নজরুল নার্গিস প্রমিলা ও অন্যান্য

নজরুল নার্গিস প্রমিলা ও অন্যান্য
..........................................................
নজরুলের জীবনে প্রধানত দু’জন নারীর কথা জানা গেলেও তার গোপন প্রেমিকাদের কথা খুব বেশি জানা যায় না। নজরুল মূলত প্রেম বিরহের কবি। তাকে বিদ্রোহী কবি বলাটা আসলে তার সমগ্র সাহিত্যকে অগ্রাহ্য ও অবমূল্যায়ণ করা। নজরুল প্রেমে পড়েছেন এবং বিচ্ছেদে কাতর হয়েছেন। কিন্তু তার প্রেমগুলো যেন ফুলে ফুলে মধু খাওয়া মৌমাছির সঙ্গে তুলনীয়। নজরুল প্রথম যে নারীকে ভালোবেসে বিয়ে করেন তার নাম নার্গিস। কুমিল্লায় নার্গিসকে যে রাতে বিয়ে করেন সে রাতেই নজরুল শ্বশুড়বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে চলে আসেন কোন এক অগ্যাত্য কারণে। নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ। এর বছরখানেক পর বন্ধুর বাড়ি কুমিল্লার কান্দিরপাড় বেড়াতে যান নজরুল। নার্গিসদের বাড়ি থেকে এক মিলোমিটারের পথ সেটা। কান্দিরপাড় বেড়াতে এসে নজরুল প্রেমে পড়েন কিশোরী আশালতা দেবী ওরফে দুলির। হিন্দু মুসলমান এই প্রেমের সফল পরিণতি সহজ ছিলো না। মানিকগঞ্জে বাবার বাড়ি থেকে দুলি তার বিধবা মাকে নিয়ে মামার বাড়ি কান্দিরপাড় আশ্রয় নিয়েছিলো সহায়সম্বলহীন অবস্থায়। দুলি ও তার মাকে মামা বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে নজরুলের সঙ্গে কোলকাতায় চলে আসতে হয়। নজরুল দুলির নতুন নাম ‘প্রমিলা’ রাখলেও তার ইসলাম গ্রহণের যে কথা ফেইসবুকে প্রচারিত হয় তার কোন প্রমাণ নেই। বরং দুই ধর্মের এই দম্পত্তিকে কোলকাতায় বাসা ভাড়া কেউ দিতে চাইত না। এই অসম স্বামী-স্ত্রী এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে তাদের সংসার পাতেন। একদিকে নিদারুণ অভাব, সামাজিক সমস্যা ও নজরুলের বেখেয়ালী জীবন। ততদিনে দুলির প্রতি নজরুলের আগ্রহ হারিয়ে গেছে। নজরুল কবি। বিশেষ একটি নারী তাকে চিরজীবন উজ্জ্বেবিত করে যাবে তা তো হয় না। নতুন নতুন নারী তার কবি মানসকে দোলা দিতে থাকে। ঘরের দুল আর কতদিন কবিকে দোলা দিতে পারবে? নজরুল বোহেমিয়ার কবি। ঘোরে স্বপ্নে থাকা কবি। হয়ত কোন বাড়িতে গান করতে গেছেন, সে বাড়ির অন্তঃপুরের কোন নারীকে নিয়ে তাত্ক্ষণিক গান বানিয়ে গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। নিজের বইয়ে আদ্যাক্ষর লিখে নারীদের উত্সর্গ করছেন। কোলকাতার মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে গেছেন, খেলা শেষ করে মাথায় কি চাপল ঢাকায় চলে এলেন ট্রেনে চেপে কাউকে কিছু না বলে। এক মাস দুই মাস নজরুলের আর খবর নেই। এদিকে দুলি আর তার মা প্রায় অনাহারে দিন কাটিয়েছে। সামাজিকভাবে কারোর কাছে সহায়তা পাবার কোন সুযোগ ছিলো না। মাতুল বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেঁদ। এসব থেকেও প্রমিলার কাছে যা নতুন ছিলো তা হচ্ছে অভাব। মামার বাড়িতে সে আশ্রিতা থাকলেও সেখানে খাওয়া পরার কোন সমস্যা ছিলো না। তবু মাটি কামড়ে, নজরুলের পথ চেয়ে, তার খামখেয়ালি চরিত্রকে মেনে নিয়ে প্রমিলা নজরুলের একের পর এক সন্তানের মা হতে লাগলেন। প্রায় সারাজীবন অভাবের সঙ্গে লড়ে যখন নজরুলের গ্রামোফোন কোম্পনিতে চাকরি হলো তখন সচ্ছলতার মুখ দেখতে পান প্রমিলা। নজরুল তখন গাড়িও কিনেছেন। গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, স্বচ্ছলতার মুখ দেখলেও প্রমিলা নজরুলকে পাননি কোনদিনই। তার মুখের বিষাদের ছায়া তার অসুখি দাম্পত্ত জীবনেরই ছায়া যেন। এভাবে যখন দিন ফিরছিলো নজরুলের তখন প্রথম আঘাত আসে সন্তানের মৃত্যু। এই মৃত্যু নজরুলকে তীব্র ব্যথা দিয়েছিলো। তারপরই নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় উন্মাদ দশা। এই অবস্থায় নজরুলকে যেসময় যারা মুসলমানদের কবি, মুসলিম জাগরণের কবি হিসেবেও কোথাও কোথাও দেখতে চান তাদের হাতেও চরম অপদস্ত হন নজরুল। অসুস্থ অবস্থায় পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে অপমাণিত হন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কাছে। বন্ধু জুলফিকারকে চিঠিতে নজরুল লিখেন, নবযুগ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে যে সাত হাজার টাকা দেবার কথা ছিলো হক সাহেব সাত-আট মাস ঘুরিয়ে তাকে ‘কিসের টাকা’ বলে ফিরিয়ে দেন। চিঠিতে কবি আরো লিখেন, ‘৭ মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫/৬ ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে এসেছি। হিন্দু মুসলিম ইকুইটির টাকা কারো বাবার সম্পত্তি নয় …আমার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতি কষ্টে দু একটা কথা বলতে পারি’। 

নজরুলের তখন পথে বসার অবস্থা। তখন কবিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন ‘হিন্দুত্ববাদী মুসলিম বিরোধী হিসেবে’ আখ্যায়িত শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। মধুপুরে তিনি নজরুলকে তার বাড়িটি দিয়ে দেন। কৃতজ্ঞ কবি তখন শ্যামাপ্রসাদকে চিঠি লিখে বলেন, ‘শ্রীচরণেষু, আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন। মধুপুর এসে অনেক ভালো অনুভব করছি। মাথার যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে। জিহ্বার জড়তা সামান্য কমেছে। আপনি এত সত্বর আসার ব্যবস্থা না করলে হয়তো কবি মধুসূদনের মতো হাসপাতালে আমার মৃত্যু হতো।’( নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত নজরুলের পত্রাবলি’র ৭৯ ও ৮০নং পত্র)।

নজরুল এরপর আর সুস্থ হয়নি। পুরোপুরি অসুস্থ কবিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কিছুদিনের অতিথি করে নিয়ে আসার কথা বলে নজরুলকে রেখে দেন। এবং কবির মৃত্যুর পর তার স্বজনদের কোলকাতা থেকে আসার আগেই খুবই দ্রুততার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের সামনে কবর দিয়ে দেয়া হয়। এটা যেন ‘মুসলমানদের কবি’ বানানোর সীল মোহর। সত্যি কথা বলতে গেলে নজরুলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন সম্পর্কই নেই এক শ্বশুড়বাড়ি ছাড়া। নজরুল কোলকাতার মানুষ। সেটাই তার দেশ। নজরুল সুস্থ থাকলে দেশভাগের পরও মনে হয় না বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) আসতেন। তার গোটা জীবন সাহিত্য সবটাই কোলকাতার। নজরুল অসাম্প্রদায়িকতার কবি। একই সঙ্গে স্ববিরোধীতার কবিও। নজরুল চরিত্রে স্ববিরোধীতা জুটে ছিলো। তার কিছু কবিতায় ইসলামের পুনঃজাগরণ, মুসলমানদের হারানো দিন ফিরে পাবার স্বপ্ন, আবার শ্যামা সংগীত রচনা- এগুলো অনেকেই ফরমায়েশি লেখা দাবী করেন, নজরুল নিজে কি আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগতেন? তিনি শেষ জীবনের অসুস্থ হবার আগে তার ঘরে জায়নামাজ ও কালি মূর্তি রেখে ধ্যান করতেন। তরুণ বয়সে তাকে তুরস্কের খিলাফত সমাপ্ত হয়ে সেক্যুলার কামাল আতার্তুকের ক্ষমতা গ্রহণকে উচ্ছ্বসিত করেছিলো। অথ্যাত ইসলামিক খিলাফতের বদলে প্রগতিশীল তুরস্কের সুচনায় নজরুল খুশি ছিলেন। কিন্তু এই কোলকাতা শহরে তুরস্কের একজন নেতাকে নিজেদের নেতা মনে করাকে নিরোদ সি চৌধুরী ভালো চোখে দেখেননি। কোলকাতার তার বাসার দোতলার বারান্দা দিয়ে তিনি দেখেছেন নজরুল রাস্তায় হারমনিয়াম বাজিয়ে নেচেগেয়ে মিছিল করছে কামাল পাশার জন্য। এগুলো কি জাতীয়তাবাদ?... তারপরও নজরুল এখনো এদেশের হিন্দু মুসলমান ঐক্যের জন্য যত বাণী কবিতা প্রেরণা যোগায় তার মূলে থাকেন। স্ববিরোধীতা স্বত্তেও তাই তাকে ফেলে দেওয়া যায় না। তার জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(সহায়তা নিয়েছি: বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল জীবনী, গোলাম মুরশিদ, নজরুল পত্রাবলী, আমার দেশ আমার শতক, নিরোদ সি চৌধুরী)।

#সুষুপ্তপাঠক
25 May 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted