*বৌদ্ধরাই জাতবাদের (caste system) প্রবক্তা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের জনক- পর্ব-৪*
বর্তমান আলোচনায়, আমার তৃতীয় প্রস্তাব –
*৩। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন যে ‘বুদ্ধ’ শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বংশজাতই হতে পারেন । এই তত্ত্বই, নিম্নবর্ণের ওপর উচ্চবর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যবাদের জন্ম দিয়েছে; অর্থাৎ বৌদ্ধরাই ব্রাহ্মণ্যবাদের জনক ও প্রবক্তা *
এই পর্বে, ওই তৃতীয় প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করবো গ্রন্থ-প্রমাণ সহকারে ।
বৌদ্ধরা ‘বুদ্ধ’র উপাসক (হিন্দুরা এবং জৈনরাও ‘বুদ্ধ’র উপাসক), কিন্তু ‘বুদ্ধ’ আসলে এক ব্যক্তি নন, ‘বুদ্ধ’ এক মহা-চেতনা যা প্রকাশিত হয়েছে, হয় এবং হতে পারে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত মানুষের মধ্যে । একই যুগে একই সময়ে একাধিক ‘বুদ্ধ’ থাকতে পারেন (যেমন, গৌতম বুদ্ধ ও নিগন্থ মহাবীর বুদ্ধ সমকালীন) । কিন্তু যে ‘বুদ্ধ’ একই সঙ্গে ধর্ম শিক্ষা দেবেন এবং সঙ্ঘ গড়বেন, তিনিই পূর্ণ ‘বুদ্ধ’; আর যে ‘বুদ্ধ’ নিজের ‘বুদ্ধত্ব’ সত্ত্বেও, ধর্ম শিক্ষা দেবেন না এবং সঙ্ঘ গড়বেন না, তিনি ‘প্রত্যেকবুদ্ধ’ বা ‘পচ্চেকবুদ্ধ’ । পূর্ণ ‘বুদ্ধ’ বহু যুগের ব্যবধানে জন্মান, এবং একই ‘কল্পে’ কতজন ‘বুদ্ধ’ জন্মাবেন, তা পূর্ব নির্দিষ্ট । [এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে, ‘কে’ এমন পূর্ব নির্দিষ্ট করে দিল? ঋগ্বেদে ‘ক’-সূক্ত আছে – ‘কে’ বা ‘কি’? সুতরাং যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না কিন্তু প্রশ্নর মাধ্যমে ধর্ম, বিজ্ঞান ও সত্য সন্ধান করেন, তাঁরাও বৈদিক । প্রশ্ন বা ‘ক’ তাঁদের দেবতা । অন্য প্রসঙ্গ হয়ে যাবে, তাই বিস্তারিত না গিয়ে জানিয়ে রাখি, নাস্তিকতাও বৈদিক । এ কথাও জানিয়ে রাখি, গৌতম বুদ্ধকে ও বৌদ্ধদের ‘নাস্তিক’ বলা আর একটি অপপ্রচার । বৌদ্ধরা নিজেদের সব সময়েই ‘আস্তিক’ বলেছেন এবং অ-বৌদ্ধদের ‘নাস্তিক’ বলেছেন । আস্তিক এবং নাস্তিক আপেক্ষিক ‘লেবেল’। তাছাড়া গৌতম বুদ্ধ এবং বৌদ্ধরা দেব-দেবী ব্রহ্ম পুরুষ – সবই বিশ্বাস করতেন । সে প্রসঙ্গেও বিস্তারিত আসবো ।]
বৌদ্ধ মতে, ‘বুদ্ধ’ আসলে মানবরূপে প্রকাশিত ‘বুদ্ধগণ’। ‘বুদ্ধ’ চেতনাই যে উপাস্য ও অর্জনের লক্ষ্য, তা বোঝানোর জন্য ‘শূন্যতা’ উপাসনা করা হত । শুরুতে বুদ্ধর কোন মূর্তি ছিল না । উদাহরণ, অশোক নির্মিত বলে কথিত সাঁচি স্তূপের ভাস্কর্যে, বুদ্ধের আসন শূন্য । ‘নিরাকার বুদ্ধ’ সময়ের সাথে প্রথম ‘সাকার বুদ্ধ’ হয়েছেন, প্রধানত গান্ধার শিল্পে এবং তার প্রভাবে । ঐতিহাসিকদের মতে, এটি ঘটে কুষান আমলে । অর্থাৎ, আজ যে ‘সাকার বুদ্ধ’ উপাসনা করা হয়, তিনি ‘বুদ্ধগণের’ প্রতীক – ‘বহুর’ প্রতীক ‘এক’ । সাকার বুদ্ধের যদি পরিচয় দেয়া থাকে, বা সেই ভাস্কর্যে ও অঙ্কনে যদি কোন কাহিনী ব্যক্ত হয় যা কোন বিশেষ বুদ্ধর সাথে যুক্ত (যেমন, ইন্দনেশিয়ার বরবুদুরে), তবেই বোঝা যায়, তিনি কোন ‘বুদ্ধ’। বোঝা না গেলে, তিনি ‘বুদ্ধগণ’, যদিও তাঁকে ‘এক’ অবিচ্ছিন্ন ‘বুদ্ধ’ রুপে প্রকাশ করা হয় । কালক্রমে আবার এই ‘এক’ হয়ে গেছেন ‘গৌতম বুদ্ধ’ ।
‘হিন্দু বনাম বৌদ্ধ’ – এই সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক প্রচারমূলক গল্পে, উপরোক্ত সত্যটি গুলিয়ে দেয়া হয়েছে এবং হয় । অর্থাৎ ‘হিন্দু বনাম বৌদ্ধ’ – এই গল্পে আসলে যা প্রচার করে এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষের মগজধোলাই করা হয়েছে, তা হল ‘বৈদিক হিন্দু ধর্ম বনাম গৌতম বুদ্ধ’। গল্পটি যে খুব নিচু দাগের, তার প্রমাণ, বৈদিক হিন্দুরাও বুদ্ধর উপাসক, গৌতম বুদ্ধকে ভগবান জ্ঞানেও শ্রদ্ধা করে [এই গল্পটি আমরা আরও পরীক্ষা করবো ।]
[এই প্রসঙ্গে এই ঘোষণা করে রাখলাম যে আমার কোন বক্তব্যই সাধারণীকরণ (generalization) নয় । ব্যক্তিক্রম (exception) থাকেই, সুতরাং বিশেষকে সাধারণ মনে করা (taking particular as general) সব থেকে বড় কুযুক্তি । লেখার কলেবর বৃদ্ধি হবে, তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে এ কথা আর আলাদা করে উল্লেখ করবো না । পাঠক/ পাঠিকা লেখকের এই স্পিরিট বুঝবেন, আশা রইলো ।]
এবার লক্ষ্য করুন, এই ‘বুদ্ধগণের’ বৌদ্ধ তত্ত্ব, বৈদিক হিন্দু পুরাণের অবতারবাদের মতই ।
মনে রাখা দরকার, ‘অবতার’ শব্দ এবং হিন্দু অবতারবাদ বেদে নেই – ঋগ্বেদ থেকে বেদান্ত কোথাও নেই । শব্দটি এবং ধারণাটি (যিনি অবতীর্ণ হয়ে, ভূভার অবতরণ করেন বা হরণ করেন তিনিই 'অবতার’।) প্রথম পাওয়া যায় মহাভারতে । গীতায় কৃষ্ণ বলছেন ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’। পুরাণে অনেক মত আছে । ১০ অবতার অধিকাংশ পুরাণে আছে, কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে ২৪ অবতার । মানব উপ-পুরাণে ৪০ অবতার । শিখ গুরু গ্রন্থ সাহিবে ২৪ অবতার । সেখানে আবার শিব, দেবী ও ব্রহ্মার অবতারের কথাও আছে । অবতার গণেশের হতে পারে (যেমন, মুদ্গল পুরাণ, গণেশ পুরাণ)। আবার পৌরাণিক মতে, মহেশ্বর ও মহাদেবীও অবতীর্ণ হন । লিঙ্গ পুরাণে শিবের ২৮ অবতার; আবার অন্য কিছু পুরাণে, শিবের ২৪ অবতার ।
হিন্দু ধর্ম ‘যত মত তত পথ’ বিশ্বাস করে । সুতরাং যার যা ইচ্ছা সে মত গ্রহণ করতে পারে । নাও পারে । যারা অবতারবাদে বিশ্বাস করবেন, তাঁরা মহাভারত ও পুরাণের আশ্রয় নেবেন । আবার যারা অবতারবাদে বিশ্বাস করবেন না, তাঁরা বেদের আশ্রয় নেবেন – সেখানে, বিশেষ করে বেদান্তে, প্রত্যকে মানুষই স্বরূপত ব্রহ্ম, সুতরাং সেই অর্থে, শক্তি ও আধারের তারতম্যে, সব মানুষই অবতার । [‘অমুক এক্কেবারে অবতার’ – এ কথাটা বাংলায় হামেশাই মজা করে বলা হয় । সেই মজার মজা হল, বেদান্তর দৃষ্টি থেকে তার সত্যতা আছে ।]
হিন্দু ধর্মে আব্রাহামিয় রেলিজিওনের গল্প (narrative) চলে না । কেউ যদি অপপ্রচার করে, মোহম্মদ হলেন ‘শেষ অবতার’ কল্কি, তার ধান্দাবাজি অনায়াসে খণ্ডন করা যায়, সেই অপপ্রচারকারিকে এই বলে ও প্রশ্ন করে –
১। বেদে অবতারবাদ নেই
২। কৃষ্ণ বলেছেন ‘শেষ’ বলে কিছু নেই
৩। মোহম্মদ যদি হিন্দুদের শেষ অবতার হন, তাহলে তিনি কোন ‘শেষ’ অবতার? গণেশেরও তো শেষ অবতার আছে । তাহলে তিনি কি গণেশের অবতার?
৪। ভবিষ্য পুরাণ শুধু যে বহু পরবর্তী অ সবথেকে বেশী ‘জল- মেশানো’ পুরাণ তাই নয়, এখানে মোহম্মদের উল্লেখ নেই । এখানে যার নাম আছে তিনি ‘মোহমদ’ । ‘মোহ’ আর ‘মদ’ ষড়রিপুর দুটি রিপু । ‘মোহমদ’ নামের সংস্কৃত নিরুক্তের সাথে আরবি নিরুক্ত ‘মোহম্মদের’ কোন সম্পর্ক নেই ।]
[এই কথাগুলি এখানে বলতে হল, কারণ কিছু মৌলবাদী, মানুষকে টুপি পড়িয়ে কনভার্ট করার জন্য এই সব ননসেন্স প্রচার করে । এর বিপরীতে, স্বাভাবিক উদার হিন্দু ধর্মে, মোহম্মদের ও ইসলামের প্রতি ‘সব রেলিজিওন শ্রদ্ধেয়’ এই নীতিতে, এমনিতেই শ্রদ্ধা আছে । ভারত সেই কারণেই সেকুলর দেশ । কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ, যেখানে আব্রাহামিয় রেলিজিওনের মানুষ মেজরিটি, তারা সেকুলর নয় । উদাহরণ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ।]
অবতারবাদের মূল বক্তব্য ও যৌক্তিক দর্শন আসলে কৃষ্ণের দর্শন - ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ – অর্থাৎ, যে কোন যুগে যে কোন স্থানে মানুষের ও ধর্মের প্রয়োজনে মহামানব জন্মগ্রহণ করেন (কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বা পূর্ব নির্দিষ্ট কিছু নেই) । এখানে ‘শেষ’ অবতার বলেও কিছু নেই ।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন: “Let us, therefore, find God not only in Jesus of Nazareth, but in all the great Ones that have preceded him, in all that came after him, and all that are yet to come. Our worship is unbounded and free. They are all manifestations of the same Infinite God. They are all pure and unselfish; they struggled and gave up their lives for us, poor human beings. They each and all suffer vicarious atonement for every one of us, and also for all that are to come hereafter.”
আবার পড়ুন – ‘all that are yet to come’! ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন ভবিষ্যদ্বাণী চলে না ।
বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক, বৌদ্ধরা কৃষ্ণের বানী ও পৌরাণিক মত উভয়ই গ্রহণ করেছে – অর্থাৎ অনির্দিষ্ট ও নির্দিষ্ট সংখ্যক মহামানব - উভয়ই । ‘অবতার’ শব্দের পরিবর্তে বৌদ্ধ মতে ‘বুদ্ধ’। কল্কির মত, বৌদ্ধদের ভবিষ্যৎ বুদ্ধ হলেম মৈত্রেয় । আবার কল্কি অবতারের যেমন অনেক দাবীদার হয়ে গেছে [বাস্তবিক, আমাদের চার পাশেও প্রচুর অবতার গিজগিজ করছে), মৈত্রেয় বুদ্ধের অনেক দাবীদার ছিল এবং আছে । আব্রাহামিয় রেলিজিওনেও এরকম ভবিষ্যৎ প্রফেটের কল্পনা আছে । যা দেখা যাচ্ছে, এই কল্পনা সার্বজনীন । যারা বিশ্বাস করে ‘বিপ্লব আসিবেক’ – সেও এক ধরণের রেলিজিয়াস বিশ্বাস, যেন ‘Waiting for Godot’ (Samuel Beckett-এর বিখ্যাত নাটক)।
এইভাবে, বৌদ্ধ মতও ‘যত মত তত পথ’ হয়ে উঠে, তার বৈদিক শিকড় ও সত্ত্বাকেই পুনরাবিষ্কার করেছে । যারা ‘হিন্দু বনাম বৌদ্ধ’ গল্প বানিয়ে বৈদিক হিন্দু ধর্মের ঐক্য নষ্ট করতে চায়, তাদের কাছে এই উদার বৌদ্ধ মত খুবই কষ্টের । তাই, ‘আদি বৌদ্ধ বনাম মহাযান বৌদ্ধ’ – এরকম আর একটা গল্প বানিয়ে মহাযানী বৌদ্ধমতকে ভিলেন বানানর চেষ্টা আছে । সে প্রসঙ্গে আসবো ।
বৈদিক হিন্দুরা ‘বুদ্ধ’-কেও ‘অবতার’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, আবার বৌদ্ধরাও ‘অবতার’ শব্দ গ্রহণ করেছে । উদাহরণ – ললিতবিস্তারে (৩য় শতক, সাধারণাব্দ) ‘অবতার’ শব্দ আছে ।
নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘বুদ্ধ’ না অনির্দিষ্ট সংখ্যক? গৌতম বুদ্ধের মতও উভয়ই ।
মহাপদান সুত্তে (দীঘ নিকয় ১৪), গৌতম বুদ্ধ নিজের পূর্ববর্তী ছয় বুদ্ধের নাম ও বর্ণনা দিয়েছেন । গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে, এনাদের বলা হয় সপ্ত- তথাগত [মনে রাখতে হবে, জৈন মতে, মহাবীরও ‘তথাগত’] । এনাদের প্রথম তিনজন – বিপসসি, সিখি ও বেসসভু - হলেন পূর্ব কল্পের বা ব্যুহ কল্পের ৯৯৮, ৯৯৯ ও ১০০০-তম বুদ্ধ, এবং তার পরের চারজন – কাকুসন্ধ, কোনগমনো, কশ্যপ ও গৌতম - হলেন বর্তমান কল্প বা ভদ্র কল্পের ১, ২, ৩ ও ৪-তম বুদ্ধ । (অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধ হলেন সব মিলিয়ে ২৭-তম এবং বর্তমান কল্পের ৪-তম বুদ্ধ)।
মহাপদান সুত্ত অনুযায়ী, এই সপ্ত বুদ্ধের ‘বর্ণ পরিচয়’ বা গোত্র – সকলেই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় -
১। বুদ্ধ বিপসসি – ক্ষত্রিয় – ক্ষত্রিয় রাজা বন্ধুমা ও রানী বন্ধুমতীর পুত্র
২। বুদ্ধ সিখি – ক্ষত্রিয় – ক্ষত্রিয় রাজা অরুণ ও রানী প্রভাবতীর পুত্র
৩। বুদ্ধ বেসসভু – ক্ষত্রিয় – ক্ষত্রিয় রাজা সুপ্পতিত ও রানী যশবতীর পুত্র
৪। বুদ্ধ কাকুসন্ধ – ব্রাহ্মণ – ব্রাহ্মণ অগ্নিদত্ত ও ব্রাহ্মণী বিশাখার পুত্র
৫। বুদ্ধ কোনগমন – ব্রাহ্মণ – ব্রাহ্মণ যন্নদত্ত ও ব্রাহ্মণী উত্তরার পুত্র (অশোকের শিলালিপিতে এনার নাম আছে । অশোক একমাত্র এই বুদ্ধকেই নাম করে উল্লেখ করেছেন)
৬। বুদ্ধ কশ্যপ – ব্রাহ্মণ – ব্রাহ্মণ ব্রহ্মদত্ত ও ব্রাহ্মণী ধনবতীর পুত্র
৭। গৌতম বুদ্ধ – ক্ষত্রিয় – ক্ষত্রিয় রাজা সুদ্ধোধন ও রানী মায়ার পুত্র
এছাড়া, ভবিষ্যৎ বুদ্ধ, মৈত্রেয় বুদ্ধের কথা আছে ‘চক্কবত্তী সিনহনাদ সুত্তে’ (দীঘ নিকয় ২৬)। ‘বুদ্ধবংশ’র অধ্যায় ২৭-এও তাঁর কথা আছে । তিনিও ব্রাহ্মণ বর্ণ ।
সুতরাং, গৌতম বুদ্ধের মতেই দেখা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বর্ণ ছাড়া ‘বুদ্ধ’ হন না ।
‘বুদ্ধবংশ’র (খ্রিষ্ট পূর্ব ২য়-১ম শতক) অধ্যায় ২৭-এ, এই বুদ্ধদের পূর্বে আরও ২১ জন বুদ্ধের কথা আছে । তাঁরা অন্য কল্পের । কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরাও সকলেই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় –
১। তনহঙ্কর – ক্ষত্রিয় [রাজা সুনন্দ ও রানী সুনন্দার পুত্র । ১০০০০০ বছর বেঁচেছিলেন]
২। মেধঙ্কর – ক্ষত্রিয় [রাজা সুদেব ও রানী যশোধরার পুত্র । তিনিও রাজা হয়ে ৮০০০ বছর রাজত্ব করেন । ৯০০০০ বছর বেঁচেছিলেন]
৩। সরনঙ্কর – ক্ষত্রিয় [রাজা সুমঙ্গল ও রানী যশোবতীর পুত্র । তিনিও রাজা হয়ে ৭০০০ বছর রাজত্ব করেন । ৯০০০০ বছর বেঁচেছিলেন]
৪। দীপঙ্কর – ব্রাহ্মণ
৫। কোণ্ডনঞ – ক্ষত্রিয় [রাজা সুনন্দ ও রানী সুজাতার পুত্র । তিনি ২৮ হাত লম্বা ছিলেন]
৬। মঙ্গল – ক্ষত্রিয় [রাজা উত্তরের পুত্র । ১৩২ ফুট লম্বা । ৯০০০০ বছর আয়ু]
৭। সুমন – ক্ষত্রিয়
৮। রেবত – ব্রাহ্মণ
৯। শোভিত – ক্ষত্রিয়
১০। অনোমদস্সি – ব্রাহ্মণ
১১। পদুম – ক্ষত্রিয়
১২। নারদ – ক্ষত্রিয়
১৩। পদুমত্তর – ক্ষত্রিয়
১৪। সুমেধ – ক্ষত্রিয়
১৫। সুজাত – ক্ষত্রিয়
১৬। পিয়দস্সি – ব্রাহ্মণ
১৭। অথদস্সি – ক্ষত্রিয়
১৮। ধম্মদস্সি – ক্ষত্রিয়
১৯। সিদ্ধার্থ – ব্রাহ্মণ
২০। তিস্স – ক্ষত্রিয়
২১। ফুস্স – ক্ষত্রিয়
উদাহরণ হিসাবে, শুধু কয়েকজনের আয়ু ও শারীরিক উচ্চতা দিলাম । উৎসাহী পাঠক/ পাঠিকা অন্য বুদ্ধদের বর্ণনা নিজেরা দেখে নিন ‘বুদ্ধবংশ’ পড়ে । সব প্রাচীন বুদ্ধের জীবনকাহিনীতেই মূল সুর একই – বাস্তবতা বর্জিত অতিকথন । যে হিন্দু বিদ্বেষীরা আদা জল খেয়ে প্রচার করে যে বৈদিক হিন্দু ধর্ম মার্ক্স সাহেব কথিত ‘আফিম’, আর তার বিপরীতে বৌদ্ধ ধর্ম হল যুক্তিবাদী, তাদের এজেণ্ডা ফাঁস করার জন্য, এগুলি বিশেষভাবে পড়া দরকার । বাস্তবিক, বৌদ্ধ ধর্মে ‘আফিমের’ চাষ হিন্দু পুরাণগুলিকেও প্রায়ই লজ্জায় ফেলে দেবে ।
আবার কেউ যদি বলেন, ‘বুদ্ধবংশ’ বাদ দেবেন, তা পারা মুস্কিল । কারণ, বৌদ্ধদের ইতিহাস অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে ‘বুদ্ধবংশর’ ওপর ।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আব্রাহামিয় রেলিজিওনেও এরকম ‘আফিমের’ ছড়াছড়ি । বৌদ্ধ মত নিয়ে বর্তমানে আলোচনা করছি, তাই সে বিষয়ে বিস্তারিত যাওয়া বর্তমানে প্রাসঙ্গিক হবে না । আপাতত জানিয়ে রাখি, বেছেবুছে কোন একটি রেলিজিওনের ‘আফিম’ চোখে পড়ল আর অন্য রেলিজিওনের চোখে পড়ল না, ওরকম ‘স্যুডো-সেকুলর-চশমা’ আমার নেই !
[রেলিজিওনের বিষয় ইতিহাস চর্চা করছি । তাই নিজের অবস্থান আবার পরিষ্কার করার জন্য, আগের পর্বের একটি বক্তব্য এখানে আবার দিলাম -
“গৌতম বুদ্ধ আমার কাছে মহামানব, তাই তাঁর বিষয়ে কোন অলৌকিক ও অতিলৌকিক কাহিনী আমি বিশ্বাস করি না । [পৃথিবীর সমস্ত রেলিজিওন বিষয়েই আমার এই চিন্তা পদ্ধতি একই – হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদী, ক্রিশ্চান, ইসলাম – কোন রেলিজিওনের কোন অলৌকিক ও অতিলৌকিক কাহিনী আমি বিশ্বাস করি না ।] এটাও শুরুতে বলে রাখলাম, কারণ কারো রেলিজিয়স সেন্তিমেন্টে কোনরকম সাধারণীকরণ করে আঘাত করার অভিপ্রায় যেমন আমার নেই, তেমনি যুক্তি বুদ্ধির বাইরে গিয়ে কারো অন্ধ বিশ্বাসকে রেলিজিওন ঠাওরানো ও তাই তোষামোদি কথা বলারও বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই । পছন্দ হলে লেখাটা পড়তে থাকুন, না হলে এইখান থেকেই পাশ কাটান ।“]
এই যে সব বুদ্ধই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়, এই কাহিনীর দায় যে মহাযানীদের ঘাড়ে চাপাবেন, তারও উপায় নেই । ত্রিপিটকেই আছে ‘আফিমের’ বীজ (‘চাষ’ বলতে যদি মন না চায়; আর ‘আফিম’ উপমাটি যদি বড্ড বেশী পছন্দের হয়) । উদাহরণ, গৌতম বুদ্ধ ম্যাজিক দেখিয়ে অমবত্থকে নিজ মতে এনেছেন (অমবত্থ সুত্ত, দীঘ নিকয় ৩) । এই সূত্রে দেখা যাচ্ছে, গৌতম বুদ্ধ জিহ্বা দিয়ে নিজের সমগ্র মুখ ছুঁতে পারতেন, এমনকি নিজের কপাল, নসিকা গহ্বর ও দুই কান । গৌতম বুদ্ধের জিহ্বার এই বিশেষ ক্ষমতা বুদ্ধের ৩২ লক্ষণের একটি ।
না । এই ধরণের কাহিনীকে আমি ‘ফ্ল্যাট রেটে’ কখনই ‘আফিম’ বলি না । আমি বলবো রূপক ।
মহাভারতে ব্যাস বলছেন, জিহ্বা অগ্রে বাচ-সরস্বতীর বাস (জিহ্বায়ম বাক সরস্বতী – ক্রিটিকল এডিশন - ১২.২৩১.৮) । যাজ্ঞবল্কের প্রজ্ঞা অর্জনের কাহিনীতেও ‘অগ্নিময়’ জিহ্বা । সুতরাং, গৌতম বুদ্ধের জিহ্বার কাহিনী, আমার মতে এর রূপকার্থ – গৌতম বুদ্ধের জিহ্বার অর্থ প্রজ্ঞার তেজ এবং গভীরতা । মহাভারতে ব্যাসকে বলা হয়েছে ‘সরস্বতীর আবাস’ (ক্রিটিকল এডিশন - ৭.১৩২.৪৩), এবং নারায়ণের জিহ্বা থেকে তাঁর পূর্ব অবতার সারস্বত অপান্তরতম-র জন্ম (ক্রিটিকল এডিশন – ১২.৩৩৭.৩৭-৩৮)। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন তিনি পূর্ব এক জন্মে বেদব্যাস ছিলেন । সুতরাং সেই তথ্যই ফিরে এসেছে, গৌতম বুদ্ধের জিহ্বার রূপকে ।]
বুদ্ধ বংশের ওই ২১ বুদ্ধের তালিকায়, লক্ষ্য করা যাক, ১৬তম বুদ্ধের নাম পিয়দস্সি । আমরা জানি, মৌর্য অশোক ওই নামে শিলালিপিতে ধর্ম প্রচার করেছেন । অর্থাৎ নতুন ধর্ম প্রচারে, অশোকের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তিনিও ‘বুদ্ধ’ হবেন, তাই তিনি নামটি গ্রহণ করেন – এরকম ভাবার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে । (বর্তমান লিখিত বুদ্ধবংশ গ্রন্থটি অশোকের পরের – এমনটাই অনেক হিস্টরিয়ানের মত, কিন্তু ঐতিহ্য প্রাচীন হতে পারে । মৌখিক সাহিত্য পরে লিখিত রূপ পেয়েছে)।
লক্ষ্য করা যাক, ১৯তম বুদ্ধের নাম সিদ্ধার্থ, যা ২৮তম বুদ্ধ গৌতমের নাম বলে প্রচলিত আছে । এই দুই বুদ্ধ মিলেমিশেই বৌদ্ধরা গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থ বুদ্ধ নির্মাণ করেছেন, এই সম্ভাবনা আছে । কারণ গৌতম বুদ্ধের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই, আবার ‘গৌতম’ ও ‘সিদ্ধার্থ’ এই নাম শুধুমাত্র বৌদ্ধ গ্রন্থ উৎস ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না (বৈদিক - পুরাণ, জৈন, গ্রীক, পারস্য, কুষান – কোন সোর্সেই ওই দুই নাম নেই, শুধু ‘বুদ্ধ’ আছে । এমনকি, অশোকের শিলালিপিতে ২৬তম বুদ্ধ কোনগমনের নাম আছে, কিন্তু গৌতম বা সিদ্ধার্থ নাম নেই । পরে আরও বিস্তারিতভাবে এ প্রসঙ্গে আসবো) ।
যাহোক, ত্রিপিটক ও বুদ্ধবংশর প্রমাণে, দেখা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্য বর্ণের ‘বুদ্ধ’ হবার পথ নেই ।
[এ যেন সেই রাজনৈতিক দল, যেখানে সর্বোচ্চ পদ বা প্রধানমন্ত্রীর পদ একটি পরিবারের বিশেষ পদবীর জন্যই সংরক্ষিত, অন্যরা বড়জোর দ্বিতীয়, তৃতীয় বা also ran হতে পারে ।]
সপ্ত বুদ্ধের পরিচয় থেকে দেখা যাচ্ছে, বৈশ্য শূদ্র চন্ডাল পুক্কস বা আধুনিক জাতপাতের রাজনীতিতে যে ‘দলিত’ পরিচয়, তাঁরা কেউই কোনোদিন বুদ্ধ হতে পারেন না; কোন নারী বা ‘অন্য লিঙ্গ’ কোনোদিন বুদ্ধ হতে পারেন না । জাতকের কাহিনীর প্রমাণে বলা যায়, কখনো-সখনো হয়তো বোধিসত্ত্ব হন । কিন্তু বোধিসত্ত্ব হওয়া মানেই ‘বুদ্ধ’ হবার অধিকারী নয়, যতক্ষণ না কোন ‘বুদ্ধ’ তাঁকে সেই আশীর্বাদ করছেণ ।
বৌদ্ধ পরিভাষায়, এক বুদ্ধের অন্য বোধিসত্ত্বকে বুদ্ধ হবার আশীর্বাদকে বলে ‘নিয়থ বিবরণ’ ।
গৌতম বুদ্ধ পূর্বের এক জন্মে বোধিসত্ত্ব ছিলেন, নাম ব্রাহ্মণ সুমেধ । তখন তিনি ৪-র্থ বুদ্ধ দীপঙ্করের কাছে এই নিয়থ বিবরণ পেয়েছিলেন । দেখা যাচ্ছে, নিয়থ বিবরণ পাবার জন্যও বোধিসত্ত্বকে ব্রাহ্মণ ঘরেই জন্মাতে হয়েছে ।
কিন্তু ললিতবিস্তার বলছে (পরিবর্ত ৩, বৈদ্য ১৪) – গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘ন বোধিসত্ত্বঃ হীনকুলেষূপপদ্যন্তে চণ্ডালকুলেষু বা বেণুকারকুলে বা রথকারকুলে বা পুষকসকুলে বা / অথ তর্হি কুলদ্বয়ে এবোপপদ্যন্তে ব্রাহ্মণকুলে ক্ষত্রিয়কুলে চ /’ – অর্থাৎ, বোধিসত্ত্ব কখন চণ্ডাল পুক্কস বেণু রথকর প্রভৃতি হীনকুলে জন্মায় না; বোধিসত্ত্ব সব সময়েই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় কুলে জন্মায় ।
এরপর, গৌতম বুদ্ধ আরো ব্যাখ্যা করছেন – ‘যখন লোকে (পৃথিবীতে, সমাজে) ব্রাহ্মণ প্রাধান্য থাকে, তখন বোধিসত্ত্ব ব্রাহ্মণ কুলে জন্মায়, আর যখন লোকে ক্ষত্রিয় প্রাধান্য থাকে, তখন বোধিসত্ত্ব জন্মায় ক্ষত্রিয় কুলে ।‘
বৌদ্ধ মতে, সকলেই অবশ্য নির্বাণের অধিকারী, ঠিক যেমন বেদান্তে সব মানুষই ব্রহ্ম জ্ঞান ও ব্রহ্ম লাভ করতে পারে । কিন্তু এই যে ‘বুদ্ধত্ব’ শুধু ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের একচেটিয়া রাজত্ব (exclusive domain), এই জাতবাদী সঙ্কীর্ণতাই বৌদ্ধ মতকে মানুষের শ্রদ্ধার আসন থেকে হটিয়ে দিয়েছে, এবং বৌদ্ধ ধর্মের ভূমিকা হয়েছে বৈদিক হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী একগুঁয়ে শিশুর ।
স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছিলেন, “I go forth, to preach a religion of which Buddhism is nothing but a rebel child, and Christianity, with all her pretensions, only a distant echo.”
এমতাবস্থায়, ডাঃ আম্বেদকরের বৈদিক- হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করার জন্য ‘বুদ্ধ নির্মাণ’ ছাড়া উপায় ছিল না । ‘দলিত’ (গৌতম বুদ্ধের ‘দরিদ্র’ অর্থ থেকে সরে এসে আম্বেদকর ‘জাত’ অর্থ করলেন, এবং গৌতম বুদ্ধের মর্যাদা লঙ্ঘন করলেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে) বনাম ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ নামক রাজনৈতিক ন্যারেটিভ নির্মাণ করার জন্য তিনি খোদ ত্রিপিটক সম্পাদনা করলেন ও গৌতম বুদ্ধকেও সম্পাদনা করে মনোমত ‘বুদ্ধ’ নির্মাণ করলেন । এও তো আম্বেদকরের নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদ ।
আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে, সমাজ সংস্কারের আন্দোলনে এবং ভারতের সংবিধান নির্মাণে অন্যতম মস্তিষ্ক হিসাবে ডাঃ আম্বেদকরের মহান ভূমিকা অনস্বীকার্য । তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক ভারতের এক অন্যতম রূপকার ।
[‘মস্তিষ্ক’ হিসাবে আম্বেদকর হলেন ‘ব্রাহ্মণ গুণী’। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সবিতা আম্বেদকর ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে । আম্বেদকরের শিক্ষক ছিলেন মহাদেব আম্বেদকর । তিনি ব্রাহ্মণ । তিনিই আম্বেদকরকে নিজের ব্রাহ্মণ পদবী দেন । তার আগে, আম্বেদকরের পদবী ছিল ‘অম্বাবদেকর’। অর্থাৎ আম্বেদকরের জীবনকাহিনীই বলছে, জাতবাদের অর্থে ব্রাহ্মণ্যবাদ কখনই ভারতবর্ষের সার্বিক বাস্তব নয় ।]
কোন মানুষেরই অন্য কোন মানুষের অন্ধ ভক্ত হওয়া উচিত নয় । এখানেও শ্রী রামকৃষ্ণ আবার প্রাসঙ্গিক । তিনি চাইতেন তাঁর শিষ্যরা যেন তাঁকে পরীক্ষা করে তবেই গ্রহণ করেন । তিনি গুরুবাদ চাননি । তিনি গৌতম বুদ্ধের মত ম্যাজিক দেখিয়ে কারোকে প্রভাবিত করতে চাননি । মাদার তেরেসার মত দূর থেকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে কারো পেটের টিউমার সারিয়ে তাঁর সন্ত (saint) হবার প্রয়োজন হয়নি । জার নিকলাসের নিষ্পাপ শিশু সন্তানদের হত্যা করে, বলশেভিকদের মত তাঁর সমাজ বিপ্লবীর ভেক ধরার প্রয়োজন হয়নি । লেনিনের মত জার নিকলাসের রোলস্ রয়েস চড়ে সর্বহারার মেসিয়া হতে হয়নি । মার্ক্সের মত শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করে আবার পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে গর্জন করতে হয়নি । মার্ক্সের এক বিবাহ বহির্ভূত সন্তান ছিল, যার স্বীকৃতি মার্ক্স আজীবন দেননি ।
আম্বেদকর যে বেদ ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে ‘নির্মিত কাহিনী’ শুনিয়েছেন, তা যে তাঁর ‘নির্মাণ’, তার গ্রন্থ প্রমাণ দেবো, ওনার লেখা থেকে উদ্ধৃত করে আর মূল টেক্সটের সাথে তুলনা করে । ধৈর্য ধরুন ।
আপাতত একটি উদাহরণ দিচ্ছি ।
আম্বেদকর তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন – ‘20. The Buddha did not regard all the Vedic Sages as worthy of reverence. He regarded just ten Vedic Rishis as the most ancient and as the real authors of the Mantras. 21. But in the Mantras he saw nothing that was morally elevating. 22. In his view the Vedas were as worthless as a desert.’ (Buddha and his Dhamma. 1. The Buddha and the Vedic Ṛṣis)
অর্থাৎ আম্বেদকর বলছেন (কোন রেফেরেন্স না দিয়ে), বুদ্ধ নাকি বলেছেন, ‘বেদ হল মরুভূমির মত অপদার্থ ।‘
তাই নাকি?
চলুন ত্রিপিটক খুলি । নিজের চোখে দেখি ।
এই মরুভূমির চিত্রকল্প কোথায় আছে?
খুঁজে দেখলাম, তা আছে তেবিজ্জ সুত্তে (দীঘ নিকয় ১৩)। তবে, মূল টেক্সটের ওই মরুভূমি চিত্রকল্পর অংশের ইংরাজি অনুবাদ হয় ‘waterless desert’, ‘worthless desert’ নয় ।
আচ্ছা ধরে নিলাম, আমার কাছে যে গ্রন্থটি আছে, তাতে এটি মুদ্রণ প্রমাদ । আম্বেদকরের ভুল নয় ।
কিন্তু এই সূত্রে, গৌতম বুদ্ধ কি আদৌ বলেছেন – ‘বেদ হল জলহীন মরুভূমি’?
না !
না, বলেননি ।
আম্বেদকর বিকৃত করেছেন গৌতম বুদ্ধের বানী ।
কি আছে ওই সূত্রে?
ওই সূত্রে, গৌতম বুদ্ধ তাঁর সময়ের কোন কোন জাত-ব্রাহ্মণদের (যারা হৃদয়হীন, পাপী ও সংযমহীন) অন্তঃসার শূন্যতার নিন্দা করেছেন (জাতবাদে বিশ্বাসী যে কেউ যে অন্তঃসারহীন তাতে আমাদেরও সন্দেহ নেই), এবং বলেছেন, ‘এই তিন-বেদজ্ঞানী ব্রাহ্মণদের তিন-জ্ঞান হল জলহীন মরুভূমি …”।
ইংরাজি অনুবাদটিও দিলাম –
'Therefore is it that the threefold wisdom of the Brahmans, wise in their Three Vedas, is called a waterless desert, their threefold wisdom is called a pathless jungle, their threefold wisdom is called perdition!'
সুতরাং গৌতম বুদ্ধ বেদকে ‘জলহীন মরুভূমি’ বলেছেন, এ কথা মিথ্যা ও অপপ্রচার । গৌতম বুদ্ধ নীতিহীন দুশ্চরিত্র ব্রাহ্মণদের বেদ- জ্ঞানকে ‘জলহীন মরুভূমি’ বলেছেন । সেটি গৌতম বুদ্ধের তৎকালীন জাত-ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে ধারণা-সাধারণীকরণ নয় । কারণ, গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্যরা অনেকেই ছিলেন জাত-ব্রাহ্মণ । গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর, তাঁর অস্থি রক্ষা ও ভাগ করেছিলেন এক ব্রাহ্মণ – নাম দ্রোণ । তিনি কিন্তু ‘বৌদ্ধ’ ছিলেন না । অর্থাৎ বৌদ্ধরা আজও যে গৌতম বুদ্ধের অস্থি-স্তূপ উপাসনা করেন, তার কৃতিত্ব একজন জাত-ব্রাহ্মণের ।
গৌতম বুদ্ধ যে ব্রাহ্মণ-গুণহীন কিছু জাত-ব্রাহ্মণের বেদ- জ্ঞানকে ‘জলহীন মরুভূমি’ বললেন, তা যথার্থ । এবং গৌতম বুদ্ধের এই বক্তব্যই তো প্রমাণ যে তিনি বেদব্যাস ও কৃষ্ণর দর্শন ও আদর্শের নতুন রূপকারের ভূমিকা নিয়েছিলেন, যদিও, মহামানব বলেই তাঁর মধ্যেও ‘বুদ্ধত্ব’ বিষয়ে সঙ্কীর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে ।
[এই সঙ্কীর্ণতার আরও প্রমাণ তাঁর মহাবীর ও আজীবকদের সাম্প্রদায়িক সমালোচনা ও ‘আমার পথ একমাত্র পথ’ এই ধরণের দাবী করা । (উদাহরণ – পাসাদিক সুত্ত, দীঘ নিকয় ২৯)]
মহাভারতে, বিশেষ করে গীতায়, বেদব্যাস ও কৃষ্ণ তো এই কথাই বলেছেন যে বেদের শব্দ সমষ্টি মুখস্থ করা ও আওড়ানো বেদ জ্ঞান নয়, বেদের অন্তর্নিহিত ভাব ও অর্থ বোঝাই বেদ জ্ঞান । [ক্রিটিকল এডিশনে, শ্লোক সংখ্যাগুলি হল - Gītā 2.42-46; 2.53; 8.11; 8.26-28; 11.48; 11.53-55; 15.1, 15, 18; Mahābhārata – 5.29; 8.49]
খুব স্বাভাবিকভাবেই গৌতম বুদ্ধ তাই জাতকের কাহিনীতে বলেছেন, তিনি পূর্বের এক জন্মে বেদব্যাস ছিলেন, আর সারিপুত্ত ছিলেন বাসুদেব কৃষ্ণ । আর দশরথ জাতকে বলেছেন, পূর্বের এক জন্মে ছিলেন দাশরথি রাম । [গৌতম বুদ্ধ এইভাবে যেমন রাম ও কৃষ্ণকে আত্মিকরণ করেছেন, জৈনরাও তাই করেছে । বৌদ্ধ ও জৈন মতে রামায়ণ ও মহাভারতের গভীর প্রভাব আলাদা করে আলোচনা করবো ।]
জানুসোনি সুত্তে (অঙ্গুত্তর নিকয় ৮), গৌতম বুদ্ধ ‘তেবিজ্জ’ বা তিন বেদ সম্পর্কে ওই গীতার বেদ সম্পর্কিত কথাই বলেছেন, এবং এও বলেছেন – ‘তমাহম বদামি তেবিজ্জম’ – অর্থাৎ ‘এইভাবে আমি বেদের অর্থ করি ।‘
গৌতম বুদ্ধ বেদ জ্ঞানী ছিলেন । উদাহরণ, সুন্দরিকা ভরদ্বাজ সুত্ত (সুত্ত নিপাত ৩.৪)। এখানে বুদ্ধ বলেছেন তিনি সাবিত্রী মন্ত্র জানেন, এবং মহাবগ্গ ৬.৩৫.১-এ বলেছেন, বেদের মন্ত্রগুলির মধ্যে সাবিত্রী মন্ত্রই শ্রেষ্ঠ । এ কথা মনু স্মৃতি ২.১১৮-তেও মনু বলেছেন । এও স্বাভাবিক, কারণ গৌতম বুদ্ধ নিজেকে মনু বংশীয় বা সূর্য বংশীয় বা ইক্সবাকু বংশীয় বলেছেন ।
শ্বেতকেতু জাতকে (নং ৩৭৭), গৌতম বুদ্ধ বলেছেন তিনি পূর্ব এক জন্মে গৌতম উদ্দালক ছিলেন, এবং তাঁর মুখে বলেছেন ‘বেদ অফল নয়, বেদপাঠে উচ্চাবস্থা লাভ হয়’।
গৌতম বুদ্ধকে যারা বেদ-বিরোধী বলে, তারা আদৌ লেখাপড়া করেছে?
[গৌতম বুদ্ধ ও বেদ – এই আলোচনা বিস্তারিতভাবে আলাদা করে করবো ।]
এখন, আম্বেদকর সেই যে গৌতম বুদ্ধকে নির্মাণ করে, তাঁর মুখে বেদ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বসালেন, সেই রীতি এখনো চলছে । বামপন্থী মার্ক্সবাদী পণ্ডিত ডি।এন।ঝা-কে তাই আম্বেদকরের মতই গৌতম বুদ্ধের ওই কথাকে বিকৃত করতে দেখা যায় । তিনি তাঁর “Brahmanical Intolerance in Early India” লেখায়, আম্বেদকরকে টুকে দিয়েছেন - “Like the Jains, the Buddhists were also hostile to brahmanism. The Buddha himself described the three Vedas as 'foolish talk' and 'a waterless desert', and their wisdom as 'a pathless jungle' and 'perdition'.”
Jha-এর উক্ত লেখার লাইন ধরে ধরে উত্তর দিয়েছি আমার একটি লেখায় । academia. edu -তে সেই লেখাটি আছে । দেখতে পারেন । নাম - D.N. Jha’s Communal Manifesto and Ideology of Utopian Pseudo-Secularism
আম্বেদকরের উক্ত গ্রন্থের মুখবন্ধে, জাস্টিস আর.আর. ভোলে, আম্বেদকরের মৃত্যুকে বুদ্ধের মতই ‘পরিনির্বাণ’ বলেছেন ।
যে মাহার-রা আম্বেদকরের অনুপ্রেরণায় বৌদ্ধ কনভার্ট হলেন, তাঁদের এক অংশ আবার আম্বেদকরকেই ‘বুদ্ধ’ বলে ও উপাসনা করে ।
এও এক পরিহাস । আম্বেদকর ‘দলিত’ ছিলেন, তিনি যদি ‘বুদ্ধ’ হন, তাহলে তা গৌতম বুদ্ধের কথাই অমান্য করা ! কারণ, ত্রিপিটকের ও বুদ্ধবংশের প্রমাণে, ‘দলিত-জাত’ (যখন নিম্নবর্ণের সমার্থক ধরা হচ্ছে) থেকে কেউ কখনো ‘বুদ্ধ’ হতে পারে না ।
১৯৫৬ সালের অক্টোবরে, বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার সময় আম্বেদকর বলেছিলেন, “Hindu religion offers no opportunity for the untouchables to improve there lot, for, it is based on inequality. On the other hand Buddhism is based on equality and justice. . . I would like to see all India become Buddhist.” (উক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১৩-১৪)
উপরোক্ত গৌতম বুদ্ধের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে, এবং বৌদ্ধ ধর্মের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে যে ‘বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব হতে গেলে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় গোত্র-কুল-জাতে জন্মাতে হয়’, এবার তাহলে আমরা কি বলবো?
এবার এই সপ্ত বুদ্ধদের গোত্র দেখা যাক –
১। বুদ্ধ বিপসসি – কোনদন্ন বা কৌন্ডিন্য [বশিষ্ঠ গোত্রের অনু-গোত্র; আর এক মতে অঙ্গিরা অনু-গোত্র]
২। বুদ্ধ সিখি – কোনদন্ন [বশিষ্ঠ গোত্রের অনু-গোত্র]
৩। বুদ্ধ বেসসভু – কোনদন্ন [বশিষ্ঠ গোত্রের অনু-গোত্র]
৪। বুদ্ধ কাকুসন্ধ – কশ্যপ
৫। বুদ্ধ কোনগমন – কশ্যপ
৬। বুদ্ধ কশ্যপ – কশ্যপ
৭। গৌতম বুদ্ধ – গৌতম
দেখা যাচ্ছে, সমস্ত পূর্ব বুদ্ধরাই ঋগ্বেদের ঋষি বশিষ্ঠ ও ঋষি কশ্যপের বংশধর । আর গৌতম বুদ্ধ নিজে ঋষি গৌতমের বংশের বা অঙ্গিরা বংশের ।
অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধ কখনই বৈদিক ঐতিহ্যের বাইরে যাচ্ছেন না । বুদ্ধদের গোত্র পরিচয়ের মাধ্যমে, গৌতম বুদ্ধ দৃঢ় ভাবে নিজেকে বৈদিক রুপে প্রতিষ্ঠিত করছেন ।
ব্রাহ্মণধাম্মিক সুত্তে (সংযুক্ত নিকয় ২.৭), গৌতম বুদ্ধ প্রাচীন ব্রাহ্মণদের ‘আদর্শ ব্রাহ্মণ’ বলেছেন ।
এবার দেখা যাক, গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্য কারা ছিলেন । এখানেও দেখা যাচ্ছে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় প্রেফারেন্স ।
গৌতম বুদ্ধের প্রথম পাঁচ শিষ্য সকলেই ব্রাহ্মণ । এঁরাই প্রথম গৌতম বুদ্ধের ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করে অর্হত হন । তাঁরা হলেন, কৌণ্ডিন্য, অসসজি, ভদ্দিয়া, বপ্প, ও মহানামা ।
এই প্রথম অর্হতরা ছাড়া, গৌতম বুদ্ধের যে প্রধান দশ শিষ্য, তাঁদের প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় । মহাযান সূত্রে, মঞ্জুশ্রি-মূল-কল্পে, ও পালি ভাষ্যে এঁদের নাম পাওয়া যায় । কিছুটা মতভেদ আছে ।
মহাযান মতে, সারিপুত্ত (ব্রাহ্মণ), মৌদ্গল্যায়ন (ব্রাহ্মণ), মহাকাশ্যপ (ব্রাহ্মণ), সুভূতি (বৈশ্য), পূর্ণ মৈত্রায়নিপুত্র (ব্রাহ্মণ), অনিরুদ্ধ (ক্ষত্রিয়), মহাকাত্যায়ন (ব্রাহ্মণ), উপালি (নিম্নবর্ণ নাপিত), রাহুল (ক্ষত্রিয়, গৌতম বুদ্ধের পুত্র) ও আনন্দ (ক্ষত্রিয়) । পালি ডিসকোর্সে, তাঁরা হলেন, সারিপুত্ত, মৌদ্গল্যায়ন, মহাকাশ্যপ, মহাকাত্যায়ন, মহাকোট্টহিত, কফিণ, মহাচুণ্ড, অনিরুদ্ধ, রেবত, আনন্দ, ও দেবদত্ত । মঞ্জুশ্রি-মূল-কল্প মতে, সারিপুত্ত, মৌদ্গল্যায়ন, মহাকাশ্যপ/ গবাংপতি, সুভূতি/ পিণ্ডোলভরদ্বাজ, রাহুল/ পিলিন্দ বতস, নন্দ/ রাহুল, ভদ্রিক/ মহাকাশ্যপ, কফিণ/ আনন্দ ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় না হলে, কেউ গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্যের মর্যাদা পায়নি ।
এখানে যদি যুক্তি দেন, তাঁদের গুণ ছিল বলেই তাঁরা গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্য হয়েছেন, তাহলে শুনুন, ঠিক এই কথাটাই আমি বলতে চাইছি । বৈদিক হিন্দু ধর্মে, গুণ ও কর্মেই ব্রাহ্মণ হয় । হৃদয়ের গুণ থাকলে তবেই প্রকৃত ব্রাহ্মণ হওয়া যায়, এ ঋগ্বেদের কথা । পরে, পঞ্চম বেদ মহাভারতই এ কথা বারেবারে বলেছে ।
ক্রমশ …
ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৭.১০.২০২১
বুধবার
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................