"ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে"; আত্মা অবিনাশী, গবেষণায় প্রমাণিত।

"ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে";
আত্মা অবিনাশী, গবেষণায় প্রমাণিত

মানুষের মস্তিষ্ক যেন একটা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার মত ৷আর আত্মা যেন তার সফটওয়্যার।যখন কারও মৃত্যু হয়, তখন তার আত্মার মৃত্যু হয় না ; তা মহাবিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি শরীরের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তথ্যরূপী আত্মা মস্তিষ্কের মাইক্রোটিবিউলে আবার ফেরত যেতে পারে এসব দাবি আধ্যাত্মবাদী কোনও ব্যক্তির নয়; দুই মার্কিন পদার্থবিদের৷ মরগ্যান ফ্রিম্যান এর উপস্থাপনায় মার্কিন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যচিত্রের সম্প্রচারমাধ্যম সায়েন্স চ্যানেলে সম্প্রচারিত ওই দুই পদার্থবিদের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট সম্প্রতি এই বক্তব্যকে সামনে এনেছে৷


দুই মার্কিন পদার্থবিদ ডক্টর স্টুয়ার্ট হ্যামারহফ এবং পদার্থবিদ স্যার রজার পেনরোজের দাবি, আত্মা মস্তিষ্কের ‘মাইক্রোটিবিউলে’ থাকে। তারা এই প্রক্রিয়াটিকে ‘অর্কেস্ট্রেটেড অবজেক্টিভ রিডাকশন’ বা ‘অর্ক-অর’ নামে অভিহিত করেছেন। মানুষ যখন মারা যায় (ক্লিনিক্যালি ডেড) তখন মস্তিষ্কের মাইক্রোটিবিউলগুলোর অবস্থা পরিবর্তীত হতে থাকে, যদিও তাদের তথ্য ধরে রাখার সক্ষমতা তখনও থেকে যায়।দ্যা সায়েন্স চ্যানেলের সম্প্রচারিত তথ্যচিত্র 'থ্রু দ্যা ওয়ার্মহোলে’ ডক্টর হ্যামারহফ বলেছেন, "ধরুন হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রক্ত প্রবাহও থেমে গেছে। তখন মাইক্রোটিবিউলগুলোও তাদের তথ্য ধরে রাখার সক্ষমতা হারাতে থাকে। কিন্তু মাইক্রোটিবিউলগুলোতে থাকা কোয়ান্টাম তথ্য একেবারে হারিয়ে যায় না। কারণ সেটাকে ধ্বংস করা যায় না। তা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।কোমায় থাকা ব্যক্তি যদি চেতনা ফিরে পান তখন ওই কোয়ান্টাম তথ্য আবার কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। ওইরকম সময়েই কোমা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা বলেন যে তারা মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। আর যদি ব্যক্তিটি কোমা থেকে ফিরে না আসেন, সেক্ষেত্রে তার মস্তিষ্কে থাকা কোয়ান্টাম তথ্য তার শরীরের বাইরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছড়িয়ে পড়ে আত্মা হিসেবে ('আত্মাকে অমর দাবি করছেন দুই মার্কিন পদার্থবিদ'; বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা, ০৬ এপ্রিল ২০১৮)।"

মার্কিন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী হ্যামারহফের বক্তব্য থেকে জানা যায় , আত্মা নিছক মস্তিষ্কের নিউরনের মিথস্ক্রিয়াই শুধু নয়; কোয়ান্টাম তথ্যরূপী ‘আত্মা’ সময় সৃষ্টির আগে থেকেই বিদ্যমান। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির মত বিষয়গুলো আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছি যে সেগুলো আছে। আত্মার অমরত্ব বিষয়ে হ্যামারহফ আর পেনরোজ বিজ্ঞানীদ্বয়ের তত্ত্ব বহু পূর্ব থেকেই বেদ এবং বেদান্তে সুপ্রতিষ্ঠিত। শুধু দেহাত্মবাদী চার্বাক ছাড়া ভারতবর্ষের সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই আত্মার অবিনাশিতা স্বীকার করে। কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় কঠ উপনিষদসহ বেদের একাধিক স্থানে আত্মার অবিনাশীতার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:

ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চি-
ন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো 
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
(কঠ উপনিষদ: ১.২.১৮)

"আত্মার জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকে কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না।আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হলেও আত্মা অবিনাশী।

কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় কঠ উপনিষদের আত্মতত্ত্ব প্রসঙ্গে বর্ণিত এ মন্ত্রটিই সামান্য পরিবর্তিতভাবে 
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখে পুনরায়  পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভগবদগীতার  দ্বিতীয় অধ্যায়ের সাংখ্যযোগে অত্যন্ত সুন্দর করে আত্মার অবিনাশীতা প্রসঙ্গে একাধিক শ্লোকে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।শরীরের অভ্যন্তরে এই আত্মা কখনো জন্মগ্রহণ করেও না বা কখনও মৃতও হয় না। অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় জন্মিয়া অস্তিত্ব লাভ করেন না।  সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান জীবাত্মা; ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাণ। শরীর হত হলেও, আত্মা হত হয় না।

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্ ।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্ ।।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় 
নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি । 
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ।।
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপাে ন শােষয়তি মারুতঃ ৷৷
অচ্ছেদ্যোঽয়মদাহ্যোঽয়মক্লেদ্যোঽশােষ্য এব চ।
 নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলােঽয়ং সনাতনঃ ৷৷
( শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ২.২০-২৪)

" এই আত্মার কখনো জন্ম হয় না বা মৃত্যুও হয় না। আত্মার অস্ত্বিত্ব উৎপত্তিসাপেক্ষ নয়; কারণ আত্মা জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাতন। শরীর বিনষ্ট হলেও, আত্মা কখনো বিনষ্ট হয় না।

হে পার্থ! যিনি এ আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, 
জন্মরহিত এবং অক্ষয় বলে জানেন; তিনি কিভাবে কাউকে হত্যা করবেন বা করাবেন।"

যেমন মনুষ্য জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ জীবাত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করে অন্য নূতন নূতন শরীর পরিগ্রহ করে।

শস্ত্র এই আত্মাকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, জল সিক্ত করতে পারে না এবং বায়ুও শুষ্ক করতে পারে না। 

এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশােষ্য এবং নিত্য, সর্বব্যাপী, অচল, স্থির ও সনাতন। "

আত্মা অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয়।আত্মার কখনই মৃত্যু হয় না।মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও ঠিক তেমনি পুরাতন শরীর পরিত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে। আত্মার অবিনাশীতা সম্পর্কে বৈদিক পরম্পরাগত তত্ত্বই, আজ মার্কিন বিজ্ঞানীদ্বয়ের গবেষণায় সর্বজনীন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা পেয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তাই আত্মতত্ত্বই জীবকে স্রষ্টার সাথে মিলিত করে মুক্তির পথে নিয়ে যায়।এ প্রসঙ্গে লালন সাঁই তাঁর একটি বিখ্যাত গানে আত্মতত্ত্ব বা আত্মার অবিনাশীতা জ্ঞানহীন মুক্তি পাওয়া যায় না। আত্মতত্ত্বের সম্যক জ্ঞান যে পেয়েছে, সেই দিব্যজ্ঞানী হয়ে জীবন্মুক্ত হয়ে পরবর্তীতে ভববন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছে।

"আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে 
দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে।" 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted