আচার্যদের নিয়ে দয়ানন্দের কটুক্তি

আচার্যদের নিয়ে দয়ানন্দের কটুক্তি 

আজ কয়েকদিন থেকেই আমাকে অনেকেই বলছে যে, স্যার আপনিসহ বাংলাদেশের আরও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গের নামে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে। তাদের জিজ্ঞাসা থেকেই জানতে পারলাম যে, তারা প্রতিমাপূজা বিরোধী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারী। তাদের আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কি দয়ানন্দ সরস্বতীর 'সত্যার্থ প্রকাশ' গ্রন্থটি পড়েছেন? উত্তরে তারা বললেন, না স্যার পড়িনি; কিন্তু নাম শুনেছি। তাদের বললাম আগে তার সত্যার্থ প্রকাশ' গ্রন্থটি পড়ুন বা সম্পূর্ণ পড়তে না পারলে অন্ততপক্ষে একাদশ সমুল্লাসটি পড়ুন। তবে নিজেই সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন যে,  দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারীদের মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রমণে অত্যধিক প্রবণতা কেন।তাদের যুক্তি এবং যুক্তি খণ্ডনের থেকে, যুক্তির বাইরে ব্যক্তিগত আক্রমণ অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়। এ বিষয়টি তারা দয়ানন্দ সরস্বতীর সত্যার্থ প্রকাশ' গ্রন্থটি থেকে শিখেছে। দয়ানন্দ সরস্বতী তার পূর্ববর্তী সনাতন ধর্মীয় মহাপুরুষ বিশেষ করে শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীরামানুজাচার্য, সন্ত শ্রীকবির, শ্রীবল্লভাচার্য, শ্রীমধ্বাচার্য, স্বামী নারায়ণ সম্পর্কে যে সকল মন্তব্য করেছেন, তা একজন সন্ন্যাসীর মুখে শোভা পায় না। অন্ততপক্ষে সন্ন্যাসীর গৈরিক পোশাকধারী ব্যক্তির মুখে শোভা পায় না।  দয়ানন্দ সরস্বতীর নামের সাথে সরস্বতী এ সন্ন্যাসীর উপাধিটি শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উপাধি। এ সরস্বতী উপাধি সম্পর্কে শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর শৃঙ্গেরীমঠান্নায়তে বলেছেন:

সরস্বতী:
স্বরজ্ঞানরতো নিত্যং স্বরবাদী কবীশ্বরঃ।
সংসারসাগরাসারহন্তাসৌ হি সরস্বতী॥
(শৃঙ্গেরীমঠান্নায়:৬)

"যিনি সর্বদা বেদের স্বরজ্ঞানে রত, স্বরোচ্চারণে দক্ষ ও কবিশ্রেষ্ঠ এবং অসার সংসার সাগরের হন্তা; তাঁকেই 'সরস্বতী' বলে।"

শৃঙ্গেরীমঠান্নায়ের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে,
বেদের স্বরজ্ঞানে রত, স্বরোচ্চারণে দক্ষ ও কবিশ্রেষ্ঠ এবং অসার সংসার সাগরের বিনাশ করে যিনি মুক্তির পথে অগ্রসর হন, তাঁকেই 'সরস্বতী' বলে। দয়ানন্দ সরস্বতীর নামের সাথে সন্ন্যাসীর সরস্বতী উপাধিতে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে তিনি শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শ্রীশঙ্করাচার্যের অনুগামী সন্ন্যাসী হয়েও দয়ানন্দ সরস্বতী শ্রীশঙ্করাচার্যের জীবন এবং তিরোধান নিয়ে তার সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে অত্যন্ত কদর্যতা করেছেন। 'জৈনমতবাদীরা শঙ্করাচার্যকে বিষ খাওয়ালেন' এ শিরোনামে সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে বলেন:

"বেদ-মত পুনঃ প্রবর্তনের পর তাঁহারা বেদ বিদ্যা প্রচার সম্বন্ধে চিন্তা করতেছিলেন, এমন সময় দুইজন জৈন যাঁহারা উপরে উপরে নামমাত্র বেদ মতাবলম্বী এবং অন্তরে অন্তরে গোঁড়া জৈন অর্থাৎ কপটমুনিঃ -শঙ্করাচার্য্য তাহাদের প্রতি অতিশয় প্রসন্ন ছিলেন। ইহারা সুযোগ পাইয়া শঙ্করাচার্য্যকে এমন বিষমিশ্রিত বস্তু ভোজন করাইল যে, তাঁহার অগ্নিমান্দ্য হইল। পরে শরীরে স্ফোটকাদি হইয়া ছয় মাসের মধ্যে তাঁহার দেহান্ত ঘটিল।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৩১৪-৩১৫)

শ্রীশঙ্করাচার্যকে বিষমিশ্রিত বস্তু ভোজন করানোর ফলে তাঁর অগ্নিমান্দ্য রোগ হয় এবং সেই রোগের ধারাবাহিকতায় শরীরে স্ফোটকাদি হয়। এভাবে ছয় মাস রোগভোগ করে পরবর্তীতে তাঁর দেহান্ত হয়। দয়ানন্দ সরস্বতী কোন উৎস উল্লেখ করেননি যে তিনি কোথা থেকে এই উদ্ভট তথ্যটি পেলেন? অথচ আমরা শ্রীশঙ্করাচার্যের জীবনে তাঁর তিরোধান সম্পর্কে পাই যে, তিনি যোগ অবলম্বন করে দেহত্যাগ করেছেন।

আচার্যের বত্রিশ বছরের স্বল্পায়ু যখন শেষ হয়ে আসলো, তখন তাঁর মধ্যে এক মহাভাবান্তর উপস্থিত হল। তাঁর মধ্যে দেহত্যাগের প্রবৃত্তি দেখা দিল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, বেদবিরোধী বা বেদের বিকৃতার্থাবলম্বী সকলেই তো অদ্বৈতমতের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার বা শরণ গ্রহণ করেছে। শিষ্যগণও উপযুক্ত হয়েছে। তাঁদের আর আকাঙ্ক্ষিতব্য বিষয়ও কিছু নাই। তখন তিনি একদিন শিষ্যগণকে উপদেশদান শেষ করে বললেন— হে আমার শিষ্যগণ! আমার এ দেহের প্রারব্ধ শেষ হয়েছে, এখন তোমরা তোমাদের কর্তব্য নির্ণয় করে নাও। তোমাদের যদি জ্ঞাতব্য কিছু থাকে তো জিজ্ঞাসা কর।এর পরবর্তীতে শ্রীশঙ্করাচার্য এক অত্যন্ত পবিত্র ক্ষণে যোগ অবলম্বন করে দেহত্যাগ করলেন।সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই পঞ্চভৌতিক দেহও অদৃশ্য হয়ে যায়। সে সময়ে উপস্থিত শিষ্যগণ ওঙ্কারধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত করে তুললেন। আচার্য ব্রহ্মস্বরূপে বিলীন হয়ে গেলেন।শ্রীশঙ্করাচার্যের তিরোধানে শিষ্যগণের হৃদয়ে মহা বৈরাগ্যের উদয় হল।তখন রাজা সুধন্বা ভাবলেন—শিষ্যগণ যদি এমন অন্তর্মুখী হয়ে যায়, তবে আচার্য প্রচারিত ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার রুদ্ধ হয়ে যাবে। এ ভেবে সুধন্বারাজ আচার্যের শিষ্যবর্গকে ধর্মসংরক্ষণের জন্য আচার্যের মঠাম্নায়ের কথা বারংবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। এরপরে সুধন্বারাজের অনুরোধে তাঁরা নিজ নিজ নির্দিষ্ট দেশাভিমুখে যাত্রা করলেন। আচার্যের দিগ্বিজয়বাহিনী নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাগমন করল। শঙ্করের কার্য এবার শঙ্করসেবকগণ গ্রহণ করলেন। এক শ্রীশঙ্করাচার্য বহু শঙ্করে পরিণত হলেন।

শ্রীশঙ্করাচার্য যোগবলে স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেছেন, এ বিষয়টি সর্বজনবিদিত। কিন্তু পক্ষান্তরে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে ১৮৮৩ খ্রিস্টব্দে যোধপুরের মহারাজের বাঈজী নন্নীজান দয়ানন্দ সরস্বতীকে দুধের সাথে কাঁচের গুড়া যুক্ত বিষ মিশিয়ে পাচককে দিয়ে খাইয়ে দেয়। সেই দুধের সাথে কাঁচের গুড়া যুক্ত বিষ খেয়ে দয়ানন্দ সরস্বতীর পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়। তার সারা শরীরে বিষ ফুটে উঠতে থাকে। বিষের প্রভাবে তার শরীরে বিভিন্ন স্ফোটক দেখা দেয় এবং অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে পরবর্তীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, দয়ানন্দ সরস্বতী শ্রীশঙ্করাচার্যের নামে বিষ প্রয়োগে ফলে শরীরে স্ফোটক হয়ে মৃত্যুবরণ করার তথ্যটি দিয়েছেন; সেই বিষয়টি শ্রীশঙ্করাচার্যের জীবনে না ঘটলেও তার জীবনে ঘটেছে, ইতিহাস যার নির্মম সাক্ষী। 

'রামানুজ মতের আলোচনা' এ শিরোনামে তিনি লেখেন, কণ্ঠি, তিলক, মালা এবং মূর্ত্তিপূজা প্রভৃতি বৈষ্ণব আচরণকারী শ্রীরামানুজাচার্যের মত মহান বৈষ্ণবাচার্যের মতকে 'পাষণ্ড' বলে নিন্দা করেছে। শ্রীরামানুজাচার্য শ্রীসম্প্রদায়ের প্রবর্তক। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলাঙ্গানা প্রদেশে অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বীই 'শ্রী' সম্প্রদায়ের অনুসারী। শ্রীরামানুজাচার্যের মত প্রসঙ্গে দয়ানন্দ সরস্বতী বলেন:

"এস্থলে বিচাৰ্য্য এই যে, শঙ্করাচার্য্যের ন্যায় ব্রহ্মাতিরিক্ত জীব এবং কারণবস্তু স্বীকার না করা যুক্তিসঙ্গত নহে। আর রামানুজের এই অংশে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ অর্থাৎ জীব এবং মায়া সহিত পরমেশ্বর এক, এইরূপ তিনকে মানা সর্বথা ব্যর্থ। কণ্ঠি, তিলক, মালা এবং মূর্ত্তিপূজা প্রভৃতি পাষণ্ড মত প্রচলন করা প্রভৃতি ও অসঙ্গত কথা চক্রাঙ্কিতদের মধ্যে আছে। চক্রাঙ্কিত মত যেরূপ বেদবিরুদ্ধ, শঙ্করাচার্য্যের মত সেরূপ নহে।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৩৩৭)

সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় অধিকাংশ আলোচনা জুড়ে থাকে শ্রীশঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ এবং শ্রীরামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। তাদের দুইজনের পাণ্ডিত্য অগ্নির মত দৃশ্যমান। অথচ শ্রীরামানুজাচার্যের সংস্কৃত অধ্যয়ন সম্পর্কে দয়ানন্দ সরস্বতীর উক্তি অত্যন্ত তাচ্ছিল্যপূর্ণ। তিনি বলেন:

"রামানুজও কিঞ্চিৎ সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়া সংস্কৃতে শ্লোকবদ্ধ গ্রন্থ শারীরিক সূত্র ও শঙ্করাচার্য্যকৃত শারীরিক সূত্রের টীকার বিরুদ্ধে উপনিষদের টীকা রচনা করেন।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৩৩৭)

সন্ত কবির ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সাধকদের মধ্যে অন্যতম। সমগ্র ভারতজুড়ে 'কবিরপন্থী' নামে সন্ত কবিরের অসংখ্য অনুসারী রয়েছে।দয়ানন্দ সরস্বতী 'কবীর সাহেবের জন্ম ও তাহার সিদ্ধান্ত' শিরোনামে তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করেন। শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত সন্ত কবিরের মানবতাবাদী দর্শন এবং তাঁর দোঁহা পৃথিবী বিখ্যাত। সন্ত কবিরের লিখিত  দোঁহার বিশাল একটি অংশ শিখদের ধর্মগ্রন্থ 'গুরুগ্রন্থসাহেব' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই জগদ্বিখ্যাত মানবতাবাদী দর্শনের দোঁহাবলীকে দয়ানন্দ সরস্বতী ‘অগড়ং বগড়ং’ নামে আখ্যায়িত করেন। একথা সর্বজনীন বিদিত সন্ত কবির তথাকথিত শূদ্র বা অন্ত্যজ শ্রেণীর মাঝে তাঁর সুমহান বৈষম্যহীন ভাবদর্শনের প্রচার করেন। আজও তাঁর অনুসারীদের প্রায় সকলেই পিছিয়ে পড়া শূদ্র সম্প্রদায়ের। নিজের পাণ্ডিত্যের অহংকারে গর্বিত হয়ে দয়ানন্দ সরস্বতী সন্ত কবির সম্পর্কে বলেন যে, তিনি তাঁতি প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর লোকদের মাঝে তম্বুরা নিয়ে ভজন গেয়ে প্রচার করতেন। অর্থাৎ সন্ত কবিরের প্রচার এবং তার অনুসারীগণ যে সমাজের তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর ছিলেন না, এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি নির্দেশ করেন। 

"এ বিষয়ে নিম্ন-বর্ণিত যাহা শুনা যায়, তাহা সত্য হইতে পারে। কাশীতে এক তাঁতি বাস করিত। তাহার সন্তানাদি ছিল না। একদিন অল্প রাত্রি থাকিতে সে এক গলিপথ দিয়া যাইতে ছিল। এমন সময় সে দেখিতে পাইল পথিপার্শ্বে একটি ঝুড়ীতে ফুলের মধ্যে সদ্যোজাত একটি শিশু রহিয়াছে। সে শিশুটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার স্ত্রীকে দিল। তাহার স্ত্রী শিশুটিকে পালন করিতে লাগিল। শিশুটি যখন বড় হইল তখন সে তাঁতির কাজ আরম্ভ করিল। (একদিন) সে সংস্কৃত অধ্যয়ন করিবার জন্য কোন পণ্ডিতের নিকট যায়। পণ্ডিত তাহাকে অপমান করিয়া বলিল—‘আমরা তাঁতিকে পড়াই না।’ এইভাবে সে আরও কয়েকজন পণ্ডিতের নিকটে উপস্থিত হয়। কিন্তু কেহই তাহাকে পড়াইল না।

তখন সে ‘অগড়ং বগড়ং’ ভাষায় কিছু কিছু রচনা করিয়া তাঁতি প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর লোকদিগকে বুঝাইতে লাগিল। সে তম্বুরা লইয়া গান করিত, ভজন রচনা করিত। বিশেষ করিয়া, সে পণ্ডিত, শাস্ত্র এবং বেদের নিন্দা করিত। কয়েক জন মূর্খ তাহার জালে আবদ্ধ হইয়া পড়ে। তাহার মৃত্যুর পর লোকে তাহাকে সিদ্ধপুরুষ বানাইয়া ফেলিল। সে জীবদ্দশায় যাহা যাহা রচনা করিয়াছিল তাহার শিষ্যগণ ঐ সকল পাঠ করিত।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৪০৪)

একই প্রকারের মন্তব্য তিনি গুরু নানকের সম্পর্কে করেছেন। তিনি গুরু নানকের অনুসারীদের অশিক্ষিত লোক বলে অবিহিত করেছেন। 

"নানক দেবের জীবদ্দশায় তাঁহার শিষ্যও সংখ্যায় অধিক হয় নাই। কেননা, অশিক্ষিত লোকদের রীতি এই যে, তাহারা ব্যক্তি বিশেষকে মৃত্যুর পর সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া প্রচার করে এবং পরে তাহার অনেক মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়া তাহাকে ঈশ্বরের তুল্য স্বীকার করে।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৪০৬)

শ্রীবল্লভাচার্য (১৪৭৯-১৫৩১) যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসক ছিলেন। তাঁর তত্ত্বের নাম ছিল 'শুদ্ধ অদ্বৈত'। বৃন্দাবনের ব্রজমণ্ডলে বৈষ্ণব মতের ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। সেই পরম মহাজন শ্রীবল্লভাচার্য সম্পর্কে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছেন। সাথে তাঁর জন্মদাতা পিতাকেও ছাড় দেন নি। এমন একজন মহান আচার্যের পিতা লক্ষ্মণভট্ট সম্পর্কে দয়ানন্দ সরস্বতী বলেছেন:

"যাহার পিতা যে সব লীলা খেলা খেলিয়াছিল, পুত্রই বা সেরূপ করিবে না কেন? সে পূর্বে যে বিষ্ণুস্বামীর মন্দিরে চেলা হইয়াছিল স্ত্রীকে লইয়া সে সেই স্থানে চলিয়া গেল; কিন্তু তাহারা বিবাহিত বলিয়া সেখান হইতেও বিতাড়িত হইল।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৪১৩)

দয়ানন্দ সরস্বতী শ্রীকৃষ্ণের উপাসক পরম ভক্ত শ্রীবল্লভাচার্যের বিরুদ্ধে ছল চাতুরীর অভিযোগ করেন। সাথে তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ বৃন্দাবন বা ব্রজমণ্ডলকে 'অবিদ্যার গৃহস্বরূপ' বলে আখ্যায়িত করেন। অথচ যুগযুগান্তর থেকে মুনিঋষিগণ ব্রজমণ্ডলে বসবাস করেন মুক্তির জন্য।

"পরে সে অবিদ্যার গৃহস্বরূপ ব্রজদেশে যাইয়া স্বীয় নানা প্রকার ছল-চাতুরী এবং যুক্তি দ্বারা নিজের প্রপঞ্চ বিস্তার করিতে লাগিল।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ :৪১৩-৪১৪)

গুজরাটের 'স্বামী নারায়ণ' সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী নারায়ণ সম্পর্কে দয়ানন্দ সরস্বতী তার সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ ভাষায় বৃহৎ পরিসরে কটুক্তি করেন। অথচ এই স্বামী নারায়ণ সম্প্রদায় আজ সারা পৃথিবী ব্যাপী সনাতন ধর্মের প্রচার করছে। আরব আমিরাতসহ আরবের বিভিন্ন দেশগুলোতে অত্যন্ত সুদৃশ্য মন্দির করছে। তাদের গুজরাট এবং দিল্লির 'অক্ষরধাম' মন্দির আজ জগদ্বিখ্যাত। মহান আচার্য স্বামী নারায়ণের মতকে তিনি দেবী শীতলার বাহন গাধার সাথে তুলনা করেন। ভাবা যায়! একজন সন্ন্যাসী কতটা অহংকারী এবং দুর্বিনীত হলে তার পূর্ববর্তী একজন মহান আচার্য বা আচার্যের মতাদর্শকে গাধার সাথে তুলনা করতে পারেন! এটা অবশ্য দয়ানন্দ সরস্বতীর পক্ষেই সম্ভব।

"প্রশ্ন—স্বামী নারায়ণের মত কেমন?

উত্তর—“যাদৃশী শীতলাদেবী তাদৃশো বাহনঃ খরঃ”। গোঁসাইদের যেরূপ ধন-হরণ প্রভৃতি বিচিত্র লীলা আছে, স্বামী নারায়ণ মতাবলম্বীদেরও সেইরূপ আছে।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৪২১-৪২২)

"স্বামী নারায়ণ মতালম্বীগণও অপরের ধন হরণ, ছলকপটতাপূর্ণ কর্ম করে এবং না জানি কত শত মূর্খকে মৃত্যুকালে এই বলিয়া বিভ্রান্ত করে, 

...ইহারা নিজেদের ‘সৎসঙ্গী’ এবং অপরাপর মতাবলম্বীদিগকে 'কুসঙ্গী' বলে। নিজেরা ছাড়া অপর কেহ, সে যতই উত্তম, ধার্মিক এবং বিদ্বান্ হউক না কেন, ইহারা কখনও তাহাদের সম্মান ও সেবা করে না। কারণ, ইহারা ভিন্নমতাবলম্বীর সেবা করাকে পাপজনক বলিয়া গণ্য করে। ইহাদের সাধুরা প্রকাশ্যভাবে স্ত্রীলোকের মুখ দর্শন করে না, কিন্তু গোপনে না জানি তাহাদের কত লীলা-খেলা হয় ?"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৪২৬)

দয়ানন্দ সরস্বতী অবতাররূপে দেহধারণকারী ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো বটে; এমন কি ভগবান   নারায়ণ এবং ভগবান শিবকেও ভগবানের বদলে মহান রাজা বানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের শক্তি আদ্যাশক্তি মহামায়ার স্বরূপ লক্ষ্মী,পার্বতী সীতা এবং  রুক্মিণীকেও মহারাণী করে দিয়েছেন তার সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থে। বিষয়টি দয়ানন্দ সরস্বতীর কাছে যৌক্তিক হলেও, বিশ্বব্যাপী শতকোটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসের উপরে আঘাত।

"মূর্ত্তিপূজা দ্বারা শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, নারায়ণ এবং শিব প্রভৃতির বড়ই নিন্দা এবং উপহাস হইয়া থাকে ৷ সকলেই জানে যে, তাঁহারা মহান রাজাধিরাজ ছিলেন এবং তাঁহাদের স্ত্রী সীতা, রুক্মিণী, লক্ষ্মী এবং পার্বতী মহারাণী ছিলেন। কিন্তু পূজারীগণ তাঁহাদের মূর্ত্তিগুলি মন্দিরে স্থাপন করিয়া তাঁহাদের নামে ভিক্ষা চায়।"
(দয়ানন্দ সরস্বতী ১৪০৮ : ৩৯৩)

তথ্য সহায়তা:
১. স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, সত্যার্থ-প্রকাশ, আর্য সমাজ মন্দির, কলকাতা: ১৪০৮ বঙ্গাব্দ 
২.রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ, আচার্য শঙ্কর ও রামানুজ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: চতুর্থ মুদ্রণ, ২০১৪

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted