বৈদিক কাল থেকেই,
রাত্রিরূপা কালী পূজিতা
মোহরূপ রাত্রির অবসান একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারাই সম্ভব; অন্য কোন উপায়ে সম্ভবপরনয়। কালও যে স্থানে প্রকাশিত হয় না তাই কালরাত্রি। সত্ত্বগুণের লয়স্থানকে কালরাত্রি বলে; রজোগুণের লয়স্থানকে মহারাত্রি ও তমোগুণের লয়স্থানকে মোহরাত্রি বলা হয়। ঋগ্বেদ সংহিতার 'রাত্রিসূক্তে' রাত্রিরূপা ভুবনেশ্বরী কালীর কথা বর্ণিত হয়েছে। সায়ণাচার্যের ভাষ্য অনুসরণ করে এ রাত্রিসূক্তটির অত্যন্ত সুন্দর, সাবলীল এবং দার্শনিক তত্ত্ব বিধৃত অনুবাদ করেছেন স্বামী জগদীশ্বরানন্দ। তিনি তাঁর 'শ্রীশ্রীচণ্ডী' গ্রন্থের শুরুতেই অনুবাদসহ রাত্রিসূক্ত বিধৃত করেছেন। দেবী রাত্রিই যে দেবী ভুবনেশ্বরী কালী, এ বিষয়টি তিনি তাঁর অনুবাদে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।
ওঙ্কারময়ী সর্বব্যাপিণী ভুবনেশ্বরী রাত্রি দেবী সর্বদেশ তাঁর চক্ষুঃস্থানীয় মহদাদি তত্ত্ব দ্বারা সর্ববস্তুর প্রকাশীকা হয়ে স্বোৎপাদিত সদ্সৎকর্মপূর্ণ জগজ্জাল বিশেষরূপে দর্শন করলেন। অনন্তর সকল জীবের স্ব স্ব কর্মানুরূপ ফল প্রদান করলেন। অমরণধর্মা নিত্যা মহামায়া রাত্রি দেবী বিশ্বপ্রপঞ্চ ও প্রপঞ্চগত উচ্চ নীচ বৃক্ষলতাগুল্মাদি স্বীয় আত্ম-চৈতন্যে পরিব্যাপ্ত করলেন। রাত্রি দেবী সহোদর-স্থানীয়া প্রকাশময়ী ঊষার অবিদ্যার আবরণী শক্তি বিনাশ করেন। ঊষার সেইরূপ অবস্থার মূলাজ্ঞান অপসৃত হয়।দেবী ভুবনেশ্বরী দেবী প্রতি প্রসন্ন হলেই জীব মুক্ত হয়। দেবীর কৃপায় পাখিগণ যেমন বৃক্ষে বাসস্থান স্থাপন করে সুখে রাত্রিবাস করে, সেরূপ জীবও স্ব-স্বরূপে স্থিতিলাভ করতে পারে। কৃপাময়ী ভুবনেশ্বরী রাত্রিদেবীর করুণায় আপামর গ্রামবাসীগণ, গবাশ্বাদি পশু, পক্ষিগণ, কামার্থিগণ এবং শ্যেনাদিও সুখে শয়ন করে।জননি রাত্রিদেবী, অত্যন্ত দয়াবতী। তিনি করুণাপূর্বক জীবকে বিবিধ প্রকারের বাসনারূপ ব্যাঘ্রী ও ব্যাঘ্র-সদৃশ হিংসাকারী পাপসকল থেকে রক্ষা করেন। কামাদি ষড়রিপু নামক তস্করসমূহকে বিদূরিত করে অনায়াসে জীবকে সংসার সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে, পরিশেষে মোক্ষ প্রদান করেন। সকল বস্তুতে অতিশয় সংশ্লিষ্ট কৃষ্ণবর্ণ গাড় নৈশ তমোতুল্য অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে মুক্ত করেন। ঋগ্বেদ সংহিতার রাত্রিসূক্তটি গায়ত্রীছন্দে (৮+৮+৮=২৪ অক্ষর ) লিখিত। এই সূক্তের দ্রষ্টা ঋষি কুশিক। আদ্যাশক্তি জগদম্বার প্রীতির জন্য এ সূক্তটি পাঠ করা হয়।
রাত্রী ব্যখ্যদায়তী পুরুত্রা দেব্যক্ষভিঃ।
বিশ্বা অধিশ্রিয়োঽধিত।।
ওর্বপ্রা অমর্ত্যা নিবতো দেব্যুহদ্বতঃ।
জ্যোতিষা বাধতে তমঃ।।
নিরু স্বসারমস্কৃতোষসং দেব্যায়তী।
অপেদুহাসতে তমঃ।।
সা নো অদ্য যস্যা বয়ং নি তে যামন্ন্যবিক্ষ্মহি।
বৃক্ষেণ বসতিং বয়ঃ।।
নি গ্রামাসো অবিক্ষত নি পদ্বন্তো নি পক্ষিণঃ।
নি শ্যেনাসশ্চিদর্থিনঃ।।
যাবয়া বৃক্যং বৃকং যবয়স্তেনমূর্ম্যে।
অথা নঃ সুতরা ভব।।
উপমা পেপিশত্তমঃ কৃষ্ণং ব্যক্তমস্থিত।
উষ ঋণেব যাতয়।।
উপ তে গা ইবাকরং বৃণীষ্ব দুহিতর্দিবঃ।
রাত্রিস্তোমং ন জিগ্যুষে।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১০.১২৭.১-৮)
"রাত্রিদেবী আগমনপূর্বক চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি নক্ষত্রসমূহের দ্বারা অশেষ প্রকার শোভা সম্পাদন করেছেন।
দেবরূপিণী রাত্রিদেবী অতি বিস্তার লাভ করেছেন, যাঁরা নীচে থাকেন, কি যাঁরা ঊর্ধ্বে থাকেন, সকলকেই তিনি আচ্ছন্ন করলেন । তিনি আলোকের দ্বারা অন্ধকারকে নষ্ট করেছেন।
রাত্রিদেবী এসে ঊষাকে আপন ভগিনীর ন্যায় পরিগ্রহ করলেন, তিনি অন্ধকার দূরীভূত করলেন ।
পাখিরা যেমন সারাদিন আকাশে উড়ে রাত্রে বৃক্ষে নিজ বাসায় ফিরে আসে, তেমনি শুভংকরী রাত্রীদেবীর আগমনে আমরা শয়ন করছি।
গ্রামসমূহ নিস্তব্ধ হয়েছে, পথচারীরা, পাখিরা শীঘ্রগামী শ্যেনগণ, সকলেই নিস্তব্ধ হয়ে শয়ন করেছে ।
হে রাত্রিদেবী ! ব্যাঘ্রী ও ব্যাঘ্র-সদৃশ হিংসাকারী পাপসকল থেকে আমাদিগকে রক্ষা করুন এবং চোরকে আমাদের থেকে বিদূরিত করুন। আপনি আমাদের উদ্ধার করুন।
কৃষ্ণবর্ণের অন্ধকার স্পষ্ট লক্ষ্য হয়ে দেখা দিয়েছে।আমার নিকট পর্যন্ত আচ্ছন্ন হে ঊষাদেবি ! ঋণকে যেমন পরিশোধপর্বেক নষ্ট করা হয়, তেমনি এই অন্ধকারকে বিনষ্ট করুন।
হে রাত্রিদেবি, দুগ্ধবতী ধেনুর ন্যায় আমি আপনাকে স্তুতিজপাদি দ্বারা প্রসন্না করছি। আপনি পরমাকাশরূপ সর্বব্যাপী পরমাত্মার কন্যা। আপনার কৃপায় আমি কামাদি মহাশত্রুদের জয় করব। আমার এই স্তোত্র কৃপাপূর্বক গ্রহণ করুন।"
ঋগ্বেদ সংহিতার রাত্রিসূক্তের সাথে সাথে সামবেদের সামবিধান ব্রাহ্মণে আরেকটি রাত্রিসূক্ত পাওয়া যায়। সেই সূক্তে প্রাণিগণের সুখদাত্রী, কন্যারূপিণী, অসুরবধার্থে আবির্ভূতা বিশ্বব্যাপিনী বৈষ্ণবীশক্তির কথা বলা হয়েছে। দেবী একাই পুরুষ-প্রকৃতিরূপা উভয় শক্তি ; তাই তাঁকে শিখণ্ডিনী বলা হয়েছে। সামবিধিব্রাহ্মণমতে রাত্রিতে এই দেবীমন্ত্রজপমাত্রেই সিদ্ধিলাভ হয়। এই সূক্তপাঠের অবান্তর ফল মরণকাল-জ্ঞান ও পরম ফল মোক্ষ-প্রাপ্তি। নাগোজীভট্টকৃত টীকা অনুসরণ করে এই মন্ত্রের অনুবাদ করেছেন স্বামী জগদীশ্বরানন্দ।
ওঁ রাত্রিং প্রপদ্যে পুনর্ভূং ময়োভূং কন্যাং
শিখণ্ডিনীং পাশহস্তাং যুবতীং কুমারিণীমাদিত্যঃ
শ্রীচক্ষুষে বান্তঃ প্রাণায় সোমো গন্ধায় আপঃ
স্নেহায় মনঃ অনুজ্ঞায় পৃথিব্যৈ শরীরম্ ।
(সামবিধান ব্রাহ্মণ: ৩.৮.২)
"যে ব্রহ্মরূপা মহামায়া পুনঃপুন অসুরবধার্থ আবির্ভূতা হন, যিনি প্রাণিগণের সুখদাত্রী ও কন্যারূপিণী, যিনি ময়ূর-পুচ্ছভূষণা বৈষ্ণবীশক্তি ও অসুরবধার্থ পাশহস্তা এবং যিনি নিত্য, বাল্য ও বার্ধক্যাবস্থা-রহিতা এবং কুমারী প্রভৃতি শক্তিসমূহের সমষ্টীভূতা, সেই রাত্রিরূপা দেবীর আমি শরণাগত। তাঁর প্রভাবে সূর্য চক্ষুদ্বয়কে শ্রীযুক্ত করে রক্ষা করুন; বায়ুদেবতা পঞ্চ-প্রাণ রক্ষা করুন; সোমদেব ঘ্রাণেন্দ্রিয় রক্ষা করুন; বরুণদেব সকল তরল পদার্থ রক্ষা করুন; চন্দ্রদেব আমার মন রক্ষা করুন এবং পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা আমার শরীর রক্ষা করুন।"
পুরাণোক্ত আরেকটি রাত্রিসূক্ত হল শ্রীচণ্ডীর প্রথম চরিত্রে ব্রহ্মার স্তোত্র। এ প্রথম চরিত্রে তমোগুণ প্রধানা যোগনিদ্রা রূপা মহাকালীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সেই স্তোত্রে দেবীকে কালরাত্রি, মহারাত্রি ও মোহরাত্রি নামে অবিহিত করা হয়েছে। দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়াই যে বেদোক্ত রাত্রিদেবী এ বিষয়টি ব্রহ্মার স্তোত্রে সুস্পষ্ট।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা ॥
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সৰ্বদা ॥
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে ।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে ॥
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ ।
মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী ॥
প্রকৃতিস্ত্বং হি সর্বস্য গুণত্রয়বিভাবিনী।
কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা ॥
ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা ।
(শ্রীচণ্ডী:১.৭৫-৭৯)
" হে দেবী, বিশেষরূপে যা অনুচ্চার্যা নিৰ্গুণা বা তুরীয়া, তা আপনিই।আপনি গায়ত্রীমন্ত্ররূপা এবং আপনি পরিণামহীনা শ্রেষ্ঠা শক্তি ও দেবগণের আদি মাতা।
হে দেবি, আপনিই এই জগৎ ধারণ করে আছেন। আপনিই এ জগতকে সৃষ্টি করেছেন, আপনিই জগত পালন করেন এবং সর্বদা প্রলয়কালে আপনিই সংহার করেন।
হে জগৎস্বরূপা, আপনি এই জগতের সৃষ্টিকালে সৃষ্টিশক্তিরূপা, পালনকালে স্থিতিশক্তিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা।
আপনি মহাবাক্যলক্ষণা ব্রহ্মবিদ্যা ও সংসৃতিকর্ত্রী মহামায়া। আপনি মহতী মেধা , মহতী স্মৃতি ও মহামোহ। আপনি মহতী দেবশক্তি এবং মহতী অসুরশক্তি।
আপনিই সর্বভূতের প্রকৃতি ও ত্রিগুণের পরিণাম বিধায়িনী। আপনি কালরাত্রি ও মহারাত্রি । আপনি দুষ্পরিহারা মহামোহনিশা বা মানুষী রাত্রি।"
আদ্যাশক্তি মহামায়ার হাতে মহিষাসুর, শুম্ভ- নিশুম্ভ, বেত্রাসুর, চৈত্রাসুর নিধনের আখ্যান বিভিন্ন পুরাণে বর্তমান। দেবীপুরাণে দেবীর হস্তে রুরু দৈত্যের বধের আখ্যান পাওয়া যায়। রুরু দানবের সন্তান ছিল দুর্গম নামক অসুর। রুরুদৈত্য ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে দেবতাদের রাজ্যপাট কেড়ে নিলে, দেবতারা মহামায়ার স্তবস্তুতি করেন। সেই স্তবে দেবীকে রাত্রী, কালরাত্রী, কালী, মহাকালী, ভদ্রকালীসহ বিবিধ নামে অবিহিত করা হয়। অর্থাৎ রাত্রী বা কালরাত্রীই যে মহামায়া আদ্যাশক্তি কালী এ বিষয়টি শ্রীচণ্ডীর মত দেবীপুরাণেও সুস্পষ্ট।
ত্বং বাখাদ্যা স্বয়ং দেবি শক্তিব্যুহে ব্যবস্থিতাঃ ।
বিভুরাদ্যা তথৈব ত্বং মহাদেবি নমোঽস্তু তে ।।
ত্বং রাত্রিস্ত্বং দিনং দেবি ঋতবো বৎসরাণি চ ।
নিমেষশ্চ মুহুর্ত্তশ্চ ত্বং সংক্রান্তির্নমোঽস্তু তে ।।
ত্বং কালী কালরাত্রী চ কৃতান্তী চ সদারুণা ।
ত্বং ভীষণী মহারোদ্রী মহাকালী নমোঽস্তু তে ।।
দক্ষযজ্ঞবিঘাতী ত্বং যম শীর্ষনিকৃন্তনী ।
ত্বং দেবি বীরমাতা চ ভদ্রকালী নমোঽস্তু তে ।
ত্বমেব দেবি আকাশে ত্বঞ্চ পাতালগোচরে ।
ত্বং সর্গে চাপবর্গে চ মুক্তিদা ত্বং নমোঽস্তু তে ।।
ত্বং হি সর্বাত্মিকা দেবি সর্বমূর্ত্তিষু সংস্থিতা ।
স্থূলসূক্ষ্মবিভাগেন যোগিনী ত্বং নমোঽস্তু তে ।।
যং যং পশ্যামাহং দেবি স্থাবরে জঙ্গমেষু চ ।
তং তং ব্যাপ্তং ত্বয়া সর্বং কাত্যায়নি নমোঽস্তু তে ।।
ত্বঞ্চ শক্তিক্রিয়া দেবি নাদবিন্দুকলাত্মিকা ।
ত্বং শিবা পরভাগেন জ্ঞানশক্তির্নমোঽস্তু তে ।।
ত্বয়া দেবি প্রসন্নায়া শিবঃ প্রত্যক্ষতো মম।
তথা ত্বং রুরুবন্ধায় প্রসাদং কুরু শঙ্করি ।।
বাসবব্রহ্মসূর্য্যাণাং হ্রিয়মানে ত্রিপিষ্টপে ।
দৈত্যৌঘমজ্জমানানাং ত্বং পোতা ভব শূলিনী ।।
( দেবীপুরাণ: ৮৩.১০৩-১১২ )
"হে দেবী! তুমিই আদ্যাশক্তি, তুমি শক্তিব্যূহ ব্যবস্থিতা, তুমি বিভু। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
তুমি দিন, তুমি রাত্রি, তুমি বৎসর, তুমি ঋতু। তুমি নিমেষ, তুমি মুহূর্ত, তুমি সংক্রান্তি ।হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
তুমি কালী, তুমি কালরাত্রি, তুমি কৃতান্তী ও শুভদারুনা। তুমি মহারৌদ্রী মহাকালী। তুমিই ভীষণা। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
তুমিই দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী, যমশীর্ষনিকৃন্তনী। তুমি বীরমাতা, তুমি ভদ্রকালী। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
তুমি আকাশ, মর্ত্যলোক এবং পাতালসহ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরাজিতা। তুমিই অপবর্গা আবার তুমিই মুক্তিদাত্রী। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
তুমি সর্বাত্মিকা দেবী। তুমি স্থূল সূক্ষ্মরূপে সকল মূর্তিতে বিরাজিতা। তুমিই যোগিনী। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
স্থাবর-জঙ্গমে ব্যাপ্ত হয়ে জগতের সর্বত্রই তুমিই একমাত্র বিরাজিতা। জগতের যে স্থানে দৃষ্টি পড়ে সর্বত্রই তোমার বিবিধ রূপের প্রকাশ দেখা যায়। তুমিই দেবী কাত্যায়নী। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
তুমিই শাক্তিক্রিয়া, তুমি নাদবিন্দুকলারূপা। তুমি শিবের শক্তিস্বরূপা শিবা পরাৎপরা, তুমি সর্বজ্ঞানমূলা। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
হে দেবী প্রসন্না হও। তুমি কৃপা দৃষ্টি প্রদান করে আমাদের সম্মুখে আবির্ভূতা হও। হে শঙ্করী, তোমার কাছে এই বর চাই যে , তুমি প্রত্যক্ষ হয়ে রুরু দৈত্যের প্রাণ হরণ করো। হে মহাদেবী, তোমায় নমস্কার।
ইন্দ্র, ব্রহ্মা, সূর্যসহ সকল দেবতা নিজ অধিকার হারিয়ে দারুণ বিপদসমুদ্রে নিমগ্ন। হে শূলধারিণী, তুমি নৌকা হয়ে দেবতাদের এই বিপদসমুদ্রে থেকে উদ্ধার করে দাও।"
দেবতাদের স্তবে প্রসন্না হয়ে মহাদেবী আবির্ভূতা হলেন। দেবী খড়্গের আঘাতে রুরু দৈত্যের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। অসুরবিনাশে সন্তুষ্ট হয়ে সকল দেবতারা দেবীর নামে জয়ধ্বনি এবং স্তবস্তুতি করলেন। দেবী অজ্ঞানে আচ্ছন্ন রুরুদৈত্যকে বধের পূর্বে অদ্বৈত জ্ঞান প্রদান করলেন। দেবী বলেন, এমন কোন স্থান নেই , যে স্থানে তিনি বিরাজিতা নন। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল কারণ একমাত্র দেবীই। তিনিই জগত সৃষ্টি করেন, আবার তিনিই জগত গ্রাস করেন।
কুত্র বা গচ্ছসে পাপ যত্র নাহং কুতোঽত্র তৎ ।।
কারণাননমধ্যস্থং মমেদং বক্ত্রগং জগৎ ।।
( দেবীপুরাণ:৮৬. ১৬)
"এমন কোন স্থান আছে , যেখানে আমি বর্তমান নাই ? এই ব্রহ্মাণ্ডের মূল কারণ আমি , আমার মুখের মধ্যেই এই জগৎ বিদ্যমান রয়েছে।"
আমরা রাত্রি বলতে যে ঘন অন্ধকারযুক্ত রজনীকে চিনি; বেদোক্ত রাত্রি সেই অন্ধকারযুক্ত রজনী নয়। এ রজনী অনন্ত তারার আলোয় ঝলমল করা রজনী। এই এই জ্যোতির্ময় তারা তাঁর গায়ের প্রজ্জ্বলিত বস্ত্রস্বরূপ। বেদোক্ত রাত্রি সকল অন্ধকারকে বিদূরিত করে মুক্তির জ্যোতির্ময় আলোকস্বরূপিণী। যে আলোক জ্বলজ্বল করে উঠে ধ্যানের গভীরে সাধকের হৃদয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয় :
"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।"
স্কন্দপুরাণের মহেশ্বরখণ্ডের অন্তর্গত কুমারিকাখণ্ডের ২২ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, রাত্রিদেবীই ব্রহ্মার অনুরোধে মেনকার গর্ভে প্রবেশ করে উমার গাত্রবর্ণ ঢেকে দিয়ে তাঁকে কৃষ্ণবর্ণা করেছেন। এ বিষয়টি মৎস্য পুরাণের ১৫৪ অধ্যায়েও পাওয়া যায়। শাস্ত্রের সুস্পষ্ট প্রামাণে প্রমাণিত যে, বৈদিক রাত্রি দেবী এবং কালী একই। যেই রাত্রি, সেই কালী। ঋষি শৌণকের ‘বৃহদ্দেবতা’ গ্রন্থে বাগ্দেবীকে রাত্রি, সরস্বতী, অদিতি ও দুর্গা বলা হয়েছে (২.৭৪-৭৭)। কাজেই সিদ্ধান্ত করা যায়, বাক্, রাত্রি, কালী, দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি একই আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপভেদমাত্র।
তথ্য সহায়তা:
১. স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, শ্রীশ্রীচণ্ডী, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: জুন ২০১৯
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................