চিন্তাসূত্রের খেরোখাতা
(চতুর্থ পর্ব)
১৫১.পৃথিবীর অন্যদের থেকে আমরা আলাদা।আমাদের চায়ের দোকানে, সেটা শহর হোক বা গ্রাম সেখানে সারা পৃথিবীর রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। আমাদের কাজের মাসিদের কাছে সকলের বাড়ির হাড়ির খবর পাওয়া যায় এবং কিছু মালকড়ি খরচ করলে সেই গরমাগরম হাড়ির খবর সংগ্রহও করা যায়।এলাকায় ওষুধের ফার্মেসির মাধ্যমে পাড়াপড়শি সকলেরই গোপন রোগের আদিঅন্ত জানা যায় এবং প্রয়োজন মত তা ব্যবহৃতও হয়।
১৫২.আমরা পাশেরবাড়িতে আগুন লাগলে নিজের বউ পোলাপানকে আটকে রাখি, আর নিজের বাড়িতে আগুন লাগলে বলি, মানুষ কত খারাপ কারো বিপদে কেউ আসে না।উপকারী ব্যক্তিকে আমরা পুরস্কার দেই, তার ভাণ্ডাফোর করে, মানে উপকারীর সর্বোচ্চ ক্ষতি করে।যে গাছের ছায়াতে আশ্রয় নেই, সেই গাছকেই কারণে অকারণে কেটে ফেলি বা কেটে ফেলার চেষ্টা করি। আবার সেই গাছে নিচে এসে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক যথাসম্ভব লেকচারও দেই।
১৫৩. আমাদের সমাজে বুদ্ধিদীপ্ত তেলবাজি একটি শিল্পের পর্যায়ে পরিনত। যা প্রয়োজনে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এর দ্বারা সকল অসাধ্য কর্মই সাধন করা যায়।
১৫৪.প্রদীপের আলো বাতাসে নিভে যায়, সাহস স্বাভিমানের আলোকে বাতাস স্পর্শও করতে পারে না, সে অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলতে থাকে।
১৫৫. একপ্রকার অপরাধ করা অপরাধীদের মধ্যে সবার অপরাধ এক নয়।কেউ জ্ঞানত করে, কেউ অজ্ঞানত অপরাধ করে,কেউ অপরাধে প্ররোচিত করে, আবার কেউ হয়ত বংশীয় অপরাধী।
১৫৬. সময়ের পথরেখায় জ্ঞান পরিশীলিত হয়, পূর্ণতা পায়। ডাব থেকে ধীরে ধীরে নারিকেল হতে হয়, কিন্তু হঠাৎ করে যে ডাব ঝুনা হয় তাকে ডাবঝুনা বলে। একে ডাব হিসেবেও খাওয়া যায় না, ঝুনা নারিকেল হিসেবেও খাওয়া যায় না। ফেলে দিতে হয়।
১৫৭.পদ্মা-মেঘনা নদীতে যখন কোন জাহাজ ঝড়ের কবলে পরে, তখন সে জাহাজকে মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে আরও বেশী ঝড়ের মোকাবেলা করা হয়। সামনাসামনি ঝড়কে ফেস করলে জাহাজের কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বাঁচতে গিয়ে যদি জাহাজকে পারে ভিড়ানো হয় তবে জাহাজটি পারের সাথে বারি খেয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। বিপদ থেকে যখন আমরা পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করি, তখন বিপদ আরও বেশী করে আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।
১৫৮.প্রদীপের টিমটিমে সলতের মত যারা বাঁচতে চায়, ওরা বাঁচতে পারে না; পক্ষান্তরে যারা বাঁচা-মরাকে তোয়াক্কা করেনা, তারাই অমর হয়ে বেঁচে থাকে।
১৫৯. বৃত্তেবদ্ধ জীবন, বৃত্তেবদ্ধ চিন্তা, বৃত্তেবদ্ধ সংস্কার বৃত্তেই আবর্তিত হয়, মুক্তি মেলে না।
১৬০. জগতের ইউনিক ব্যবস্থাপনা হল মানুষকে ব্যবস্থাপনা। লাখ লাখ বই এবং লাখ লাখ তত্ত্ব তৈরি হলেও মানুষকে সম্পূর্ণভাবে ব্যবস্থাপনা অসাধ্য। এটা হল একঝাঁক ব্যাঙকে একটি পালায় মাপার মত।হাজার প্রয়াসেও কাজটি সমাপ্ত হয় না।
১৬১. রাত যত গভীর হয়, প্রভাত ততই কাছে আসে। শুধুমাত্র নিরবচ্ছিন্ন ইচ্ছা, একাগ্রতা এবং ধৈর্য থাকলেই হয়।
১৬২. একটি বিড়ালকে যখন মারা হয় তখন অন্ততপক্ষে একটি জানালা খুলে মারা হয়, যাতে বিড়ালটি মার খেয়ে জানালা দিয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু যখন সকল দরজা জানালা বন্ধ করে মারা হয় তখন বিড়ালটি মার খেতে-খেতে জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে যায়। সে সময়ে সামনে যাকে পায় তাকেই আক্রমণ করে বাঁচার চেষ্টা করে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যে সকল দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা এ মার খাওয়া বিড়ালের মত হয়েছে, তারাই ভয়ংকরভাবে ঘুরে দাড়িয়ে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে।
১৬৩.যে পাখিটা সুন্দর কথা বলে, সমাজ তাকেই খাঁচায় পুরে দেয়।দাঁড়কাক সারাদিন কা কা করেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। তাকে কেউ সোনার খাঁচায় পুষতে চায় না। ডাস্টবিনের ময়লা খেয়েই তাকে জীবন ধারণ করতে হয়।
১৬৪.জীবনে কাঁদানো এবং কাঁদা একই মুদ্রার এপিট আর অপিট। মানুষ শুধু সময়ের ব্যবধানে নিজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলাফল ভোগ করে চলে; এর কিছু থাকে দৃশ্যমান, অধিকাংশই হয় অগোচরে।
১৬৫. হিন্দুদের মধ্যে অনেকে প্রতিমা পূজার বিরোধিতা করে। তারা বলে, আমরা প্রতিমা পূজা করিনা এবং বিশ্বাসও করি না। কথাগুলো শুনতে ভাল, সেই তাদেরই আবার দেখা যায়, অচিন্ত্য পরমেশ্বরের প্রতীক 'ওঁ' এর প্রতিমা বানিয়ে ; সেই 'ওঁ' এর চরণে অঞ্জলি দেয়। ওঙ্কার প্রতীককে তারা মূর্তি বানিয়ে ফেলছে। বিষয়টি মজার।'ওঁ' হল নিরাকার ব্রহ্মের প্রতীক। যদি নিরাকার পরমব্রহ্মের প্রতীক ওঙ্কারকে মূর্তি বানিয়ে তার পায়ে ফুল-বেল পাতা দিয়ে অঞ্জলিই দিতে পারি, তবে প্রতিমার পায়ে দিতে সমস্যা কি? সাধকের হিতার্থে অচিন্ত্য ব্রহ্মের দৃষ্টিগ্রাহ্য সাকার রূপই হল প্রতিমা।
১৬৬. নিশ্চিত আর অনিশ্চিত বৃত্তাকারে আমাদের চারপাশে ঘোরে, যে নিশ্চিত রেখে অনিশ্চিতের পেছনে ধায়, তার নিশ্চিতও অনিশ্চিত হয়ে যায়।
১৬৭. বাড়ির আশেপাশের ছোট গাছ থাকলে, আমরা চলার সময়ে অবচেতনভাবে অনেক সময় ভাঙতে ভাঙতে যাই। কিন্তু শাল-সেগুন গাছ থাকলে, আমরা তাদের ধারেকাছে গেলেও ডাল ভাঙার চিন্তা মাথাতেও আসে না। তেমনিভাবে নরম মাটি দেখলে, আমাদের ইচ্ছে করে একটু আল্পনা আঁকি, আঁকিবুঁকি করি। বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা সেই ছোট গাছ আর নরম মাটির মতই অনেকটা। প্রতিবাদ প্রতিরোধ না থাকায়, যে কেউ এসে নরম ডাল ভেঙে চলে যায় অথবা ইচ্ছামত আঁকিবুঁকি আঁকে।
১৬৮. নামযজ্ঞ ও কীর্তনের অনুষ্ঠানে কয়জন মানুষ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছে, আমি ঠিক জানি না। তবে হ্যাঁ, এ অনুষ্ঠানগুলি আয়োজন করে লাভের মধ্যে লাভ হচ্ছে আমাদের মা-দিদিদের, তাদের দুইএক বেলা রান্না করতে হচ্ছে না। আর লাভ হচ্ছে আমাদের অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের, কোন কোন বাড়িতে কারা কারা আছে এটা জানতে পারছে।আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই অনুষ্ঠানগুলি থেকে বৈদিক ধর্মসভা বা গীতা-ভাগবত -রামায়ণ-মহাভারতের যৌক্তিক আলোচনা অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়।
১৬৯.আপনি আপনার ড্রয়িং রুমে কি রাখেন? আপনি মানুষকে ঘরে ঢুকে প্রথমেই যা দেখাতে চান। কিন্তু যা প্রকাশ্যে দেখাতে চাননা, সোনার গহনা এবং ঘরের মূল্যবান বিভিন্ন গোপনীয় বিষয়; তা কিন্তু আপনি রাখেন ঘরের ভেতরের রুমে। ঠিক একইভাবে শ্রীমদ্ভাগবতের শুরুতে প্রথমস্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়েই ভগবানের অবতারের তালিকা দিয়ে আঠারো হাজার শ্লোকের বৃহৎ গ্রন্থটি শুরু হয়েছে। যাতে আপনি প্রথমেই জানতে পারেন যে, ভগবানের অবতার কারা। আপনি যেন রাস্তা থেকে যদু,মদু, কদু কাউকে ধরে এনে অবতার বানিয়ে পূজা না করেন।
১৭০. এ জগত থেকে চলে যাওয়ার যদি পাঁচটি কারণ থাকে, তবে এ জগতে বেঁচে থাকার পাঁচকোটি কারণ আছে। এ কারণেই উপনিষদে বলা আছে, "হে মানব জীবনকে জয় করে শতবছর বাঁচ।"
১৭১. কাম থেকে যারা দূরে থাকতে চায়, তারাই কামের ফাঁদে পরে। কামেই আসক্তি, কামেই বন্ধন এবং কামেই মুক্তি। তন্ত্রশাস্ত্র বলে, কামই পরিশেষে কামাসক্তির পথে নিয়ে মুক্তি ঘটায়।
১৭২. যত বেশী নগরায়ণ, যত বেশী নাগরিক জীবন, যত বেশী সাজুগুজু ভদ্রলোক ; তত বেশী মুখোশ, ততই ছদ্মবেশ। গ্রামীণ জীবনে হিংসা কলহ প্রতিদিন, কিন্তু সকলই সাময়িক। শত্রুতা যতই থাক প্রতিবেশীর মৃত্যুতে বিয়েতে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সবাই ঝাপিয়ে পরে।
১৭৩. "আম গাছের নিচে বিয়াইলো গাই,
সেই রিস্তায় দুলাভাই' ; এ লোকবাক্যটি একটি চরম সত্য।মানুষ সর্বদা ক্ষমতাবানদের সাথে সম্পর্ক থাক বা না থাক সম্পর্কের সূত্র খোঁজে। বিষয়টি হাস্যকর।
১৭৪. ক্ষমতা একটা হট সিট। তাই কেউ বেশীক্ষণ বসে থাকতে পারেনা। উষ্ণতা চলে গেলে পোকামাকড় আরশোলা সিটটিতে বাসা বাঁধে।
১৭৫. একটা তীরকে ছুড়তে হলে হাতকে একটু পিছনে নিতে হয়, তখন তীরটি গতি পায়। ঠিক একইভাবে প্রত্যেকটি জাতির পেছনের ইতিহাসের ভুল ত্রুটি থেকে যত বেশী শিক্ষা নিয়েছে, সে জাতি তত বেশী গতি পেয়েছে, এগিয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক জাতির অন্ততপক্ষে দুইহাজার বছরের পূর্ণ ইতিহাস জানাটা জাতীয়তাবাদ বিকাশে অত্যাবশ্যক।
১৭৬. সাধন জগতে অমাবস্যায় পুর্ণিমা তখনই হয়, যখন সাধকের অন্ধকার অন্তঃকরণে আত্মসাক্ষাৎকারের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়।
১৭৭. আমাদের আশেপাশের যত জড়, অচেতন পদার্থ দেখছি তারা সকলই অচৈতন্য নয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, চাইলে এদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।
১৭৮. জীবনে সম্পর্কগুলি বাইনারি নাম্বারের মত ০১,০১ করে এগিয়ে চলে। তাই আশাহত বা আশাবাদী কোনটিই চিরস্থায়ী নয়।
১৭৯. তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত ছেলেরা প্রচণ্ড পরিনামদর্শী হয়; তারা শতভাগ নিরাপত্তা নিয়েই তবে কোন কাজ করতে চায়। অবশ্য ব্যতিক্রম দুইএকজন আছে, যারা দৃষ্টান্ত হয়। যে যত কথিত বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, সে তত বেশী আত্মসচেতনতার নামে আত্মকেন্দ্রিক। গায়ে লাগানো কাজে এদের পাওয়া যায় না। এরাই ফেসবুকে ঝড় তুলে ফেলে, কিন্তু এদের কাছে সেই ঝড়তোলা কাজটিই যদি করতে দেয়া হয়; তবে বাটিচালান দিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
১৮০. মানুষ হল কাদার মত, এই কাদা দিয়ে চাইলে ভুতপ্রেত বানানো যায়, আবার দেবতাও বানানো যায়। শুধু ইচ্ছা, একাগ্রতা এবং পরিচর্যার প্রয়োজন।
১৮১. পরিবারের কিছু সদস্যদের আচরণ থাকে লতার মত, লতা যে গাছ দেখে সেই গাছকেই আঁকড়ে ধরে, জড়িয়ে ধরে। তা সে রসাল আমগাছ হলেও জড়িয়ে ধরবে, আবার কাঁটাগাছ হলেও জড়িয়ে ধরবে। তাই পরিবারের কর্তার উচিৎ, যাতে সন্তান বিষাক্ত কাঁটাগাছকে আকড়ে ধরতে না পারে তাই কাঁটার ঝোপঝাড় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা।
১৮২. অজ্ঞাত কুলশীল কাউকেই হঠাৎ বিশ্বাস করা উচিৎ না, ব্যক্তির ভৌগোলিক পরিচয় না জেনে কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া, গৃহে আশ্রয় দেয়া বোকামি।
১৮৩.মূর্খের সাথে যখন আমরা চলি, মূর্খ সর্বপ্রথম তার আশেপাশের সবাইকে তার নিজের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। তাই মূর্খ থেকে সাবধান থাকতে হবে, যথাসম্ভব দূরত্বে থাকতে হবে। মূর্খ অনেকটা আপেক্ষিক হয়, বিভিন্ন ব্যক্তি এবং ঘটনার সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে তাদের স্বরূপ প্রকাশিত হয়।মূর্খ বিভিন্ন প্রকারের হয়, স্বল্পজ্ঞানী, পণ্ডিতম্মন্য, অজ্ঞানী,মূঢ়জন, অপরিনামদর্শী ইত্যাদি।
১৮৪.মূর্খজনকে আগে আপ্রাণ সংশোধনের প্রচেষ্টা করবেন; যদি সে সঠিক পথে চলতে না চায় তবে সেই অজ্ঞ-মূর্খ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলাই শ্রেয়। কারণ মানুষ সবাই যে সকল কথা বুঝতে পারবে এমন নয়; এরজন্যে প্রারব্ধ কর্ম এবং পূর্বজন্মের সুকৃতিরও প্রয়োজন আছে। এ কারণেই আমরা সমাজ সংসারে দেখি কেউ দুধ বিক্রি করে, মদ কিনে খায়; আবার কেউ মদ বিক্রি করে দুধ কিনে খায়। কোন সাধুসজ্জনের ঘরে, দুর্জন রাবনের জন্ম হয়, আবার দুর্জনের ঘরে ভক্ত প্রহ্লাদের জন্ম হয়।
১৮৫. কোন বিল্পবে বা মুক্তির আন্দোলনে প্রতিবিপ্লবীর স্থান নেই। প্রতিবিপ্লবীরা বিভিন্ন আপাত মনোহর কথা বলে গোষ্ঠীকোন্দল তৈরি করে, বিপ্লবকে লক্ষ্যচ্যুত করতে সাহায্য করে।
১৮৬. একটি বটগাছে ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, ছোট- বড়, মিষ্টি সুরে গান করা, কর্কশ কণ্ঠে ঝগড়া করা সকল পাখিই বসবে। বটগাছের কাজ না দোষগুণ বিচার করে মন্দ পাখিদের তাড়িয়ে দেয়া। পরিবেশটি বিশুদ্ধ তৈরি করা হলে, ডাস্টবিনের খাবার খাওয়া পাখীগুলো অস্বস্তিতে এমনিতেই চলে যাবে।
১৮৭. সনাতন ধর্ম একটি সুসংবদ্ধ ধর্ম। আপাতদৃষ্টিতে মত-পথের বিভিন্ন অলিগলি দেখে, হঠাৎ বিশৃঙ্খল মনে হয়। অনেকেই না বুঝে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে একটু চিন্তার অলিগলি পারি দিলেই পাওয়া যায় হিরন্ময় বৈদিক রাজপ্রাসাদ। নাটক-যাত্রাপালার কৃত্রিম রাজপ্রাসাদ দেখে মানুষ সাময়িক মুগ্ধ হলেও, তা ক্ষণস্থায়ী। এতে বসবাস করা যায় না।
১৮৮.একই সত্ত্বার শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন হওয়ার কারণে এ দৃশ্যমান বিভিন্ন স্বরূপ দেখে মায়ার প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাই আমরা প্রতিনিয়ত। উপাস্য রুচির বৈচিত্রের জন্যে একই ব্রহ্মের আলাদা আলাদা রূপের প্রকাশ। আমরা এক পরমেশ্বর ছাড়া দ্বিতীয় কারো উপাসনা করি না। বেদে বিভিন্ন মন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর এবং স্পষ্ট করে বিষয়টা বলা আছে-"সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।" (ঋগ্বেদ: ১.১৬৪.৪৬)
১৮৯.আপনি যখন বাস্তবতার মধ্যে না ঢুকবেন,আপনি অনেক কথা বলতে পারবেন। বাস্তবতা এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। বাস্তবতা আপনাকে রাত্রে ঘুমাতে দিবে না। আপনি যখন ফুল দিয়ে পুষ্পশয্যা করবেন, কবিতা লিখবেন,পদ্য লিখবেন,তেলবাজি করবেন এবং আপনি দেখবেন আপনি আপাত ভাল থাকতে পারবেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈল নামক একটা প্রবন্ধে আছে। সেখানে তিনি তৈলপ্রিয়তা তৈলমর্দনকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে বলেছেন, "মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মন ফেরে।"
১৯০. বামহাত ডানহাতের সাথে আমাদের আরও একটি হাত আছে, তা হল অজুহাত। কিন্তু, এরপর, তারপর, বিষয়টি এমন না, আপনাকে বুঝতে হবে,আপনাকে বোঝাতে পারছি না - এ জাতীয় শব্দ এবং বাক্যের সফল ব্যবহার করে আমরা বিভিন্ন অজুহাতকে জাস্টিফাই করি।
১৯১. কোন বিপদ বা মহামারী প্রসঙ্গে যখন আমরা কথা বলি, তখন বুঝে হোক বা না বুঝে হোক অবলীলায় লাখ লাখ মৃত্যুর কথা আমরা মুখে বলে ফেলি। কল্পনায় থাকে, নিজের পরিবার বাদে অন্যদের বিপদগ্রস্ত চিত্র। কিন্তু কল্পনায় যদি নিজের পরিবার পরিজন থাকত, তবে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য না দিয়ে ভয়ে আৎকে উঠত।
১৯২. ব্যাঙের যেমন সারাদিন জলে থেকেও সর্দি-জ্বর হয় না, তেমনি উকিল, পুলিশ, বিচারকের কাছে চোর-ডাকাত সহ বিভিন্ন অপরাধীদের সংগঠিত ঘটনাগুলো শুধু একটি নাম্বারযুক্ত কেস মাত্র; যা তাদের যাপিত জীবনকে খুব একটা স্পর্শ করে না। কিন্তু যদি ঘটনাগুলো তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে স্পর্শ করে, তবে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।
১৯৩. জ্ঞানের জগতে প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্রতা আছে। সে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত জ্ঞান হোক আর বিশুদ্ধ বিজ্ঞান হোক কোন জ্ঞানই ফেলনা নয়। একজন কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে, বৃষ্টি কেমন হবে, ফসল কেমন হবে। এটা তার পুর্বপুরুষের পরম্পরাগত জ্ঞান এবং নিজের পর্যবেক্ষণ। আমরা বোকার মত তাদের বলে ফেলি, অশিক্ষিত কৃষক। কিন্তু আমরা হয়ত অনেকেই জানি না, তাদের জ্ঞানের কাছে আমাদের তথাকথিত সার্টিফিকেটের শিক্ষা নস্যি।
১৯৪. বিয়ে করার আগে হবু বরের সাথে রৌদ্রের মধ্যে রাস্তায় দুইঘন্টা জ্যামে বসে থাকবেন। আগামীতে তার ধৈর্য এবং মানসিকতা এমনিতেই টের পেয়ে যাবেন, কাউকে কিছু বলতে হবে না।বিপরীতে হবু কনেকে দামী শপিংমলে নিয়ে যাবেন বা দুইঘন্টা কোন রান্নাঘরে বসে গল্প করার চেষ্টা করবেন। দুজন দুজনের প্রকৃতি এমনিতেই বুঝে যাবেন, আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
১৯৫. যাকে সবাই ভালবাসে, তার ব্যক্তিগত জীবন থাকে না। সবার প্রিয় হওয়া একটা নেশার মত, এ নেশাতে জীবনে কোন একজনের প্রিয় হওয়া কষ্টকর হয়ে যায়।
১৯৬. জগতে মাঝেমধ্যে দৃঢ়হৃদয়ে 'না' বলাটা জানতে হয়, আর তা না হলে এই অতি প্রয়োজনীয় একটি 'না' শব্দ সারাজীবন চোখের জলের কারণ হয়।
১৯৭. তুষের আগুনের মত টিপটিপ করে না জ্বলে আম কাঠের মত দাউদাউ করে জ্বলতে হয়। আমাদের কে, কি, কখন, কোথায়, কিভাবে - এ জাতীয় পরিনামদর্শী আগপাছ চিন্তা না করে সাহস নিয়ে গেলে অনেক বিপদ এমনিতেই ভয়ে পালিয়ে যায়। বিপদ দেখে যত বেশী পরিনামদর্শী হয়ে ঘরে বসে থাকব, বিপদ ততই আমাদের ঘর পর্যন্ত চলে আসবে।
১৯৮. আগপাছ চিন্তা না করে আগে পথে নামতে হয়, পথই পথিককে পথ দেখিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। পথের বিপদসংকুলতা নিয়ে গবেষণা করে বড় বড় গদ্য লেখা যায়, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না।
১৯৯. নিজের সমস্যার সমাধান নিজেকেই করতে হয়, কেউ এসে করে দিবে, এইমনে বসে থাকাটা চরম বোকামি। কেউ যদি আপনার জন্যে হাটু পর্যন্ত জলে নামে, তাহলে আপনাকে গলা পর্যন্ত জলে নামতে হবে। জগতে, 'ধরি মাছ না ছুই পানি' তত্ত্বে কোন সমস্যার সমাধান কোনদিন হয়নি ; আর হবেও না।
২০০. কেউ রেইনট্রি গাছে ঢিল মারে না, কারণ এর সুস্বাদু ফল নেই। ঢিল মারে আমগাছে, লিচুগাছে, যাদের রসাল সুস্বাদু ফল আছে। মানুষ নিন্দা করলেই বুঝতে হবে সমাজে আপনার একটা প্রভাব তৈরি হচ্ছে। আপনার ভাব কিছুটা হলেও প্রচার পাচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে নিন্দা বা গঠনমূলক সমালোচনা মানুষের চিন্তাধারাকে রিভিউ করতে সাহায্য করে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................