উপমহাদেশের কমিউনিজম কখনো এখানে তাদের নিজস্ব মাটি পায়নি।

আমাদের এই উপমহাদেশে ইসলাম ও কমিউনিজমের যে একটা বিরাট প্রভাব আছে সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সমস্যা হচ্ছে কমিউনিস্টরা বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথের সরাসরি বিরোধীতা করেন, আর বুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বলেন না। ফলে উপমহাদেশের কমিউনিস্টদের দার্শনিক হিরো চীন রাশিয়া থেকে আমদানি করা। আপনি কোন বামপন্থি যুবককে পাবেন না যে এই ভূখন্ডের নিজস্ব হিরোকে স্বীকার করে। 

যে কারণে উপমহাদেশের কমিউনিজম কখনো এখানে তাদের নিজস্ব মাটি পায়নি। সাতশো বছরের ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ নিয়েও দেশীয় কমিউনিস্টদের কোন রা নেই। তাদের সমস্ত ইতিহাস কপচানো ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে। তাই ঢালাওভাবে তারা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের খারিজ করে দিয়েছে। আমাদের এটা মানাতে পেরেছে ইংরেজদের সকল কিছুই ছিলো খারাপ। অথচ নির্মোহভাবে বলতে গেলে বলা উচিত, ইংরেজ উপনিবেশকালেই এই দেশের শিক্ষা ও নারী জাগরণ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। সতিদাহ বিধবা বিবাহ যেমন আইন পাশ করা গেছে, তেমন করে বেগম রোকেয়া মুসলিম নারীদের লেখাপড়া করার অধিকার দিতে পেরেছে। 
সুলতানী আমল যদি আরো দীর্ঘ হতো রোকেয়া কি সেটি করতে সক্ষম হতো? মুসলিমদের মত গোঁড়া সম্প্রদায় মুঘল বা সুলতানী আমলে কি রোকেয়াকে মদদ দিতে এগিয়ে আসত?

গৌতম বুদ্ধের মত দার্শনিক যে মহাদেশে জন্ম নেয় সেখানে মানুষের দার্শনিক শূন্যতা রীতিমত হাহাকার করার মত। কল্পনা করুন এই পদ্মা মেঘনা যমুনার তীর ধরে পুরো বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বুদ্ধের দর্শন প্রবাহিত হতো তাহলে কেমন চেহারা আমরা দেখতে পেতাম? তার বদলে ইসলামের সাম্রাজ্যবাদী দর্শন পরো অঞ্চলকে গ্রাস করল। 
রামমোহনদের ব্রাহ্মধর্ম ছিলো সেই আর্য দর্শন জাতিকে এমন একটি দর্শনের সুযোগ করে দেয়া যার মাটি দেশীয় কিন্তু কাঠামো ইউরোপীয়। তাই ব্রাহ্মধর্মে মেয়েদের লেখাপড়া শেখা ও বেশি বয়েসে বিয়ের প্রচলন শুরু হয়। ইউরোপীয়ান খ্রিস্টানিটির প্রতি ব্রাহ্মধর্মের ঝোঁক ছিলো বুঝা যায়। বিদ্যসাগরের মত আদর্শগত জাতীয় আইকন ব্যক্তি থাকার পরও যখন কমিউনিস্ট জাগরণ এদেশে ঘটে তখন শিক্ষিত হিন্দুরা সে দলে যোগ দিতে থাকে। তারাই আওয়াজ তোলে শ্রেণীহীন সমাজের। সবই ঠিক আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে আঁচড়ে ফেলে মার্কস লেনিন গোর্কিকে নিজেদের দর্শন বানিয়ে ফেলে একটা কৃত্রিম সত্ত্বা তৈরি করা হয়। এটা বাঙালি হয়ে ইংরেজি ভাষার কবি হওয়ার মত ব্যাপার। কবিতা হয়ত লেখা হচ্ছে কিন্তু তাতে রস নেই!

ভারতবর্ষে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের সাতশো বছরে এই অঞ্চলে স্থাপত্য, খাদ্য, পোশাকের উপর বিরাট প্রভাব যেমন ফেলেছে তেমনি দার্শনিক প্রভাবও বিপুল। বৈষ্ণব ধর্মে যেমন সুফিবাদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। সুফিদের বৈরাগ্য ও ঈশ্বরের সঙ্গে মানব আত্মার সম্পর্ক বৈষ্ণবদের প্রভাবিত করলেও সুফিবাদও জিহাদ থেকে দূরে কিছু নয়। ইসলামের সব মতবাদই অন্তিমে জিহাদ করে ইসলামী সাম্রাজ্য স্থাপন শেষ কথা। ভারতবর্ষে সুফিরা তরোয়াল হাতে স্থানীয় হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এগুলো কোনটাই বুদ্ধের দর্শন নয়। ইসলাম এদেশে খালিদ বিন ওয়ালিদ, ওমরদের মুসলমানদের জন্য আদর্শ হিসেবে আমদানি করেছে। কাজেই বুদ্ধের ‘নির্বান’ থেকে তারা দূরে সরে গেছে। তারকোভস্কির সিনেমায় আমরা যে প্রকৃতির সন্ধান পাই, কিংবা যে ‘জোনের’ দেখা পাই সেটাই আসলে মানব মনের একান্ত দর্শনগত পথ। কোন সাম্রজ্য প্রতিষ্ঠার করার জন্য তার জন্ম নয়। কোন শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদান তার দর্শন হতে পারে না। 

রাষ্ট্রনীতি থেকে ব্যক্তি মানুষের দর্শন হবে পৃথক। সেই ব্যক্তি মানুষের জন্য বুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজন। আমরা তো রবীন্দ্রনাথকে দর্শনগতভাবে নেইনি। আমরা রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ঘটা করে উত্সব করি। শাড়ি পাঞ্জাবী পরে গান গাই। সেই গানের বিরোধীতা করে খালিদ বিন ওয়ালিদের উত্তরসূরীরা। কিংবা মার্কসবাদের প্রভাবে ‘বুর্জোয়া কবি’ বলে ব্র্যাত্য করি। তাই বুঝতে পারিনি আমাদের মনের নিভৃতে কোণে কোন দর্শনের অভাব। যখন আপনি আশাহত, যখন সব দর্শন ব্যর্থ, জগতের সমস্ত আশাবাদী দর্শন যারা বলে মানুষ কখনো হারে না, শেষ পর্যন্ত লড়ে গেলে সফলতা আসবেই- যখন এইরকম আশাবাদী দর্শনও ব্যর্থ, যখন আপনি দেখবেন আপনার শত চেষ্টায়ও ব্যর্থ তখনো আপনি রবীন্ত্রনাথকে কাছে পাবেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন সব শেষ হয়ে গেছে তবু বাঁচো, সব ধ্বংস হয়ে গেছে তবু পথের শেষ টেনো না, কিছুই পাবে না নিশ্চিত তবু জীবন প্রভাহিত হতে দাও...

“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
      সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
      যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গ নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
      দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
           তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
                এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।“
(দুঃসময়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

কমিউনিস্টরা আপনাকে ব্যক্তির এই একান্ত শান্তনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আপনি কেবল কলের শ্রমিক নন। শ্রমিকেরও মরমি কবি প্রয়োজন। ইসলাম আপনাকে শাহজালালের তরবারী হয়ে গর্জে উঠার দর্শন শুনায়। একান্ত প্রার্থনা নিজের ভেতরের গহীন অন্ধকারে সেখানে সনাতন ছাড়া কোন আলো নাই। সাহেবরা বলেছিলো, বুদ্ধ লাইট অব এশিয়া। কিন্তু এই সাহেবরাই যখন বলে তারকোভস্কি ‘সিনেমার বুদ্ধ’ তখন বুঝি তারা স্বীকার করে নিয়েছে বুদ্ধ লাইট অব ওয়াল্ড!...

আমি চাই না আমার এই লেখায় কোন ভুল বুঝাবুঝি থাকুক। যুক্তিবাদী একজন মানুষ হিসেবে আমি কোন ভাববাদের কথা বলছি না। আমি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে মানি। মানুষকে আমি সব সময় আকাশের দিকে চেয়ে দেখতে বলি। এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কি ভাবতে বলি। নির্জন ও একাকিত্বকে উপভোগ করতে বলি। প্রকৃতির মাঝে কান পেতে শুনতে বলি প্রকৃতির ভাষাকে। এখানে পরকাল স্বর্গ বেহেস্ত পাপ পূণ্য বলতে কিছু নেই। বুদ্ধ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ আসলে নিজের ভেতরে প্রশান্তি আশ্রয়, জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্টের ভার বহনের প্রেরণা, সব কিছুতে থেকেও আমি আপনাকে সন্ন্যাসী হতে বলি। এটাকেই বলে বোধহয় ‘সংসারে সন্ন্যাসী’। এটাই বোধহয় ‘বোধি’ লাভ। এটাই বোধহয় ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা…

#সুষুপ্তপাঠক
17 May 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted