শারদীয়া অন্তরীপে পার্থ দে-র “দেশ হারিয়ে যায়" উপন্যাসটি পড়লাম। নামকরণ আর প্রচ্ছদ দেখে শুরুতে একটু ভয় ছিল কারণ উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বাঙলায় লেখা তো কম না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রতিভা বসুর লেখা থেকে থেকে শুরু করে মনোজ মিত্রের একের পর এক নাটকে উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে দেশ হারানোর হাহাকার বারবার উঠে এসেছে। বাঙলা সাহিত্যে এই থিম নিয়ে লেখা এত যে প্লট, ইমোশন ও ডায়লগের পুনরাবৃত্তি হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। পড়তে গিয়ে মনে হয় যে যেন আগে পড়া উপন্যাসগুলোর একটা ছায়া পাচ্ছি।
তবে পার্থ দে-র উপন্যাস শুরু হচ্ছে ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে কাশ্মিরের যতরতবাল দরগায় গচ্ছিত রাখা হযরত মহম্মদের দাড়ি চুরি হওয়ায় কিভাবে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লাগছে আর সেই দাঙ্গার রেশ কিভাবে সূদূর পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে সেই নিয়ে। দাঙ্গায় বাঁচতে দুই প্রতিবেশী শশধর আর চিন্তাহরন কোনোরকমে বর্ডার পেরিয়ে শিয়ালদার দিকে রওয়ানা দেয় পরিবারসহ। চিন্তাহরনের মেয়ে মীরা আর শশধরের ছেলে ঘনশ্যামের মধ্যে তখন কিশোর বয়সের প্রেম। কিন্তু রাস্তায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চিন্তাহরনের পরিবারের জায়গা হল মধ্যপ্রদেশের উদ্বাস্তু কলোনিতে আর শশধরের পরিবার পুলিশকে এড়িয়ে চলে এল যাদবপুর।
এরপরেই প্লটে মোচড়। যে গল্প প্রেমের ও উদ্বাস্তু সমস্যার হাত ধরে এগোচ্ছিল তা হঠাৎ জড়িয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সাথে। কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, নকশাল আন্দোলন, জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছুঁয়ে গল্প এগিয়ে চলে ১৯৭৮ সালে মরিচঝাঁপির ঘটনার দিকে। তার মধ্যে কোথাও কি হারিয়ে যায় মীরা আর ঘনশ্যামের সম্পর্ক? নাকি ওরা আর ঘটনাচক্রে ফিরে পায় তাদের জীবনের প্রথম প্রেম?
লেখকের সবচেয়ে বড় গুন অতিরিক্ত আবেগ না দেখানো। দেশভাগ, দাঙ্গা ও মাটি হারানো নিয়ে দু' বাঙলার আবেগ অনেক। সেখানে লেখকও যদি কোনো এক চরিত্র বা ঘটনাকে নিয়ে লেখায় আবেগ ঢেলে দেন, তাহলে থমকে যায় প্লট। এই উপন্যাসের গল্প এগিয়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অতিরিক্ত মেদ নেই কোথাও। কাশ্মির, খুলনা, মধ্যপ্রদেশ, মরিচঝাঁপি ও যাদবপুর মিলিয়ে প্রায় ৪৭ বছরের কিছু ঘটনাকে এক সুতোয় বাঁধতে পারা কম কৃতিত্বের নয়। বেশ ভালো লেগেছে এই উপন্যাসটি পড়ে।
@সুমন্ত্র ঘোষ
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................