ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা সকলেই বাঙালি,
সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলীর জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত!
ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটেছিল সেদিনই।
৪৮শে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা বাংলা করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, ৫২তে এসে সালাম বরকতসহ অগুনিত শহিদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পরবর্তি কালে ৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর হাতে সন্তানসহ নির্মমভাবে নিহত হন এই ভাষা আন্দোলনের প্রথম এই ভাষ সৈনিক।
আজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনের প্রথম সৈনিকের নাম হয়তো জানেই না, বা জানবার চেষ্টাও করে না।
ফেব্রুয়ারি আসলেই আমার মনে পড়ে সেইসব ক্ষণজন্মাদের কথা। যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের সুখসাচ্ছন্দ ত্যাগ করে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিল।
ছোট্ট করে জেনে নেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কর্মময় জীবনের কিছু অংশ।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার রামরাইল গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন নবীনগর হাই স্কুল, কুমিল্লা কলেজ, এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে এবং ১৯১০ সালে কলকাতার রিপন কলেজ হতে বি.এল পরীক্ষা পাশ করেন।
প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য, গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত কংগ্রেসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আইন ব্যবসা ত্যাগ করে দেশ সেবায় আত্মিনিয়োগ করেছিলেন।তিনি ইংরেজ শাসনমালে ভারতের বাংলা আইনসভার
কংগ্রেস সদস্যপদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
৮৫ বছরের বৃদ্ধ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কী অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, এক সাক্ষাৎকারে সেই বিবরণ দিয়েছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের নাপিত রমণীমোহন শীল।
সেইসময় বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করতো পাকিস্তান বাহিনী।
রমণীমোহন শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো পাকিস্তানী মিলেটারিদের প্রয়োজনেই, কারণ তাদের মৃত্যু হলে পাকিস্তানী সৈন্যদের চুল দাড়ি কাটার মতো কোনো লোক থাকবে না।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে তা দেখে কোন সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের চোখের জল সংবরণ করা সম্ভব নয়। সাখাওয়াত আলী খান প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়ঃ “ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধন মানে নি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জেজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশরায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম।
আমি বারবার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, ‘এটা একটা দেখার জিনিস নয়-নিজের কাজ কর।’ এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তাঁর কপালে এই দুর্ভোগ।
তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।”
আজ আমরা নিঃসংশয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি তথা সামরিক জান্তা ভোলেনি, ভুলতে পারেনি। তাঁর অকুতোভয় ভূমিকাই যে পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার বীজ বপন করেছিলেন তা পরবর্তীকালে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে, প্রমাণিত হয়েছে।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, আমার পূর্বপুরুষ, আমি এবং উত্তর পুরুষ কেউই ভুলতে পারে না,
এবং অনিবার্যভাবেই এক্ষেত্রে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম আসবে সবার আগে। বাঙালিরা ভুলে গেলেও ইতিহাস ভুলবে না, ইতিহাস মনে করিয়ে দেবে মহান এই শহিদের নাম।
তোমাকে প্রনাম শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................