জহির রায়হানকে কেন হত্যা করা হয়েছিলো জানে?
কেন?
আরে তিনি তো ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের সব জানতেন। তারপর তাজউদ্দিনদের সব কুকীর্তি, ইন্ডিয়ার সাথে হাত মিলাইয়া কিভাবে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য করা যায় তার ছক কষা হচ্ছিল, সেসব নিয়ে জহির রায়হান প্রামাণ্যচিত্র বানালে সবাই ধরা পড়বে এই জন্য তাকে সরিয় দেয়া হয়।
হুম। যুদ্ধাপরাধী নিজামী একটা ডকুমেন্টে যেটা শাহরিয়ার কবীর তৈরি করেছিলেন, সেখানে সে বলেছিলো, জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো। তিনি সেই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই তদন্ত যখন তিনি শুরু করেন তখনই অন্তর্ধান হন। কেন তিনি অন্তর্ধান হলেন? সেই তদন্তটা কেন হলো না? এসব তথ্য যদি বের করতে পারেন তাহলে যুদ্ধাপরাধ বুদ্ধিজীবী হত্যার সব রহস্য বেরিয়ে আসবে। মানে নিজামী বলতে চেয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীরা আসলে অন্য কেউ যা কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। উল্টো মাসুম বাচ্চা নিজামীদের উপর সেই দোষ চাপানো হয়েছে।
লোকটা তো ঠিকই বলেছে। কেউ জহির রায়হানের অন্তর্ধান রহস্য বের করল না কেন? এটাই তো আমাদের সন্দেহের জায়গা।
তোমাদের দোষ নেই। এই দোষটা পুরো সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারটির। কেন সেটি বলছি, তার আগে বলি জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্য কিন্তু ১৯৯৯ সালেই মিটে গেছে। মিরপুর ১২ নং সেকশনের মুসলিম বাজার নূরী মসজিদ নির্মাণের সময় যে খনন কাজ চলে তখন সেখান থেকে একটি অনাবিস্কৃত বধ্যভূমি বের হয়ে আসে। মানুষের দেহাবশেষ, হাড় করোটিতে গুলির চিহ্ন। এক্সপার্টরা নিশ্চিত হয় এটি ৭১ সালের একটি বধ্যভূমি। জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান নিজে ও তখনকার ভোরের কাগজ পত্রিকা এই নিয়ে এক্সক্লুসিভ তদন্ত করে বের করে আনে জহির রায়হানের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো। মনে রাখতে হবে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তখনো পর্যন্ত মিরপুর স্বাধীন হয়নি! মিরপুরের নিয়ন্ত্রণ তথনো পাকিস্তানী সমর্থক বিহারীদের হাতে। বড় ভাই শহিদুল্লাহ কায়সার মিরপুরের ১২ নম্বরে একটি জায়গায় বন্দি আছেন এরকম একটি ফোন পেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন জহির রায়হান। জহির রায়হানকে গুলি করতে দেখেছে তেমন সাক্ষির সন্ধান মেলে ২৮ বছর পর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে যিনি সেদিন মিরপুরে বাহিরী হামলায় বেঁচে ফিরে ছিলেন। তিনি জহির রায়হানকে সনাক্ত করেছিলেন একজন ‘সাংবাদিক’ হিসেবে। জহির রায়হান সেই পরিচয়েই সেখানে গিয়েছিলেন। অতর্কিত হামলা চালিয়ে জহির রায়হানসহ অন্যদের গুলি করে হত্যা করে লাশ এই বধ্যভূতিতে বা অন্য কোথায় গুম করে ফেলা হয়েছিলো। নিশ্চিত হওয়া গেছে রাজাকার আল বদররাই জহির রায়হানকে হত্যা করেছিলেন। জহির রায়হান বেঁচে থাকলে তিনি ডকুমেন্ট তৈরি করবে সেটাই ছিলো তাদের ভয়। কিন্তু নিজামী উল্টো অন্যদের ফেঁসে যাবার ইঙ্গিত দিয়েছিলো। এর জন্য দায়ী কারা জানো?
কারা?
জাহির রায়হানকে কারা হত্যা করল, তার কি হলো সেটি নিয়ে স্বাধীনতার পর যে সরকার ক্ষমতায় ছিলো তাদের কোন আগ্রহই ছিলো না। পরিস্কার করে বললে রাজাকার আল বদরদের নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাতে চায়নি তারা। ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইটা অনলাইনে ফ্রি পড়া যায়, অথবা হার্ড কপি কিনতে পারো বাজার থেকে, সেই বইতে লেখক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, যিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন, এই বইতে বঙ্গবন্ধু হত্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিল তুলে ধরা হয়। বইটি আওয়ামী লীগ বিরোধী কোন বই সেটি মনে করার কিন্তু কোন কারণ নেই। পুরো বইটি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জামাতীদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেই বইতে আবু সাঈদ সাহেব লিখেছেন, রাজাকার আল বদরদের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বেশি একটা কঠর ছিলেন না। একটু সহানুভূতিশীলই ছিলেন। তিনি যুদ্ধের সময় নৃশংসতাকে আদর্শিক কারণে ঘটেছিলো তেমনটি মনে হয়ত করেননি। তাজউ্দ্দিনের পরামর্শ উপেক্ষা করে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর ৩৬৪০০ দালালকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে কুথ্যাত শাহ আজিজ ছিলেন যিনি সেই ৭১ সালে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরে। সেই লোক ছাড়া পেয়ে গেলো। শুধু তাই নয়, শাহ আজিজকে মুক্ত করতে তার স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। বঙ্গবন্ধু যতদিন শাহ আজিজ মুক্ত না হবে ততদিন তার পরিবার মাসিক ৫০০ টাকা ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। মুক্ত হবার পর বাইশ হাজার টাকার গাড়ি উপহার দেয়া কথা জানা যায়। শান্তি কমিটির প্রধান খাজা খয়েরউদ্দিনকে মুক্ত করে নিজ হাতে পাকিস্তান যাবার টিকিট ধরিয়ে দেন। একইভাবে খুলনার কুখ্যাত খান এ সবুরও সাধারণ ক্ষমার সুযোগ লাভ করে। এর ফল পেয়েছিলো ৭৪ সালেই। এই দালালরা দেশ ‘ইসলামী শক্তির’ ঐক্য গড়তে বিভিন্ন দলগুলোকে নিয়ে সংগঠিত হতে থাকে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে ইসলাম বিরোধী, ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেয়া, দেশে আর ইসলাম থাকবে না ইত্যাদি প্রচারণা শুরু করে। সেই সময়ে কবি দাউদ হায়দারের একটি কবিতা নিয়ে এই গ্রুপটিই পুরো দেশে আগুন জ্বালোনোর মত পরিস্থিতি করে ফেলে। রাজাকার আল বদরদের বিষয়ে জিরো ডিগ্রী টলারেন্স থাকলে জহির রায়হানকে নিয়ে কোন ‘রহস্য’ তৈরি হত না। নিজামীরাও জহির রায়হানকে র’ এজেন্টরা হত্যা করেছে এরকম গল্প বানাতে পারত না। এসব দায় স্বীকার করতে হবে। কট্টর লীগার ছাড়া আমার মনে হয় না কেউ এসব ভুল ভ্রান্তিগুলিকে স্বীকার করতে দ্বিধা করবে।
তার মানে জহির রায়হানকে মুক্তি বাহিনীরা হত্যা করেনি?
শোন, ভারতের কে একজন নাকি ইন্দরা গান্ধিকে বলেছিলেন (আমি নিশ্চিত নই), ‘আপনি কি আরেকটি পাকিস্তান তৈরি করতে সহায়তা করতে যাচ্ছেন?’ আমার মনে হয় সেরকম কিছু কেউ বলে থাকলে মিথ্যে কিছু আশংকা করেনি। যে কোন ধরণের উদ্ভট হাস্যকর অভিযোগ ভারত হিন্দুদের উপর ফেললেই হলো, আমাদের যুক্তিবোধ কাজ করে না। কারণ তোমার আমার মনোভূমি যে বিদ্বজাতিতত্ত্বের উর্বর ভূমি!...
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................