উদ্বাস্তু
--------------
১৯৪৬ সালে ১৬ই অগাস্টে কলকাতার ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ সর্ব প্রথমে,পূর্ববাংলার শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের পূর্ববাংলা ত্যাগের কথা ভাবতে শুরু করিয়েছিলো । পাঠক অবাক হবেন জেনে যে, জিন্না ডিসেম্বর মাসে লণ্ডনে এক ব্রিটিশ মন্ত্রীকে বলে, ‘কলকাতায় দাঙ্গা বাধিয়েছিল হিন্দুরাই’, আর এতে করে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দুরা যেমন অবাক হয়েছিল, তেমনই চিন্তিত হয়েছিল তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ।
মাউন্টব্যাটেন দেশ ভাগের প্রসঙ্গে গান্ধীকে জানিয়েছিল : “… it was the last thing (partition) I wanted to do – and don’t forget Direct Action Day in Calcutta which was the warning of what he could do. I mean he killed 5,000 people and wounded 15,000 people just as demonstration, and I think he has the capacity to cause civil war…!” সম্ভ্রান্ত এই হিন্দুদের অনেকেই সে যুগে তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা ও কাজের জন্য পশ্চিমবাংলায় পাঠিয়ে দিতেন, অবশ্য তখনও সাধারণ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র, অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত হিন্দুদের পক্ষে জন্মভূমি ছেড়ে আসার কথা চিন্তা করা সম্ভব ছিল না । তাদের পক্ষে যেমন দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব ছিল তেমনই অধিকাংশ হিন্দু যারা পূর্ববাংলার মাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে পরেছিলেন তারা প্রথম ধাক্কাতেই ‘দেশ’ ছাড়ার কথা ভাবেনি । তাছাড়া দু এক বারের দাঙ্গায় নিজের সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চিরদিনের মতাে চলে আসা তাদের কাছে খুব সহজ ব্যাপার ছিল না ! নিপীড়িত হলেও জন্মভূমির প্রতি তাদের মমত্ব তাদের জীবন ও ধর্মের মতােই গভীর ছিল ।
১৯৪৬ এর আগস্টের দাঙ্গার রক্তের দাগ শুকোতে না শুকোতেই পূর্ববাংলার হিন্দুরা ১৯৪৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে আবার এক ভয়ঙ্কর দাঙ্গার শিকার হয়েছিল নোয়াখালীতে । নােয়াখালির একজন বাসিন্দা অমৃত বাজার পত্রিকার সাংবাদিককে বলেছিল : ‘সেখানকার ৯৫ শতাংশ হিন্দু ইতিমধ্যে চলে গেছে। সে সেখানে পরে থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না । হিন্দু বাবুরা সবাই এভাবে দেশ ছেড়ে চলে আসায় তাদের উপর নির্ভরশীল নিম্ন সম্প্রদায়ের হিন্দুরা বেকার হয়ে পরেছে । তাদের পক্ষে সেখানে পরে থাকার অর্থ মৃত্যুর সামিল !’ নােয়াখালি দাঙ্গার পর থেকেই কিছু কিছু হিন্দু পশ্চিমবাংলায় আসতে শুরু করেছিল । পূর্ববাংলার হিন্দুরা লীগের নেতৃত্বে কলকাতায় ১৯৪৬ এর ১৬ই আগস্টে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দাঙ্গা দেখেছিল, ছেচল্লিশে নােয়াখালি ও ত্রিপুরার হিন্দু নিধন যজ্ঞও দেখেছিল কিন্তু তবু অনেকেই আশা করেছিল যে, আর যাই হােক, শেষ পর্যন্ত দেশভাগ অর্থাৎ পৃথক পাকিস্তান হবেনা, কারণ গান্ধী নিজে কথা দিয়েছে যে, দেশ ভাগ হলে তার মৃতদেহের উপর দিয়ে ভাগ হতে হবে ! মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাঁওতাতে যখন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ ভেঙ্গে মুসলিমদের জন্য পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হল তখন পূর্ববাংলার সংখ্যালঘুরা ভীষণ অসহায় হয়ে পরে, দেশনেতাদের কথায় ভরসা রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পরলো । পৃথক পাকিস্তান মানে তাে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ববাংলা এখন থেকে মুসলিমদের জন্য হয়ে গেল !
পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের চলে আসার একটা প্রধান কারণ ছিল পাঞ্জাবী পুলিশ, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এবং গুণ্ডাদের হামলা ও হুমকি । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববাংলার হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্মভূমি পরিত্যাগের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় । তখন পূর্ববাংলা থেকে সদ্য আগত এক ডাক্তারের ভাষ্যে : ‘বগুড়া জেলায় পরিচিত এক মুদি দোকানে গিয়ে এক বস্তা সরু চাল কিনলেন । প্রতিবেশি কালু মিঞা সেই চালের বস্তাটি নিতে চাইল। কেননা দোকানে যেহেতু মাত্র এক বস্তা চালই আছে, তাই কালু মিঞাকেই তা দিতে হবে ! ডাক্তার ভদ্রলােক বললেন, তিনি সেই চাল কিনে দামও মিটিয়ে দিয়েছেন, “কাজেই সেটা কি করে হয়?” কালু মিঞা নাকি হুঙ্কার দিয়ে বলল : “আলবৎ হয়।একি হিন্দুস্থান পেয়েছ? বলে জোর করেই বস্তাটা কেড়ে নিয়ে চলে গেল ।’
শ্রীহিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “নিজের ভিটেমাটি কেউ সহজে ত্যাগ করে না। এরা যে করেছে, তা বাধ্য হয়েই করেছে। এরা ভদ্ৰশ্রেণীর উন্নত রুচির মানুষ। এদের অপমানবােধ তীক। তাই অত্যাচার চরমে ওঠবার আগেই, যখন তা মানসিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ তখনি তারা চলে এসেছে। এইসব ভেবে আমার মন সেদিন আশঙ্কায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম- হায় ভগবান, শুরুতেই এমন হল, পরে না জানি কি দাঁড়াবে।”
আজকের বাংলাদেশে বহুলাংশ বাঙালি মুসলমান হিন্দু ‘দাদাবাবু’ দের ইন্ডিয়া চলে যাওয়া নিয়ে টিটকারি করে, দাদাবাবুরা নাকি এক পা ইন্ডিয়াতে বাড়িয়েই আছে ! এই সকল পূর্ব ইতিহাস, তাদের বাপ দাদাদের ধর্মীয় অন্ধত্বের ক্রিয়াকলাপ সমন্ধে তারা জানেও না, আর জানানোর সকল রাস্তা রাষ্ট্র মদতে বন্ধ করে রাখা হয়েছে । অতএব দাদাবাবুরা দেশত্যাগী কেন, সেটা অন্বেষণ তাদের মগজের বাইরে…………………
রেফ : শ্রী হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘উদ্বাস্তু’ ।
শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার, “বাংলাদেশের ইতিহাস’ ।
L. Collins & d. Lapierre, Mountbatten and the Partition of India, Vol. I.
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................