খাঁচার মধ্যে ভগবান

খাঁচার মধ্যে ভগবান

স্কুলে আমাদের এক সহপাঠী ছিল কিশোর। কিশোর অনেক সরল স্বভাবের ছিল। কেউ যদি ওকে জিজ্ঞাসা করত যে, "এই কিশোর তুই এত ধলা ফুটফুটে কি করে হলি?" কিশোরের উত্তর, "আমার ডানো গুড়াদুধের কৌটায় জন্ম তো, তাই আমি বিলাতি ইন্দুরের মত ধলা।" বন্ধুরা এ নিয়ে সর্বদা মজা করত। তাতে অবশ্য কিশোরের কিছুই যায় আসে না। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে, চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে স্কুল পরিবর্তন করে জেলা সরকারি বয়েস স্কুলে ভর্তি হলাম। অন্যদের পরিবর্তন হলেও কিশোরের পরিবর্তন নেই। বিভিন্ন সময়ে সে বিভিন্ন মজার কথা বলত। 


এমনি একদিন স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে সে দাবি করে বিসে যে, সে খাঁচার মধ্যে ভগবানকে দেখে এসেছে। শুধু একবার নয়, চোখেমুখে ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে কথাটি বারবার বলেই চলে। এবং উপস্থিত আমরা যে সকলে বিশ্বাস করছি না, তাতে সে বিরক্ত হয়ে রেগে যায়। সকলেই যেহেতু শিশু। তাই অনেকেরই শিশুমন দ্বিধায় পড়ে যায়। কিন্তু কিশোর নাছোড়বান্দা, সে এক পোঁ ধরেই আছে, তার থেকে আর কোন নড়াচড়া নেই। শিশুদের সভায় সেদিন আর বিষয়টির সমাধান হয় না।এরই মধ্যে টিফিন পিরিয়ডে শেষ হয়ে ক্লাস শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি অসমাপ্ত রয়ে যায়। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের দোলাচলে দোল খেতে থাকে কিশোরের বন্ধুমহলের শিশুমন। তবে কিশোরের ভাব দেখে বোঝা গেল, কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক এতে তার কিছুই যায় আসে না। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে তার যুক্তিতে অনড়, সে খাঁচার মধ্যে ভগবান দেখেছেই দেখেছে।

কিশোরের সকল বন্ধুরা কথাটি বিশ্বাস না করলেও, কেউ কেউ করে। সেদিন থেকে কিশোরের "খাঁচার মধ্যে ভগবান" এ নতুন নামটি কপালে জুটে যায়। বয়সের ধর্মে সকল বন্ধুরাই আমরা ওকে এ নতুন নামে ডাকা শুরু করি। পরবর্তীকালে কিছুটা সময় সে, ওই নামটিতেই পরিচিত ছিল। বন্ধুদের সেই নামটি ভুলতে বেশ সময় লেগেছিল। আমার মধ্যে কোন বিষয়ের উপরে জানার তৃষ্ণা ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মাত্রায়। কোন বিষয় একবার মাথায় ঢুকলে, সেই বিষয়টির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমার মাথায় বিষয়টি ঘুরপাক খেতেই থাকত। কিশোরের বলা বিষয়টি আমার মাথায় ঘুরপাক খায় বহুদিন। পরবর্তীতে যখন আরেকটু বুঝতে শিখি। তখন জানতে পারলাম কিশোরের সেই, খাঁচার মধ্যে ভগবান দেখার রহস্য। বুঝতে পারলাম কিশোর ভুল ছিল না। শিশুবয়সে ওকে যা বোঝানো হয়েছে, সে তাই বুঝেছে। এরজন্যে ও দায়ি নয়, দায়ি পরিবার।শিশুদের মন হচ্ছে কাদামাটির মত, সেই কাঁদামাটি শিবও গড়া যায় আবার বানরও গড়া যায়। তাই শিশুর মনের ছাঁচকে যেভাবে গড়ে তোলা হবে, সে সেভাবেই বেড়ে উঠবে।কিশোরের মা-বাবা অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গের মতাদর্শে দীক্ষিত ছিল। কিশোরকে নিয়ে তার মা ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রমে তীর্থ করতে যায়। সে সময়ে কিশোর দেওঘরে অনুকূল ঠাকুরের একটি মূর্তিকে পূজিত দেখে। মূর্তিটির নিরাপত্তায় চারিদিকে লোহার রডের বেষ্টনী দেয়া। যা দেখতে অনেকেটা খাঁচার মতন। কিশোরকে জন্মের পরে থেকে পারিবারিকভাবে শেখানো হয়েছে, অনুকূল ঠাকুর স্বয়ং  ভগবান। সেই অনুকূল ঠাকুরের মূর্তি যখন সে খাঁচার মতন একটি বেষ্টনীর মধ্যে দেখেছে; তার শিশুমনে ধারণা হয়েছে যে সে খাঁচার মধ্যে ভগবান দেখেছে। বিষয়টি হয়ত হাসির কিন্তু এর মধ্যেও নির্মম কিছু বাস্তবতা নিহিত রয়েছে। একটি শিশুকে শিশুকালে যা কিছু শিখানো হয়; বয়সের ধর্মে শিশুটি তাই সরল মনে বিশ্বাস করে নেয়। কারণ তার যাচাই-বাছাই করার সামর্থ্য থাকে না। ঈশ্বর শুধু খাঁচা নয়, সর্বত্র বিরাজ করেন। সাধক কবি রজনীকান্ত সেনের ভাষায়:

"আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে,
ভূধরসলিলে, গহনে,
আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়, 
শশীতারকায় তপনে,
আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া,
ব’সে, আঁধারে মরি গো কাঁদিয়া;
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু,
দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।"

একটা টেবিলে কিছু ভালো ফল আছে এবং গুটিকয়েক পঁচা ফলও আছে। একটা শিশু ফল খাবার জন্য দৌড়ে এসে যদি সেই গুটিকয়েক পঁচা ফলের উপরই তার হাত বাড়ায়, এবং মুখে দিয়ে বুঝতে পারে ফলটি পঁচা; তবে থু দিয়ে সে শুধুমাত্র পঁচা ফলটি ফেলে দিবে তাই নয়, তার ধারনা হবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা এবং হাজার চেষ্টা করেও শিশুটিকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে যে টেবিলে ভাল ভাল সরস ফলও আছে । তার ধারণা জন্মাবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা । এমনটাই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে প্রায় প্রত্যেকটা হিন্দু পরিবারে । শিশু বয়সে তাকে ঠাকুমা দিদিমার গালগল্পের মাধ্যমে যে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তার ভিৎ দিন দিন নরবরে হয়ে যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । একুশ-বাইশ বছরের দিকে যখন তার বুদ্ধি পূর্ণতা পায়, তখন সে ভাল মন্দ বিচার করতে পারে ; তখন এ ভাল মন্দ বিচার করতে যেয়েই সে ধান এবং ধানের চিটাকে একাকার করে ফেলে এবং অজ্ঞানতার জন্য চিটার সাথে সাথে ধানকেও ঝেড়ে ফেলে দেয় । সঠিক-বেঠিক বোধটাকে সে গুলিয়ে ফেলে। পরিণামে সে হয়ে ওঠে অবিশ্বাসী । এ অবিশ্বাসের মাত্রা দিন দিন বাড়তে বাড়তেই সে হয়ে যায় ঘোরতর নাস্তিক । পরিণামে সে পরিবার, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতির, মহাবৈরী হয়ে যায় । কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা ? আমরা, নিজেরাই এরজন্য দায় । কারণ আমাদেরই দায়িত্ব ছিলো শিশুটিকে প্রকৃত বৈদিক শিক্ষা দেয়া এবং তা দিতে পারিনি বলেই আজ এ ঘটনা ঘটেই চলেছে । কিন্তু এ প্রপঞ্চকে আর কতদিন চলতে দেয়া যায় এবং এ প্রপঞ্চের অভিঘাতে আর কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে ? এর সমাধানে একটি কথাই বলতে হয় , তা হলো অনেক হয়েছে এবার মূলে ফিরুন।অর্থাৎ বেদ-বেদান্তের পথে আসুন। বেদমাতার সর্বদা শরণে থাকুন। 

এ প্রসঙ্গে আমার আরেকটি ঘটনা বিশেষ করে মনে পড়ে। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। ঠিক সে সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বেশ মেধাবী মেয়ে একটি মুসলিম ছাত্রের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। পরিণামে মেয়েটি ধর্মান্তরিত হয়। ছেলেটি তার সহপাঠী এবং তখনও ছাত্র। সে পেশায় কিছুই করে না। এমন একটি ছেলের সাথে পালিয়ে যাওয়ায়, বিষয়টি সে সময়ে বেশ আলোড়ন তুললো। বিএ অনার্সের সর্বশেষ পরীক্ষাটি দিয়ে মেয়াটি পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। মধ্যে একটি বড় সময়ে তার খোঁজ ছিল না বা সে পরিবারের থেকে দূরে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে এম এ পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে আসে। সে সময়ে তার সাথে আমার কথা হয়। আমি তখন জানতে পারি, চট্টগ্রাম শহরের একজন নামকরা ঋত্বিক তার বাবা। পিতাসহ তার পরিবার অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গের অনুসারী। জন্ম থেকেই সে ভগবান হিসেবে শুধু অনুকূল ঠাকুরকেই চিনেছে। এবং অনুকূল ঠাকুরকেই ঘরের আসনে পূজা হতে দেখেছে। ব্যক্তি অনুকূল ঠাকুরের প্রতি যখন তার বিশ্বাস চলে গেছে, তখন তার ধর্মের প্রতিই বিশ্বাস চলে গেছে। সাথে অনুসঙ্গ হিসেবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সহপাঠী ছেলেটির প্রেম এবং প্ররোচনা তো রয়েছেই। মেয়েটার সাথে কথা বলার পরে, আমার ওর প্রতি বিরূপ ধারণা অনেকটাই দূর হয়। আমার বারবারই মনে হতে থাকে, এই মেয়েটি যে ধর্মান্তরিত হয়েছে, এর জন্যে শতভাগ ও দায়ী।  ওর পরিবারও এই ধর্মান্তরিতের দুঃখজনক ঘটনার জন্য বৃহদাংশে দায়ী। আজ পরিবার যদি তাকে সত্যি সত্যি বেদ এবং বেদান্তের শিক্ষা দিত, তাহলে হয়ত এ দিন তাদের দেখতে হত না। ধর্মের নামে যদি শুধু কোন ব্যক্তি এবং তার মতবাদই মাথার উপরে চেপে বসে, তবে সেই একক ব্যক্তি এবং তার সাথে যুক্ত মতবাদকে মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলা, খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু অনন্ত ভাববৈচিত্রময় অসীম সনাতন ধর্ম যদি কারো মস্তিষ্কে যথাযথভাবে স্থান লাভ করে, তবে সেই অনন্ত অসীম সনাতন ধর্মকে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকে সরিয়ে ফেলে শুধু অসাধ্যই নয়, দুঃসাধ্যও বটে। বৈদেশিক আরবীয়, তুর্কি এবং ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা কয়েকশত বছর ধরে হাজার প্রচেষ্টা করেও এ কাজটি করতে পারেনি।

বেদ-বেদান্তকে পরিত্যাগ করে, অজ্ঞানতাবশত ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্ধবিশ্বাস যদি আমৃত্যু অব্যাহত রাখতে পারে ; তবেও বিষয়টি হয়ত মন্দের ভালো। কারণ ভগবানই বলেছেন, যে যেভাবে তাঁকে ডাকে তিনি ঠিক সেভাবেই তার ডাকে সাড়া প্রদান করেন। তাই সরল একাগ্র বিশ্বাসের গুণে হয়ত তারা মুক্তিও পেয়ে যেতে পারে।কিন্তু অধিকাংশই আমৃত্যু এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্ধবিশ্বাসটি ধরে রাখতে পারে না। গুটিকয়েক ব্যতিক্রমীকে বাদ দিয়ে অধিকাংশ ব্যক্তিই জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদী মতবাদের অসারত্ব উপলব্ধি করতে পারে। পরবর্তীতে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তিসর্বস্ব মতবাদ থেকে একবার যদি তাদের বিশ্বাস চলে যায়; তবে তাদের সেই উপাস্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদী মতবাদের সাথে সাথে সম্পূর্ণ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস উঠে যায়। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। প্রচণ্ড সরল বিশ্বাসের কারণে এই অন্ধ অধিকাংশই সরল ব্যক্তিগুলো হয়ত মুক্তি পেয়ে যাবে। কিন্তু পক্ষান্তরে তাদের যারা বিবিধ ছলনা দ্বারা এভাবে অবৈদিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্ধকার গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে ; তারা এক একটা নরকের কীট হয়ে কৃতকর্মের যথোপযুক্ত শাস্তি ভোগ করবে। সদগুরুর কাজ জ্ঞানের শলাকা দিয়ে শিষ্যের চক্ষু উন্মোচন করে দেয়া। কিন্তু গুরু যখন বৈদিক মার্গে না গিয়ে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদের নিচে চাপা পড়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়; তখন এর থেকে দুঃখজনক আর কিই বা হতে পারে? গুরু সমস্যা নয়, গুরুকে শ্রদ্ধা জানোনাতেও কোন সমস্যা নেই; কারণ গুরু পূজনীয়। সমস্যা হল গুরুবাদে; আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদের অভ্যন্তরে সমস্যা। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted