'শিখধর্ম' সনাতন ধর্মের, একটি সাধনমার্গী শাখা

'শিখধর্ম' সনাতন ধর্মের,
একটি সাধনমার্গী শাখা

শিখমতের সর্বশেষ মানুষী গুরু, গোবিন্দ সিংহের জন্ম হয় ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বরের। এক অকুতোভয় ধর্মযোদ্ধা ছিলেন, সর্বশেষ শিখগুরু গোবিন্দ সিংহ। তিনি বিহারের পাটনাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গর্ভধারিণী মায়ের নাম গুজরি।গুরু গোবিন্দ সিং ১৬৭৫ সালের ১১ নভেম্বর মাত্র নয় বছর বয়সে পিতা গুরু তেগ বাহাদুরের স্থলাভিষিক্ত হন। মুগল শাসক আওরঙ্গজেব নির্মমভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গুরু তেগ বাহাদুরকে শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করে ।


সনাতন ধর্ম থেকে আলাদা ধর্ম হয়ে যাওয়া তিনটি প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে শিখ অন্যতম। জয়দেব গোস্বামী, আচার্য রামানন্দ, সন্ত কবীর, সন্ত নামদেব, সন্ত রবিদাস, সন্ত সেনাজী, সন্ত পিপানন্দ সহ অনেক উত্তর ভারতের হিন্দু বৈষ্ণব সাধকদের রচনাবলীর উপরে শিখ মত প্রতিষ্ঠিত। সে হিসেবে শিখদের একটি নিরাকার বৈষ্ণব সম্প্রদায় বললে খুব বেশী অত্যুক্তি হয় না।আমরা হয়তো অনেকেই জানি না শিখদের ধর্মগ্রন্থ গুরুগ্রন্থসাহেবে প্রায় তিন হাজারবারের উপরে রামনাম আছে ; প্রায় ষোল হাজারের কাছাকাছি কৃষ্ণ বা শ্রীহরির নাম আছে ; এ ছাড়া কেশব, গোবিন্দ, গোপাল, দামোদর, মাধব, মধুসূদন, মুরারী, মুকুন্দ, বাসুদেব, বিষ্ণু প্রভৃতি ভগবান শ্রীহরির নাম প্রায় দুই হাজার স্থানে আছে। এমন কি শিখগুরুদের এবং তাঁদের সন্তানদের নামের তালিকাতেও এই পবিত্র শব্দগুলো জাজ্বল্যমানভাবে আছে।গুরুগ্রন্থসাহেবের আদিতম মন্ত্রই হল:

এক ওঙ্কার কর্তা পুরুখ নিরভউ নিরাবয়াব 
 অকালমুরত অজুনী সয়ভঙ্গ গুরু প্রসাদ।

"এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ওঙ্কার (ওঁ) পদবাচ্য। তিনিই একমাত্র অস্তিত্বশীল এবং বিদ্বেষরহিত। তাঁর মূর্তি বা স্বরূপ কালের দ্বারা বিচ্ছিন্ন নয়। তিনি অযোনি সম্ভব অর্থাৎ সয়ম্ভূ। তাকে একমাত্র গুরু কৃপায় জানা যায়।"

এ মন্ত্রটিকে শিখ ধর্মের গায়ত্রী বলা হয়। শিখদের সকল উপাসনা এ মন্ত্রটি উচ্চারণ করেই হয়। আপনারা লক্ষ্য করেন এ মন্ত্রটিতে বেদের - 'একমেবাদ্বিতীয়ম্' সহ ব্রহ্মের সকল ধারণা পরিস্ফুটিত।

তুর্কি, মোগলদের নৃশংস অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়ে রাজনৈতিক কারণে ভক্তিবাদী কবীর পন্থ, রবিদাস পন্থের ন্যায় হয়েও নানক পন্থ হিন্দু সমাজ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যেয়ে 'নানকপন্থ' বা 'শিখপন্থ'  নামে শিখ উপাসনা সম্প্রদায়টি পরবর্তীতে ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে যায়। গুরু গোবিন্দ সিংহের ধর্ম রক্ষার্থে 'খালসা বাহিনী' এবং পরবর্তীকালে মহারাজ রণজিৎ সিংহের রাষ্ট্রশক্তির সহায়তাই শিখজাতিকে রাজনৈতিকভাবে একতাবদ্ধ করে একটি রক্ষণশীল, স্বতন্ত্র ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করে তোলে।

১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিং বৈশাখী উৎসবের সময় খালসা (যিনি বিশুদ্ধ )নামে একটি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সম্প্রদায় গঠন করেন। এ খলসার বাহিনীর সহায়তায় তিনি অসংখ্যবার মুগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খালসার প্রথম পাঁচ সদস্যকে উনি নাম দেন- পাঁজ প্যায়ারে। এই পাঁচ জনকে উনি নতুন পদবী দেন- সিং-সিংহ । গুরু গোবিন্দ সিং শিখ মতের বিখ্যাত  'পঞ্চ-ক' এর প্রতিষ্ঠাতা। এই 'পঞ্চ-ক' হল:

কেশ-   চুল না কাটা।
কাঙ্গা- কাঠের চিরুনি।
কারা- লোহার বালা যা ডান হাতে পড়তে হয়।
কৃপাণ- ছোরা।
কাচ্ছেরা- লেঙট বা দড়ি বাঁধা সুতির অন্তর্বাস।

গুরুগেবিন্দ সিংহের 'দশম বাদশাহ কি গ্রন্থ' এর  চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ অংশে শ্রীচণ্ডীর সম্পর্কে বিস্তারিত বলা  আছে। সেই গ্রন্থের চতুর্থ  অংশটি প্রায় সম্পূর্ণভাবেই মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীচণ্ডী অনুসারে লিখিত। সেই অংশে মধুকৈটভ, চণ্ডমুণ্ড, রক্তবীজ, শুম্ভনিশুম্ভাদি দৈত্যবধের বিবরণ দেয়া আছে।গ্রন্থের পঞ্চম অংশে চণ্ডীচরিত্র এবং ষষ্ঠ অংশে শ্রীচণ্ডীস্তব আছে। গুরুগোবিন্দ সিংহ আদ্যাশক্তি মহামায়ার একনিষ্ঠ উপাসক ছিলেন, একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।শিখধর্মের মধ্যে নিজস্ব মৌলিকত্ব অনেক কম, এটা মূলত বৃহৎ হিন্দুধর্মের একটি সম্প্রসারিত রূপ।হিন্দুধর্ম থেকে স্বতন্ত্র হয়ে যাওয়া জৈন, বৌদ্ধ এবং শিখ এ তিনটি ধর্মের মধ্যে শিখধর্মের ধর্মদর্শন হিন্দুধর্ম দর্শনের অত্যন্ত কাছাকাছি। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted