চিন্তাসূত্রের খেরোখাতা
(তৃতীয় পর্ব)
১০১. ব্রহ্ম এবং তাঁর অবিচ্ছেদ্য শক্তি অভেদ। নিস্ক্রিয় ব্রহ্মই যখন সক্রিয় হয় তখন তাকে শক্তি বা আদ্যাশক্তি বলে।যেমন, অগ্নি এবং তার দাহিকা শক্তি, চন্দ্র এবং চন্দ্রের কিরণ। দাহিকাশক্তি ছাড়া যেমন অগ্নির অস্তিত্ব নেই, তেমনিভাবে অগ্নি ছাড়া দাহিকাশক্তি। চন্দ্র এবং চন্দ্রের কিরণের ক্ষেত্রেও সমানভাবে কথাটি প্রযোজ্য।এক ব্রহ্ম এবং শক্তিকেই আমরা বিভিন্ন নামে অভিহিত করি:
ব্রহ্ম +আদ্যাশক্তি
পুরুষ +প্রকৃতি
ব্রহ্মা + ব্রহ্মাণী (সরস্বতী)
বিষ্ণু +বৈষ্ণবী (লক্ষ্মী)
মহেশ্বর + মাহেশ্বরী ( কালী)
১০২.তিনি এক, কিন্তু রুচির বৈচিত্র্যময়তার জন্যে প্রকাশ অনন্ত।সনাতন ধর্মানুসারে চিন্তার অতীত পরমেশ্বর যে রূপে সৃষ্টি করেন সেই রূপের নাম ব্রহ্মা, যে রূপে জগৎ পালন করেন সেই রূপের নাম বিষ্ণু এবং যে রূপে লয় বা নাশ করেন সেই রূপের নাম শিব বা মহেশ্বর। এ সহজ কথাটিই তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে এবং শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে খুব সুন্দর করে বলা আছে।প্রকৃতির তিনটি গুণ-সত্ত্ব, রজ এবং তম। পরমেশ্বর এক হলেও এই তিনটি গুণের প্রভাবে বিশ্বের সৃষ্টি -স্থিতি-লয়ের জন্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপ ধারণ করেন। শুধু আমরা বহু ভেবে বিভ্রান্ত হই।
১০৩.শব্দ এবং শব্দ থেকে উৎপন্ন তার অর্থকে যেমনটি আলাদা করা যায় না; ঠিক একইভাবে শিব এবং শক্তিকেও আলাদা করা যায় না।শব্দ এবং শব্দের অর্থ যেমন করে সম্পৃক্ত ; ঠিক একইভাবে সম্পৃক্ত জগতের আদি পিতা-মাতা শিব এবং পার্বতী। বাগর্থ সহ সকল প্রকার বিদ্যা কলার প্রতিপত্তির জন্যে আমরা পার্বতী-পরমেশ্বরকে সদা বন্দনা করি।শিবলিঙ্গ হল জগতের আদি পিতামাতা শিবশক্তির মিলনের প্রতীক।
১০৪.উপাস্য হিসেবে আলাদা আলাদাভাবে উপাসনা করলেও আমরা মূলত এক ব্রহ্মেরই অনন্ত রূপ-রূপান্তরের উপাসনা করি। তাই বর্তমানের কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কথায় সংশয়াছন্ন না হয়ে আমরা আমাদের পূর্ববর্তী ঋষি-মুনিদের পথেই সাকার-নিরাকারের সমন্বয়ে অধিকারী ভেদে এক পরমেশ্বরের উপাসনা করতে চাই। বেদে বলা আছে, "সেই এক পরমেশ্বরকেই আমরা অগ্নি, যম, মাতরিশ্বান সহ বিভিন্ন নামে অভিহিত করি।"বিভিন্ন নামে এবং রূপে অভিহিত করলেও তিনি বহু নন, তিনি আদতে একজনই।
১০৫. মানবসভ্যতার ইতিহাস, দর্শন একটি খোলা খাতার মত, যার প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠাগুলি নেই। শুধু হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলিই খুজছি আমরা যে যার মত। এতেই তৈরি হচ্ছে, বিভিন্ন মতপথ এবং সম্প্রদায়।
১০৬. ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরে দেশে, "সব গেল মইরা, রাজ্য পাইলো হইরা"- দশার মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তির ইন্ধনে যোগ্যদের অবর্তমানে অযোগ্যদের পদায়ন হয়। সে ঘাটতি এখনও পূরণ হয়নি।
১০৭ জগতে যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, তার সকলই সত্যি নয়, আবার যা যা দেখতে পাইনা তার সকলই মিথ্যা নয়।
১০৮.ধান থেকে যত বেশী চাল বের হবে, তত বেশী ধানের তুষ হবে, এটাই স্বাভাবিক। একইভাবে যত বেশী মানুষ ভালবাসবে, তত বেশী মানুষ ঈর্ষা করবে, ঘৃণা করবে, বদনাম করবে।
১০৯.বাঙালী হিন্দুকে দিব্যজ্ঞানের সাথে সাথে একটু কাণ্ডজ্ঞান দেয়ার প্রয়োজন আছে। বিশ্ব উদ্ধারের অলিক বাস্তবতায় হুজুগে উন্মাদ হয়ে জাতিগতভাবে বাঙালি হিন্দুরা অনেক ক্ষেত্রেই আজ নিজভূমে পরবাসী।
১১০.সকলকে বুকে জড়িয়ে ধরতে যেয়ে আমাদের নিজেদের বুকই ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমরা যতই শান্তির বাণী নিয়ে দস্যুদের কাছে যাচ্ছি, দস্যুরা ততই দস্যুতর-দস্যুতম হয়ে যাচ্ছে।সাধুসজ্জন এবং দস্যুকে একই সাথে গুলিয়ে ফেলছি আমরা এবং আমাদের কিছু অপরিনামদর্শী সাধুবাবারা। ফলে প্রতিনিয়তই জাতিগতভাবে প্রতারিত হচ্ছি, ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছি আমরা।
১১১. যতদিন আমরা বেদমাতা থেকে বিচ্যুত থাকব ততদিন আমাদের বর্তমান কালের মত হতভাগা হতচ্ছারার মত দিন কাটাতে হবে । কিন্তু যখন আমরা বেদ মাতার কোলে চড়ে তার অমৃতময় স্তন্যরূপ পরা-অপরা জ্ঞানরাশি আস্বাদ করতে পারবো তখনই আমাদের জাতির জীবনে এক নতুন সূর্যোদয় হবে ।
১১২."এসো ঋত-ঋদ্ধির পথে।" এ বাক্যটি হল আমাদের মূলে ফেরার আহ্বান। 'ঋত' শব্দের অনেকগুলো অর্থ হয়, এর মধ্যে প্রধান অর্থগুলো হলো- ঈশ্বর, ধর্ম, সুশৃঙ্খল নিয়ম এবং সত্য। আর 'ঋদ্ধি' শব্দের প্রধান অর্থই হলো সমৃদ্ধি অর্থাৎ জাগতিক সমৃদ্ধি। অর্থাৎ সত্য, সনাতন, পরমেশ্বর এবং এর সাথে জাগতিক সমৃদ্ধিময় সুশৃঙ্খল বৈদিক জীবনের পথে এসো । কারণ এখানেই পরম আনন্দ এবং শান্তি নিহিত ।
১১৩.এ ভূখণ্ডের আবহমান সংস্কৃতিকে যারা বুকে ধারণ করে আছে সেই হিন্দু জাতির আজ দুঃখ-যাতনার অন্ত নেই । সীমাহীন মিথ্যাচারে আবহমান সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবার জন্য আছে একদল তথ্যসন্ত্রাসী। এদের প্রধান লক্ষ্য এ দেশের সংস্কৃতির অভিমুখকে ঘুরিয়ে দিয়ে অতীতের সাম্রাজ্যবাদীদের অপূর্ণ কাজকে বর্তমানকালে পূর্ণ করে তোলা । সে লক্ষ্যেই চলছে তাদের ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সর্বপ্রকার কর্মকাণ্ড । এ কর্মকাণ্ডে তারা অনেকটাই প্রায় সফল । কারণ তাদের প্রচারণার ফলে হিন্দু জাতি আজ দিশেহারা। হিন্দু কিশোর, তরুণ, যুবক টেরও পাচ্ছেনা যে অজ্ঞাতসারে তারা কোন সর্বনাশা অন্ধকারময় তথ্যসন্ত্রাসের জালে জরিয়ে যাচ্ছে ।
১১৪.ধর্মীয় কি শিক্ষা দিচ্ছি আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের? এককথায় বলতে গেলে কিছুই না। আজ পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ, গান, কবিতা, আবৃতি, খেলাধুলা সবকিছু শেখার সময় এবং টাকা পয়সা আমাদের আছে; শুধু একরাশ কার্পণ্য ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে । এর ফল তো আমরা চারপাশে দেখতেই পাচ্ছি । কোর্টে যখন ছেলে মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়, তখন মা বাবা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেললেও কোন লাভ তো হয়না; উল্টো সেই ছেলে অথবা মেয়ের অচিন্ত্য, অস্রাব্য, অসভ্যতা পিতা মাতার সর্বসমক্ষে হজম করতে হয়।আর ধর্মীয় শিক্ষার নামে তাদের যা শিক্ষা দিচ্ছি তা হল কতগুলো ঠাকুমা দিদিমার গালগল্প । অবাস্তব, অলৌকিক পৌরাণিক উপাখ্যান এবং আশাস্ত্রীয় কিছু ব্যক্তিগত মতের কৃত্রিম কথার ফুলঝুড়ি ।
১১৫.বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত।সেই বেদের ছিটে-ফোঁটাও কি আছে আমাদের জনজীবনে! বৈদিক সৃষ্টি তত্ত্ব যা কি-না পুরোটাই প্রায় বিজ্ঞানসম্মত অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেই, মধু-কৈটভের মেদ থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি; এ কারণেই পৃথিবীর আরেক নাম মেদিনী।পুরাণের এ তথ্যের হয়তো কোন রূপক ব্যাখ্যা আছে।কারণ পুরাণগুলোর তৈরীই হয়েছে রূপকের মাধ্যমে, গল্পের মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞানের প্রকাশ ঘটানোর জন্য । আমরা যদি সেই রূপকগুলোকে ধরতেই না পারি, তবে সমস্যা তো দিনেদিনে বাড়বেই। পুরাণগুলোর অনেক কথাই ব্যঞ্জনা এবং লক্ষণা অলঙ্কারের মাধ্যমে বলা । তাকে যদি আমরা অভিধা বা আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করি তবে অর্থের বিকৃতি তো ঘটবেই । অর্থাৎ অলঙ্কারের মাধ্যমে সাহিত্যে যা বলা হয়েছে তার সবটাই আভিধানিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না । তাই পুরাণগুলোকে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমেই একমাত্র গ্রহণ করতে হবে। পুরাণগুলোতে যেমন অসাধারণ অনেক উপাদান আছে, তেমনি আছে আপত্তিকর অনেক তথ্যাবলি। তাই পুরাণের সবটুকুই গ্রহণযোগ্য নয়।
১১৬.একটা টেবিলে কিছু ভালো ফল আছে এবং গুটিকয়েক পঁচা ফলও আছে । একটা শিশু ফল খাবার জন্য দৌড়ে এসে যদি সেই গুটিকয়েক পঁচা ফলের উপরই তার হাত বাড়ায়, এবং মুখে দিয়ে বুঝতে পারে ফলটি পঁচা; তবে থু দিয়ে সে শুধুমাত্র পঁচা ফলটি ফেলে দিবে তাই নয়, তার ধারনা হবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা এবং হাজার চেষ্টা করেও শিশুটিকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে যে টেবিলে ভাল ভাল সরস ফলও আছে । তার ধারণা জন্মাবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা । এমনটাই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে প্রায় প্রত্যেকটা হিন্দু পরিবারে।
১১৭.শিশু বয়সে ঠাকুমা দিদিমার গালগল্পের মাধ্যমে যে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তার ভিৎ দিন দিন নরবরে হয়ে যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । একুশ-বাইশ বছরের দিকে যখন বুদ্ধি পূর্ণতা পায়, তখন সে ভাল মন্দ বিচার করতে পারে ; তখন এ ভাল মন্দ বিচার করতে যেয়েই সে ধান এবং ধানের চিটাকে একাকার করে ফেলে এবং অজ্ঞানতার জন্য চিটার সাথে সাথে ধানকেও ঝেড়ে ফেলে দেয়।সঠিক-বেঠিক বোধটাকে সে গুলিয়ে ফেলে। পরিণামে সে হয়ে ওঠে অবিশ্বাসী।এ অবিশ্বাসের মাত্রা দিন দিন বাড়তে বাড়তেই সে হয়ে যায় ঘোরতর নাস্তিক।পরিণামে সে পরিবার, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতির, মহাবৈরী হয়ে যায় ।
১১৮.একটা সময় ছিল যখন আমরা পড়ালেখা জানতাম না এবং এ শাস্ত্র গ্রন্থগুলোও আমাদের হাতের কাছে ছিলোনা । এগুলো ছিল হাতে লেখা পুঁথি । তখন খুব কম মানুষই পড়ালেখা জানত এবং সেই পড়ালেখা জানা মানুষের মধ্যে খুব কম লোকই সেই গ্রন্থগুলো পড়ার সুযোগ পেতো । কিন্তু আজ তো সেই সমস্যা নেই । আজ আমরা নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই পড়ালেখা জানি। এর সাথে আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থগুলো হাতেলেখা পুঁথি থেকে আজ প্রেসে ছাপা পুস্তক আকারে আমাদের কাছে এসেছে । তাই আমাদের উচিৎ অন্যের মুখে শুনে ধর্ম না করে, নিজেই শাস্ত্রের কোথায় কি আছে তা চেক করে দেখা। অন্যের মুখে নয়, নিজের মুখেই টক-ঝাল-মিষ্টি খাওয়া।
১১৯.হিন্দু ধর্ম থেকে আলাদা ধর্ম হয়ে যাওয়া তিনটি প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে শিখ অন্যতম। জয়দেব গোস্বামী, আচার্য রামানন্দ, সন্ত কবীর, সন্ত নামদেব, সন্ত রবিদাস, সন্ত সেনাজী, সন্ত পিপানন্দ সহ অনেক উত্তর ভারতের হিন্দু বৈষ্ণব সাধকদের রচনাবলীর উপরে শিখ মত প্রতিষ্ঠিত। সে হিসেবে শিখদের একটি নিরাকার বৈষ্ণব সম্প্রদায় বললে খুব বেশী অত্যুক্তি হয় না।
১২০.আমরা হয়তো অনেকেই জানি না শিখদের ধর্মগ্রন্থ গুরুগ্রন্থসাহেবে প্রায় তিনহাজারবারের উপরে রামনাম আছে ; প্রায় ষোল হাজারের কাছাকাছি কৃষ্ণ বা শ্রীহরির নাম আছে ; এ ছাড়া কেশব, গোবিন্দ, গোপাল, দামোদর, মাধব, মধুসূদন, মুরারী, মুকুন্দ, বাসুদেব, বিষ্ণু প্রভৃতি ভগবান শ্রীহরির নাম আছে প্রায় দুই হাজার স্থানে।
১২১.ভারতবর্ষে তুর্কি পাঠানেরা যখন তাদের নৃশংস দখলদারিত্ব চালাতে থাকে; তখন তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই ছিলো হিন্দুদের পবিত্র সকল বস্তু এবং বিশ্বাসকে অপবিত্র করা। সে লক্ষ্যে তারা তাদের করনীয় সকল কিছুই করে চলে।ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের সবচেয়ে পরম শ্রদ্ধেয় হলেন সাধু, সন্ন্যাসীবৃন্দ ; এবং সাধু, সন্ন্যাসীদের চেনার চিহ্নই হল তাদের হাতে রাখা দণ্ডকমণ্ডলু। এ সন্ন্যাসীদের হাতে থাকা পবিত্র কমণ্ডলুই তুর্কিরা প্রথম টয়লেট কার্যে ব্যাবহার শুরু করে শুধুমাত্র হিন্দু ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্যে।কমণ্ডলুর উপরের ধরণী অংশটা বাদ দিলেই এটা বর্তমানে আমাদের ব্যবহৃত বদনা হয়ে যায়, যা তুর্কিদের দেখানো পথে আমি আপনি সকলেই টয়লেটে প্রতিনিয়ত নিজের অজান্তেই ব্যবহার করে ঋষিদের অপমান করে চলছি।
১২২.বর্ত্তমান সন্ন্যাসী, সাধু-সন্ত এবং গুরুরা যেভাবে গদিবালিস সর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে, তারা আর ধর্মের কাজ কিই বা করবে, কখনই বা করবে ; তাদের সে সময় কই? ধর্ম প্রচার তাদের কাছে হয়ে গেছে চতুর্থ বিষয়। যা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। ইউরোপ আমেরিকা থেকে আসা খ্রিস্টান মিশনারীরা তাদের আধুনিক ভোগ বিলাস পরিত্যাগ করে যেভাবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করে; সেভাবে আমাদের কয়জন সাধু প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আমাদের ধর্ম প্রচার করে? না, করেনা বলেই আজ আমাদের এই হতচ্ছাড়া দশা।
১২৩. আমরা হলাম সেই দীঘি, যে দীঘিতে সবাই আসে ধর্মান্তর নামক মাছ শিকার করতে। এবং প্রতিদিনই বিধর্মী ধর্ম ব্যবসায়ীদের শিকারে পরিণত হয়ে আমরা আজ দিনেদিনে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সমাজের ব্যবসায়ীদের দানকৃত মাখনগুলি খেয়ে, গদিবালিশে সুয়ে, পেট দুলিয়ে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুব্যাবসা করে যাচ্ছে ভণ্ড বাবারা। এদের যথাসম্ভব প্রত্যাখ্যান করুন, প্রতিরোধ করুন।
১২৪.শ্রীশংকরাচার্যের হাতে জন্ম নেয়া হিন্দু সংগঠন এবং ভারতীয় বৈদান্তিক আধ্যাত্মবাদ পৃথিবীব্যাপী কিভাবে ছড়িয়ে যাবে সে পথ আমাদের দেখান স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজী ছিলেন প্রাচীন এবং বর্তমান ; ভারতবর্ষীয় এবং পাশ্চাত্ত্যের সফল যোগসূত্রকারী। তাঁর পূর্বেও কয়েকজন বাঙালীর সন্তান প্রতাপচন্দ্র মজুমদার এবং মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় গিয়েছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ প্রচারে ; কিন্তু তাঁরা তেমন সফলতা বা সাড়া পাননি। কিন্তু স্বামীজী তাঁর পাণ্ডিত্য এবং বিদগ্ধতায় এলেন, দেখলেন এবং জয় করে নিলেন পাশ্চাত্য-আমেরিকানদের হৃদয়।
১২৫.বেদের বিভিন্ন স্থানে সংগঠনের কথা আছে। এমনকি বেদের বহুল প্রচলিত 'সংজ্ঞান' সূক্তের মধ্যেও সংগঠন বাচক 'সমিতি' শব্দটি আছে। কিন্তু আধুনিক যুগে হিন্দুজাতির প্রথম সংগঠন তৈরি করেন শ্রীশঙ্করাচার্য।তার দেখানো পথে পরবর্তীকালে রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য,নিম্বাকাচার্য, আচার্য রামানন্দ, শ্রীচৈতন্যদেব, শঙ্করদেব প্রমুখ আচার্যবৃন্দ জাতি রক্ষার্থে সঙ্ঘশক্তিকে অবলম্বন করে অগ্রণী সাংগঠনিক ভূমিকা গ্রহণ করেন।
১২৬. স্বামী বিবেকানন্দ চেতনার বাতিঘর।আধুনিক ভারতবর্ষের আইকন। আধুনিক হিন্দুজাতির আইকন। আজ আমরা প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে যে চিন্তার কাঠামো তৈরি করি তার অন্যতম কারিগর এবং চিন্তাসূত্রকার তিনি। নেতাজী সুভাষ বসু থেকে সকল বিপ্লবীদের প্রেরণার বাতিঘর ছিলেন তিনি। তরুণ এবং যুবসম্প্রদায়ের জাগরণে তাঁর অবদান অনন্যসাধারণ। তাইতো তাঁর জন্মদিন ভারতে যুবদিবস হিসেবে পালিত।
১২৭.সর্বধর্মের নামে গোজামিল দেয়া, আত্মঘাতী স্বজাতি ধ্বংসের তেলবাজি কখনো আমাদের জন্যে কল্যাণকর নয়।
১২৮. মুক্তিলাভের জন্য সদগুরুর প্রয়োজনীয়তা আছে; কিন্তু তা বাধ্যতামূলক না। আপনার যদি ইচ্ছে হয় তবে আপনি একটি কেন দশটি গুরুরও শরণ নিতে পারেন। তাতে আমাদের কোন বাধা নেই। কিন্তু আপনি বলতে পারবেন না যে গুরু ছাড়া মুক্তিলাভ অসম্ভব। এ কথাটার প্রতিই আমাদের ঘোরতর আপত্তি। অর্থাৎ আপনার ইচ্ছে হলে আপনি যেমন মানুষ গুরুর শরণ নিতে পারেন, আবার তেমনি কেউ যদি পাতঞ্জলদর্শন অনুসারে পরমেশ্বরকে এবং বেদাদি শাস্ত্রগ্রন্থকে গুরুরূপে মনে করে শিখদের ন্যায় তবে তাকেও আপনি অস্বীকার করতে পারেননা। এ বিভিন্ন মতপথের স্বাধীনতা আমাদের ধর্মেই দেয়া আছে।
১২৯.সনাতন ধর্মে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের উপাসনা পঞ্চমতে ও পথে বিভজিত যথা- শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রধানত শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব তিনটি মত-পথের সম্প্রদায় বিদ্যমান। নিজ নিজ উপাস্য সম্প্রদায় ব্যতীত এ পঞ্চমতের সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে। পক্ষান্তরে কোন আন্তঃসম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করা যাবে না।ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্মীয় মতবাদের ততটুকুই গ্রহণযোগ্য যতটুকু বেদানুমোদিত। তবে বেদানুগত সকল মহামানবের প্রতি সংযত শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
১৩০. যদি বেদানুগত শ্রীবাল্মিকী, শ্রীবেদব্যাস, শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীরামানুজাচার্য, শ্রীনিম্বার্কাচার্য, আচার্য শ্রীরামানন্দ, আচার্য শ্রীরবিদাস, শ্রীমাধবাচার্য, শ্রীচৈত্যন্য, সমর্থ শ্রীরামদাস, শ্রীশঙ্করদেব, শ্রীরামকৃষ্ণ, লোকনাথ ব্রহ্মচারী এদের মতো সদগুরু হয় আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তারা যদি হয় রজনীশ, আসারাম, রামপাল, রাধে মায়ের মতো ভণ্ড, লোভী, দুশ্চরিত্র, পাষণ্ড ; তাহলে একবার হলেও আপনি চিন্তা করুন আপনার কি গতি হবে? একটা বৃক্ষে পূর্বে শ্রীফল দিত, কিন্তু বর্তমানে সেই বৃক্ষই বিষফল দিচ্ছে। আপনি কতদিন এই গাছকে বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন? পারবেন না,বিষে জর্জরিত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবেন।
১৩১.শ্রীগোবিন্দাচার্যের মতো গুরু হলে আপনি শ্রীশঙ্করাচার্যের মতো শিষ্য পাবেন। সমর্থ শ্রীরামদাসের মতো গুরু পেলে আপনি ছত্রপতি শিবাজীর মত রাজা পাবেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো গুরু পেলে আপনি স্বামী বিবেকানন্দের মতো বিশ্বদরবারে ভারতবর্ষ এবং সনাতন ধর্মের মুখ উজ্জ্বল করা বিশ্বজয়ী শিষ্য পাবেন। কিন্তু এই বৈদিক জ্ঞানহীন গুরু নামধারী শিষ্যের পকেট লোপাট করা ভণ্ডদের থেকে কি পাবেন আপনি?
১৩২.ভাবতে অবাক লাগে গুরু যদি ঈশ্বরের পথদ্রষ্টা হয় তবে গুরুই কেন ঈশ্বর সেজে বসে যায় পূজার আসনে? ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে আমরা পরবর্তীতে তাকে নিয়েই এবং তার পূজাপাঠেই ব্যস্ত হয়ে পরি। আর এই সকল গুরুরা শিষ্যদের পকেট মারতেই সদা ব্যস্তসমস্ত হয়ে নিজের সাথেসাথে তার বউপোলাপান-নাতিপুতির সহ ভবিষ্যতের বংশধরদের জন্যে অন্নসংস্থানের নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থা করে যান।
১৩৩.কোন মানুষকে যখন অবতার বলে আমরা চিহ্নিত করি, প্রচার করি তখন আমরা অজ্ঞানতাবশত সেই মহামানবকেই ছোট করি, তার সারাজীবনের অর্জনকেই ছোট করে ফেলি। যখন তিনি অবতার, তখন তিনি ত উচ্চতর স্থরে হবেনই এটাই স্বাভাবিক ; কিন্তু যখন সাধারণ মানুষ আস্তে আস্তে দেবত্বের দিকে যায়, সে পথ ক্ষুরের অগ্রভাগের মত বিপদসংকুল।
১৩৪.যেমন ভাবনা, তেমনই জীবন।
মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনির্মাতা। আপনিই পাথর, আপনিই আপনার হাতেই পাথর কাটার ছেনি-হাতুড়ির ছন্দ, আপনিই মূর্তি, আপনিই সব।
১৩৫. এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম এবং রূপের পূজা করি, উপাসনা করি আমরা। যত দেবদেবী প্রতিমা সকলই আদতে এক ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। কিন্তু আমরা দেখি যে বিভিন্ন পূজায়, এই ফুল দেয়া যাবে না, ঐ ফুল দেয়া যাবে না, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না; বলে শাস্ত্রীয় নির্দেশ। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের আমার।সকল দেবদেবী যদি একই পরমেশ্বরের প্রকাশ হয় তবে আমার মতামত হলো, আমরা শিবপূজা, বিষ্ণুপূজা, কালীপূজা সকল পূজাতেই তুলসী পাতা, বেলপাতা, জবা ফুল দিয়ে করবো। তাতে আমাদের মধ্যে আলাদা আলাদা উপাস্য বিগ্রহ হলেও, তারা যে একই ব্রহ্ম এ উপলব্ধির পূর্ণতা পাবে ব্যাবহারিকভাবে।ফুল-পাতা কোন বিষয় নয়, শুধুমাত্র ভক্তিটা থাকলেই হবে। ভগবান অন্তর্যামী, তিনি শুধু ভাবটুকুই নেন, তাইতো তাকে বলা হয়- "ভাবগ্রাহী জনার্দনঃ।"
১৩৬. শ্রীচণ্ডীতে মধ্যমচরিত্রে যেখানে আমরা মহালক্ষ্মীর হাতে ঘন্টা দেখি, কিন্তু আমরা প্রাত্যহিক জীবনে লক্ষ্মীপূজাতে দেখি ঘন্টা বাজানো নিষেধ ; কেউ ঘন্টা বাজালে আমাদের মা-মাসি-পিসিরা তেড়ে আসে।তাদের কি দোষ তাদের আবহমানকাল থেকে শিখানো হয়েছে মা লক্ষ্মী ঘন্টাবাদ্য একদমই সহ্য করতে পারে না ; যে ঘন্টা বাজাবে তার গৃহেরও ঘন্টা বেজে যাবে! অথচ শাস্ত্রে আছে, সর্ববাদ্যময়ং ঘন্টা। এ ঘন্টার মতই প্রচলিত মতে বিভিন্ন পূজায় বিভিন্ন বাদ্য নিষিদ্ধ। কোথাও ঢাক নিষিদ্ধ, কোথাও সানাই ইত্যাদি।
এক ব্রহ্মের একত্বের উপলব্ধিতে আমরা সকল দেবদেবী পূজার ভিন্ন ভিন্ন উপাচারে প্রত্যেক দেবদেবীকেই আরাধনা করতে চাই। কারণ বিভিন্ন নামে আমরা শুধুমাত্র একজনকেই উপাসনা করি। আমরা রুচির বৈচিত্র্যময়তার জন্যে বিভিন্নভাবে তাকে কল্পনা করি, কিন্তু তিনি বহু নন। সর্বত্রই সেই একেরই খেলা, বহু কেবল বুদ্ধির কলুষতায়।
১৩৭.অর্থাৎ তিনিই সব। এক সূর্যের নিচে যদি একহাজার জলভরা কলশি রেখে একজনকে দেখতে বলা হয়, তবে যে জ্ঞানী সে বলবে আমি এক সূর্যের নিচে রাখা হাজারটা কলশির জলে হাজারটা একই সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখছি। পক্ষান্তরে যে অজ্ঞানী সে বলবে আমি আলাদা আলাদা হাজারটা সূর্য দেখছি। এক এবং বহুত্বে সেই একজনই। তিনিই এক, তিনিই বহু। পার্থক্য শুধুমাত্র জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর দেখার ভঙ্গিতে।এ বিষয়টি বেদাদি-পৌরাণিক শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে তো আছেই, অসংখ্য কবিরাও এ বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
১৩৮. দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাঙালি হিন্দু ইতিহাস থেকে কখনো শিক্ষা নেইনি। সে শিক্ষা-দীক্ষায় অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকার পরেও প্রতিনিয়ত হেরে গেছে, শুধুমাত্র কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণে। সে শুধু কোয়ালিটির পেছনেই দৌড়েছে, কিন্তু দিনশেষে দেখা গেল যারা শুধুমাত্র 'পয়দা কর, ফায়দা লোট' এ আদর্শে চলেছে তারাই আজ কোয়ান্টিটির জোরে জয়ী। আর বাঙালি হিন্দু হতভাগা হয়ে লক্ষ্মীছাড়াদশা।ইতিহাসের পাতায় পাতায় সে শুধু ভুল করেই গিয়েছি। যে ভুলের খেসারৎ সে প্রতিনিয়ত দিয়েই চলছে, আর কতকাল দিতে তা কেউ জানেনা।
১৩৯.১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা আমাদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে যখন পাশ্চাত্য ভাষায় এবং পাশ্চাত্য রীতিনীতিতে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে রূপান্তরিত করে ; তখন থেকেই যে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয় সেই জাল আজও আমরা ছিন্ন করতে পারিনি। এ ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম নায়ক হলেন লর্ড ম্যাকলে। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের জনসাধারণ শুধু নামেই থাকবে ভারতীয়, কিন্তু তার চাল-চলন, আচার-ব্যাবহার সব কিছুই থাকবে ব্রিটিশের মতো। ভারতীয়রা থাকবে তাদের পোষা কুকুরছানার মতো। ইচ্ছে হলে আদর করবে, আর না হলে লাথি দিয়ে বের করে দিবে।
১৪০.ব্রিটিশদের সত্যি অনেক ভবিষ্যদ্দৃষ্টি
বলতে হবে; কারণ তারা যা চেয়েছে আজ তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। সীমাহীন মিথ্যাচার এবং তথ্যসন্ত্রাস চলছে আমাদের ইতিহাসকে ঘিরে। এ ইতিহাসের ঘুর্ণিপাকে আমরা দিন-রাত্রি হাতরে বেড়াচ্ছি পারের এবং সত্যের ঠিকানা। মিথ্যাচার করার জন্যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কথা না হয় বাদ দিলাম, সামান্য সার্থের জন্যে নিজ ধর্মাবলম্বী ভণ্ড অসংখ্য ছদ্মবেশী গিরগিটিদের অন্ত নেই। এদের অপসৃত করে আমাদের ফিরতে হবে পারের ঠিকানায় এবং একতার ঠিকানায়। তা নাহলে কেউ বাঁচতে পারবো না।
১৪১. এদেশের অসহায় সংখালঘু সম্প্রদায়েরা যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে একাত্তুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জন্ম নেয়া এ রাষ্ট্রটিও আসল স্বরূপে বাঁচতে পারবে না। সে তাঁর সুজলা-সুফলা মাতৃত্বের স্বরূপ হারিয়ে হয়ে উঠবে ধু ধু রুক্ষ মরুভূমির ভয়ংকরী কাঁটাবন। আর তাঁর বুকের উপর ধংসের প্রলয় উল্লাস করে বেড়াবে হিংস্র শ্বাপদের দল।
১৪২.মানবজীবনে যৌনতা একটি প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সবাই চায় এবং সুযোগ বুঝে সদ্ব্যাবহার বা অসদ্ব্যবহারও করে, শুধুমাত্র মুখে প্রকাশে অস্বীকৃতি ও অস্বস্তি। দিনেরবেলা যৌনতার বিরুদ্ধে যতই লেকচারই দেই না কেন রাত্রে দেখা যায় সে হিংস্র বাঘ হয়ে ক্ষতবিক্ষত করে আমাদের হৃদয়কে। আমাদের শাস্ত্রে বারেবারেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এ চতুর্বর্গের কথা আছে, আমরা হয়তো ভুলে যাই এ চতুর্বর্গের মধ্যে কামও আছে। কাম জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, জীবনের বাইরে না।
১৪৩.কিন্তু আমাদের অনেক তথাকথিত সাধু-সন্ত যেভাবে কামের বিরুদ্ধে, প্রেমের বিরুদ্ধে লেকচার দিয়ে বেড়ান তা সত্যিই দুঃখজনক। তাদেরকেই যদি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার সামনে রাখা যায় তাহলে বোঝা যাবে তাদের প্রকাশ্যে দেয়া লেকচারগুলি কতটুকু যৌক্তিক? কথাগুলি শুনে হয়তো অনেকেই বলবেন যে, আমি খোলামেলা যৌনতার পক্ষে সাফাই গাচ্ছি বা প্রোমোট করছি। বিষয়টা ঠিক ওরকম না। কোন বিষয়েই অতিরিক্ত ভাল নয়, সকল কিছুতেই মধ্যপন্থা যৌক্তিক। কথাটা গীতার ষষ্ঠ অধ্যায় ধ্যানযোগে অত্যন্ত সুন্দর করে বোঝানো আছে।বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তখনই থাকে যখন স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে একাধিক যৌনতার স্বীকৃতি থাকে। দৈহিক সম্পক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে দৃঢ় করে, তীব্র করে, আকাঙ্ক্ষিত করে এবং সর্বোপরি দীর্ঘ করে। বেদে ঋতুকালে স্ত্রীর সান্নিধ্যকে ব্রহ্মচর্য বলা হয়েছে।
১৪৪.মা বা সংস্কৃত অম্বা শব্দটা একটি পবিত্র শব্দ। জগতে পরমেশ্বরের পরেই মায়ের স্থান।তাই বেদের সমাবর্তন ভাষণে বলা আছে, "মাতৃদেবো ভব।" মা দেবতাস্বরূপ। মনুসংহিতার বলা আছে, একজন শিক্ষক থেকে জন্মদায়িনী মাতা একলক্ষ গুণে শ্রেষ্ঠ। এ কারণেই মাতৃ শব্দটি নিয়ে যথেচ্ছাচার করতে শাস্ত্রে নিষেধ করা আছে। কিন্তু আমরা ইদানিং কিছু সাধুদের দেখি সবাইকেই মাতাজী ডাকার নির্দেশনা দিতে। সাধু-সন্ত সকল নারীকেই মাতৃজ্ঞানে দেখে মাতাজী সম্বোধন করবে, এটাতে সমস্যা নেই ; বরঞ্চ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আমরা দেখি কিছু পঁচিশ-ত্রিশ বছরের ছেলেরা তাদের সমবয়সী মেয়েদের মাতাজী ডাকছে তখন বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক লাগে আমাদের কাছে। যাদের প্রতিনিয়ত মাতাজী ডাকছে তাদের সাথে বয়সের কারণে প্রেম করছে, বিয়ে করছে, সবকিছুই করছে। তাহলে মাতাজী শব্দটির সম্মানটা আর রইলোই বা কোথায়?
শাস্ত্রে আছে কাউকে ভুলক্রমেও যদি মা বা মাতাজী সম্মোধন করা হয়, তবে তার সাথে আর প্রেম, বিয়ে বা কিছুই করা সম্ভব না। এমনকি স্বামীও যদি বউকে ভালবাসার ছলে মা বলে ডেকে ফেলে, তাহলে সেই স্ত্রীর সাথে আর স্ত্রীজনচিত কাজ করতে পারবে না। মা বলে ডাকা স্ত্রীর সাথে স্ত্রীজনচিত কাজ করতে হলে স্বামীকে আগে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, চান্দ্রায়ণ করতে হবে। তাহলেই বুঝুন মা শব্দটা কতটা পবিত্র।
১৪৫.আমাদের সর্বাগ্রে দরকার ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন। কিন্তু ব্রহ্মচর্য ব্রহ্মচর্য বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের কিছু সাধুসন্তরা পাগল করে তুলছে আমাদের যুবক,তরুণ এবং কিশোরদের। যার ফলে হিন্দু তরুণীরাও হিন্দু যুবক-তরুণদের মাকাল ফল মনে করে দূরে সরে যাচ্ছে। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে বিভ্রান্ত হয়ে, ধর্মান্তরিত হয়ে, বিধর্মীদের বিয়ে করে, ব্যক্তিজীবন এবং পারিবারিক জীবনকে অশান্ত করে তুলছে।আর কতকাল আমরা ভাবের ঘরে চুরি করে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখবো, এখনও কি ঝেড়ে কাশার সময় আমাদের আসেনি?
১৪৬.আজ থেকে ৬০/৭০ বছর আগেও হিন্দু -মুসলিম নির্বিশেষে আমরা সবাই নামের আগে "শ্রী" শব্দটি ব্যবহার করতাম। আফগানিস্তান (গান্ধার) থেকে ইন্দোনেশিয়া (যবদ্বীপ), ব্রুনাই, ভিয়েতনাম সর্বত্রই শ্রী ব্যবহৃত ছিলো। এমনকি বর্ত্তমান মুসলিম রাষ্ট্র ব্রুনাইয়ের রাজধানীর নামের সাথে বর্ত্তমানেও শ্রী শব্দটি ব্যবহৃত- বন্দর শ্রী ভগবান (বন্দর শিরি ভগওয়ান)। ভারতবর্ষ তো বটেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রত্যেকটা ভাষাতেই শ্রী শব্দটি আজও ব্যবহৃত।
১৪৭.শ্রী শব্দটি সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। ঋগ্বেদের খিলসূক্তে শ্রীসূক্ত নামে একটি সূক্ত আছে। সেখানে লক্ষ্মী স্বরূপা মহাদেবী শ্রীর মাহাত্ম্য অসাধারণ শব্দ ব্যঞ্জনায় বর্ণনা করা আছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দুরা যেভাবে শ্রী শব্দটি আমাদের জীবন থেকে বিদায় করে দিয়েছি, তাতে দিনেদিনেই আমরা শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছি। এরশাদ আমলে রাষ্ট্রীয় ভাবে শ্রী শব্দটি বাদ দেয়া শুরু হয়। এমনকি কারো নাম যদি শ্রীকান্ত হয় তবে তার নামের শ্রী শব্দটিও শিক্ষা বোর্ড থেকে কেটে শুধুমাত্র কান্ত করে দিয়েছে এরকম অনেক তথ্যই আমরা জানি। শিক্ষা বোর্ড যেহেতু বাদ দিয়ে দিচ্ছে, তাই আমরা যেচে পরেই তখন নিজেরাই নামের সাথে শ্রী শব্দটিকে বাদ দিয়েছি। আমরা ভুলে গিয়েছি শ্রী শব্দটি এই ভূখণ্ডের একটি সর্বজনীন পরিচয়ের চিহ্ন। পুরানো পরচা, দলিলপত্রে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের নামের সাথেই শ্রী দেখা যায়। এমনকি ৮০/৯০ বছর আগেও মুসলিম মাওলানা এবং পুঁথি লেখকদের নামেও অবাদে শ্রী ব্যবহৃত হত। এরকম অনেক পুঁথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত আছে।
১৪৮.আজ এই ভূখণ্ডের শ্রীকে হটিয়ে হিন্দু সরকারি চাকুরিজীবীদের নামের সাথে লেখা হয় জনাব এবং বেগম। হিন্দু মহিলাদের নামের সাথে বেগম লেখা দেখলে ব্যক্তিগতভাবে মুগল বাদশাদের প্রাসাদ এবং হেরেমের হিন্দু বেগমদের কথা মনে হয় আমার। যে বেগমদের নামের সাথে হয়তো হিন্দু নাম আছে, কিন্তু তাদের পেট থেকে উৎপন্ন সন্তান সকলেই মুসলিম। আবার কিছু কিছু হিন্দু বেগমদের পেট থেকে আওরঙ্গজেবের মতো কট্টরপন্থীরও জন্ম হয়েছে। অনেকেই বলে শ্রী শব্দটি নিজের নামে নিজেই ব্যবহার করতে পারে না, কিন্তু এ কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে সকলেই তাদের নামের স্বাক্ষরে তারা শ্রী শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
১৪৯.চৈতন্যের ভাবাদর্শের প্রধান কারিগর ছিলেন নিত্যানন্দ। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিলো সমাজের সকল জাতি,ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে সকল মানবের মাঝে হরিভক্তি প্রচার।তিনি ছিলেন অবধূতপন্থী সন্ন্যাসী। হিন্দুদের সকল বর্ণের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা আকাঙ্ক্ষায় তিনি গঙ্গার তীরে চিঁড়েদধি মহোৎসব অথবা দণ্ডমহোৎসব প্রবর্তন করেন। এ উৎসব ছিলো গত পাঁচশো বছরে অন্যতম জাতপাত বিরোধী বৈষ্ণব উৎসব। এতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সকলে একসাথে খাবার গ্রহণ করে শ্রীচৈতন্যের প্রবর্তিত "আধ্যাত্মিক গণতন্ত্রের" পথে অগ্রসর হয়।
১৫০.নিত্যানন্দের অন্যতম আরেকটি প্রধান কীর্তি ছিলো- ব্রাহ্মণ, বৈদ্য,কায়স্ত নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের রাখাল বন্ধুদের অনুসরণে তাঁর অনুগত বারোজন পরিকরকে "গোপাল" আখ্যা দিয়ে ধর্মরক্ষা এবং ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব অর্পণ। যাঁরা দ্বাদশগোপাল নামেই খ্যাত। দ্বাদশগোপালের সাথে সাথে দ্বাদশ উপগোপালও ছিলো, তাঁরা নদীয়া,হুগলি, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, পুরী সহ আরো অসংখ্য স্থানে সক্রিয় ছিলো।পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নিত্যানন্দ বাংলার গ্রামে গ্রামে ধর্মপ্রচার করে বেড়িয়েছেন। এবং তাঁর ধারাবাহিকতায় তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরভদ্র সাম্যবাদী বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনকে বাংলার তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যান। 'নিত্যানন্দের বংশবিস্তার" নামক গ্রন্থে বীরভদ্রের ঢাকা শহরে বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে ধর্ম প্রচারের বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রবাদী, সাম্যবাদী, লাঞ্ছিত মানুষের প্রেরণার বাতিঘর শ্রী শ্রীনিত্যনন্দদেব।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................