাধীনে, বাঙ্গালী হিন্দুর ধন, প্রাণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, নারীর মর্যাদা বিপর্যস্ত। সম্মেলন স্বতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবী জানাইতেছে। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ, মেজর জেনারেল এ সি চ্যাটার্জি, ডঃ প্রমথনাথ বাঁড়ুজ্জে প্রমুখ ব্যক্তি এই আন্দোলনের কার্যকরী সমিতির সদস্য, সুতরাং চেষ্টার ত্রুটি হইবে না।’’//

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল পত্রিকাতে পাকিস্তান ভাংতে চাওয়ার কারিগরদের নামের তালিকায় শ্যামাপ্রসাদের নামটি দেখুন এবং সবার প্রথমেই নামটি আছে দেখুন। উন্মাদসংমী প্রোফেসরটির শ্যামাপ্রসাদকে করা নোংরামি এক নিমেষে এখানেই ধূলিস্যাত হয়ে যায়। 

এরপর ১৯৪৭-এর ২৩-এ এপ্রিল শ্যামাপ্রসাদ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে একটি বৈঠক করে তাঁকে বুঝিয়ে বলেন কেন বাংলা ভাগ করা দরকার। এই পরিকল্পনা বোঝানোর জন্য তিনি প্রচুর দলিল-দস্তাবেজ এবং মানচিত্র তৈরি করেন এবং নিজের দায়িত্বে বড়লাটের আপ্তসহায়ক লর্ড ইসমে-র কাছে সেসব দিয়ে আসেন। 

ওহ হ্যাঁ‚ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই একবার‚ ১৯৪৭-এর ১৩ই মে শ্যামাপ্রসাদ সোদপুরে গান্ধীর সাথে দেখা করেন বাংলা ভাগ করার প্রসঙ্গে। গান্ধী তাকে এই ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। 

বাংলাভাগ চেয়ে প্যাটেলের কাছেও শ্যামাপ্রসাদের চিঠি লিখেছিলেন পয়লা মে, ১৯৪৭

কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী রাজ্যপাল ফণিভূষণ চক্রবর্তীও  লিখেছেন যে, 

//শ্যামাপ্রসাদ তাঁর সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাব প্রতিরোধ করতে সমর্থ হলেন এবং দেশভাগের ভিতর আরেকটা দেশভাগ করিয়ে দিলেন।//

এছাড়াও পরবর্তীতে শ্যামাপ্রসাদ নিজেও দাবি 
করেন যে 

// কংগ্রেস ভারত-বিভাজন করেছিল আর আমি করেছিলাম পাকিস্তান-বিভাজন” // [Balraj Madok, “Dr Shyamaprasad Mookerjee”, in S.P.Sen (ed), Dictionary of National Biography, III, Calcutta, 1974, 173]।

যাকগে। ওই টাকলুকে বেশী পাত্তা দেওয়া বৃথা। এমনিতেই এখন বাংলাপক্ষের কয়েকজন ছাড়া আর কেউ পুঁছেও দেখে না। তাও যদি সেই পোস্টে ইসলামী বিরোধী কিছু না থাকে তবেই।  বাকি সব পোস্টে নিজেরই দামোদর - তিতাস - তিস্তা - ব্রহ্মপুত্র নামের ফেক অ্যাকাউন্ট দিয়ে নিজেই নিজেকে সাবাশি দিয়ে যায়। আদর্শ আত্মনির্ভর যাকে বলে আরকি। 

স্রেফ ওই ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদের ছবি বিকৃত করে নোংরামি করতে দেখেই তথ্যগুলো দিয়ে রাখলাম হিন্দুত্ববাদীদের জন্য। আর কিছুই না।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted