৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী এবং অকৃতজ্ঞতা :
-------------------------------------------------------------
বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ পরবর্তী জাতীয়বাদের অন্য পরিচয় 'ভারত বিদ্বেষ' । পাকিস্তানকে ভাঙতেই নাকি ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্পৃত্ত হয়েছিল, এই মনোভাব অধুনা বাংলাদেশের ৬০% র বেশি মানুষের অন্তরে লালিত, যতই তারা মুখে অস্বীকার করুক । ইতিহাসের সত্য এত ঠুনকো নয় যে, একটি ভূখণ্ডের অধিকাংশ মানুষের অকৃতজ্ঞতায় তা ভেঙে চুর চুর হয়ে যাবে । শত চেষ্টা করলেও, এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থান নেয়া প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী উদ্বাস্তুর খরচে দরিদ্র ভারতের তখন ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল, সাথে ছিল নকশালবাড়ির আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চাপ । ৯৩০০০ বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীর জন্য কোনো বাজেটই ছিলোনা ভারত সরকারের, তবুও পাকিস্তানী যুদ্ধ বন্দিদের জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী রেখেছিলো ভারত । শেখ মুজিবর রহমান তখন পাকিস্তানী জেলে বন্দি, ফাসীর আদেশে দণ্ডিত । ভারতে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানী এত সৈন্যের বিনিময়ে কাস্মীর ইস্যুকে সমাধান না করে ইন্দিরা গান্ধী কেন রাজী হয়েছিল যুদ্ধবন্দী বিনিময়ে, কি এমন তাগিদ ?
বাংলাদেশ ও ভারতের ১০০ কোটি মানুষের এই ভুখন্ডে তখন বিভিন্ন দেশের সামরিক নেতাদের প্রক্সি যুদ্ধ চলছে । নিরব যুদ্ধে মগ্ন ইন্দিরা নজর রাখছিলো সবদিকেই । ইন্দিরা বুঝেছিল, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপুর্ন থেকে যাবে আর তাই মনে মনে তার চাহিদা ছিল যে কোনো মুল্যে শেখ মুজিবের মুক্তি ।
কথাটা ইন্দিরা “কিচেন কেবিনেট’এর অন্যতম (RAW)’-এর প্রধান রাম নাথ কাওকে জানিয়েছিল । পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে, শেখ মুজিবের সেলের সামনে একটি সাড়ে ৬ ফুট লম্বা কবর খুঁড়েছে আর সেই কবরের ওপরে ঝুলিয়ে দিয়েছে ফাসির দড়ি, সেটা ইন্দিরা ভালোই জানতো । দ্বি-জাতি তত্বকে ভুল প্রমান করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পাকিস্তান মেনে নিতে পারেনি ! ইয়াহিয়া ওয়াশিংটন থেকে ডেকে পাঠালো ভুট্রোকে । ভুট্রো তখন জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে । ইয়াহিয়া (CMLA) করে দ্বায়িত্ব বুঝে নিতে বললো ভুট্রোকে আর ভুট্রো ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে পাকিস্তানের দিকে দৌড়োলো আমেরিকার রাস্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে আগে ফোন করে নিয়ে । ওয়াশিংটন থেকে রাওয়ালপিন্ডি ভুট্রোর ফ্লাইট, মাঝে হিথরো এয়ারপোর্টে রিফুয়েলিং । গোয়েন্দা সূত্রে খবর জেনে গেল ইন্দিরা আর ‘ওয়ার কেবিনেটে’র জরুরী মিটিং ডাকল । মিটিং এ ছিল এক্সটার্নাল এফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের চিফ দুর্গা প্রসাদ ধর, (RAW)’-এর প্রধান রাম নাথ কাও, প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ সহকারী পি এন হাকসার এবং বৈদেশিক সচিব টি এন কাউল । পি এন হাকসারের বাড়িতে সেই সময়ে যুদ্ধবন্দী হিসেবে থাকতো মুজাফফর হুসেইন, যে পুর্ব পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সরকারী কর্মচারী হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিল । মুজাফফরের বিবি লায়লা লন্ডন ঘুরতে গিয়ে আটকা পরে গেছিলো ৩রা ডিসেম্বরে ভারত পাকিস্তানের সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যাওয়াতে । ইন্দিরা এটা জানত যে লায়লা ছিল ভুট্রোর একসময়ের প্রেমিকা আর ভুট্টোর তখন লায়লার প্রতি দুর্বলতা ছিল । এদিকে মুজাফফর হুসেইন ও লায়লার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল লন্ডনে ডিপ্লোমেট হিসেবে কর্মরত শশাঙ্ক ব্যনার্জি । শশাঙ্ক ব্যানার্জি এক্সটার্নাল এফেয়ার্স এর দুর্গা প্রসাদ ধরের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে, হিথ্রোর ভিআইপি রুমে লায়লাকে ভুট্টোর সামনে বসিয়ে দিলো তার স্বামী ভারতে আটক মুজাফফর হুসেইনকে ছাড়াবার একটা উপায় বার করতে । পাঠক, 'আসলি পিকচার বাকি থা' । এই মিটিংয়ের ব্যাকডোরে খেলা হয়ে গেল এই উপমহাদেশের এক মহা কূটনৈতিক চাল ! লায়লার স্বামীকে ছাড়াতে ভুট্টো কথা দিলো দিল্লিকে সে অনুরোধ করবে, এবং বদলে এই অঙ্গীকার করলো যে, পাকিস্তানের দায়িত্ব বুঝে নেবার পরপরই সে শেখ মুজিবকে মুক্ত করবে । মিটিং থেকে বের হয়ে শশাঙ্ক ব্যানার্জি, ইন্দিরাকে মেসেজ পাঠিয়ে দিলো । আশ্বাসের অফিসিয়াল কনফার্মেশনের জন্য ইন্দিরা পাকিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় দুতাবাসকে নির্দেশ দিল, দুতাবাস ফিরতি রিপোর্টে আশ্বাসকে কনফার্ম করার সাথে সাথে বুদ্ধিমান ইন্দিরা এটাকে ডিপ্লোম্যাটিক বার্তা হিসেবে প্রচার করে দিলো । শেখ মুজিবের মুক্তি হওয়া পর্যন্ত ইন্দিরাকে ভুট্টোর উপরে বিশ্বাস করেই চলতে হয়েছিল, তাই শেখের মুক্তির বিনিময়ে যখন অনুরোধ আসে ৯৩০০০ হাজার পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দীকে মুক্ত করার, ইন্দিরা সেই অনুরোধ রেখেছিলো, যে কোনো সম্মানই আরো বড় সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হয়, এটাই রাজমন্ত্র হয়ে উঠেছিল সেদিনের ।
পাকিস্তানের ৯৩০০০ যুদ্ধবন্দীদের জীবনের বিনিময়ে কাশ্মীর সমস্যার পাকাপাকি সমাধান না হাসিল করে সেদিন ইন্দিরা তথা দিল্লী বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি হাসিল করেছিল । ভারতের কাশ্মীর সমস্যা গ্যাংগ্রিন হিসেবে রয়েই গেছে, প্রায় রোজই হিংসাত্মক ঘটনায় মানুষের প্রাণ যায় সেখানে । পাঠক সত্য এটাই যে :
"ভারত পাকিস্তানকে ভাগ করতে বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল" ।
রেফ : https://thewire.in/diplomacy/the-untold-story-behind-indira-gandhis-decision-to-release-93000-pakistani-pows-after-the-bangladesh-war
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................