হিন্দুত্ববাদ বনাম ইসলাম
.............................................................................................
১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাজস্থানে রূপ কাঁওয়ার নামের ১৮ বছরের এক যুবতী স্বামীর চিতায় সহমরণ করতে উঠে গোটা ভারত ও ভারতের বাইরে বিস্ফোরণ ঘটায়। তুমুল সমালোচনা হতে থাকে এই ঘটনা। কিন্তু রাজপুত নারীদের হাতেই সে সময় বিরুদ্ধ সমালোচনাকে কাউন্টার দিতে গঠিত হয়েছিলো ‘সতীধর্ম রক্ষা কমিটি’। এই কমিটির প্রধান নারী মঞ্জুশ্রী বাম্বোরী ছিলেন ইন্দিরা গাঁন্ধির অনুসারী। মানে সেই কংগ্রেস জমানার চিতোরের পরিস্থিতি এই ছিলো। সেই রাজস্থানের চিতোর ফের আগুন হয়ে উঠে যখন সঞ্জয় লীলা বানসালি ‘পদ্মনী’ সিনেমা মুক্তি দেয়। নিজেদের ঘোমটা, পর্দা আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য গণ জহর গ্রহণ কর্মসূচী নিয়েছিলো রাজপুত নারীরা। পিতৃতান্ত্রিকতা রক্ষা করার এই প্রচেষ্টাকে আধুনিক ভারতে মধ্যযুগে পথ চলা বললে কম বলা হয়। কিন্তু গোটা ভারত জুড়ে এরকম হিন্দু সমাজ না থাকাটা, কোথাও একই হিন্দু সেন্টিমেন্ট বজায় না থাকাটা, একজন অভিন্ন ধর্মীয় পুরুষের একই নির্দেশনা মান্য করার ঐতিহ্য না থাকায় গোটা ভারতে ‘হিন্দুত্ব’ কোন একটি চরিত্র দাঁড়াতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা হিন্দুত্বের রাজনৈতিক কোন চেহারা নেই। ‘হিন্দু’ বলতে কোন একক সংস্কৃতি, ধর্ম, পোশাক, ভাষা, খাদ্য, জাতি কাউকে বুঝায় না। যায় না বলেই ইসলামের মত করে হিন্দুত্ববাদ কখনোই একটি জাতি ও শাসনের জন্য কার্যকর হবে না।
ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ক্ষমতা গ্রহণ করায় রাজস্থান তো বদলে যায়নি। ভারতের রাজ্যগুলির নিজস্ব সংস্কার কুসংস্কার গোঁড়ামী একই রকম থেকে গেছে। কিন্তু ইরান আফগানিস্থানের সামাজিক চেহারা বেমালুক বদলে গেছে ইসলামী শাসনের আওতায় আসার ফলে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন হঠাত বদলে যেতে থাকে যখন শ্রমজীবী মানুষ মধ্যপাচ্যে চাকরি করতে যেতে শুরু করে। গত কয়েক দশকে দেওবন্ধ মাদ্রাসাগুলি বাংলাদেশের সামাজিক জীবনকে গোঁড়া মুসলিম করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের এখনো স্বঘোষিত কোন ইসলামী দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পক্ষান্তরে ভারতে স্বঘোষিত ‘হিন্দুত্ববাদী’ দল দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় বসে আছে। সেই হিন্দুত্বকে কি রাজস্থানের বাস্তবতায় ধরব নাকি পশ্চিমবঙ্গ? দিল্লি? নাকি উত্তর প্রদেশ?
ধরুন ভারতের রাজপুত নারীরা যে বিরাট ঘোমটা দিয়ে নিজেদের মুখ ঢেকে রাখে এটা কি ‘হিন্দুত্ববাদ’? রাজপুত নারীরা কি কংগ্রেস বাম জমানায় এরকম ঘোমটা পরত না? এটা তো হাজার বছরের একটা সংস্কার। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি আরএসএস ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে কি এই সমস্যা মিটে যাবে? যাবে না। কিন্তু ইরান থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র উঠে গেলে দেখবেন মেয়েরা ঘর থেকে বাইরে এসে তাদের মাথার হিজাব আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে! আফগানিস্থানে মার্কিন হস্তক্ষেপের পর সিনেমা হল যখন ফের চালু করে দেওয়া হলো তখন মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো সিনেমা দেখতে, দাড়ি কাটতে সেলুনে ভীড় হয়ে গিয়েছিলো। বোরখা খুলে ফেলার হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। বিষয়টা হচ্ছে, আমাদের মা খালা মাসিরা এদেশে মাথায় কাপড় দিয়েছে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাজার বছর ধরে। এটি সহজে মুছে যাবার নয়। কোন সরকার বা শাসনতন্ত্র এটিকে বাড়াতে কমাতে পারবে না। বাংলাদেশে দেওবন্ধ মাদ্রাসার হুজুররা ক্ষমতায় আসলে সবাইকে বাধ্যতামূলক বোরখা পরতে ও পুরুষদের বাধ্যতামূলক দাড়ি রাখতে বলতে পারে। এটাই ‘ইসলাম’। না হলে মাথায় কাপড় দেয়া এদেশের নারীদের ট্রেডিশন। যেমন বয়সকালে মুসলমান পুরুষদের দাড়ি রাখাটাও ট্রেডিশন। কিন্তু দাড়ি না রাখলে সরকারী চাকরিতে যোগ দিতে দেওয়া হবে না, বেত মারা হবে, জরিমানা করা হবে- এরকম কোন ঘোষণা যদি কোনদিন আসে তবে সেটা বিশেষ শাসনতন্ত্র। রাজপুত ঘোমটা কিংবা শিখদের দাড়ি পাগরিকে বামপন্থিরা ইসলামের পর্দা ও দাড়ি রাখার জবরদস্তের সঙ্গে কি ইচ্ছে করেই গুলিয়ে ফেলেন?
আমি বলতে চাইছি ‘হিন্দুত্ববাদ’ ও ‘ইসলাম’ একই রকম সমস্যা নয়। ভারত থেকে হিন্দুত্ববাদীদের আগামী নির্বাচনে পরাজিত করে দিতে পারলেই এটা মিটে যাবে। কিন্তু রাজস্থানের ‘সতীস্থান’ দেখতে ভক্তদের ভীড় কমবে না। কিন্তু বাংলাদেশে কওমি দেওবন্ধ মাদ্রাসার হুজুরদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এদেশের আবহমানকালের সংস্কৃতি ফের বিকশিত হবে। ইরানের খোমিনির ইসলামিক রিপাবলিক আগামীকাল পতন হলে ইরানের সামাজিক চিত্র আমূল বদলে যাবে। বদলে যাবে আফগানিস্থান। বদলে যাচ্ছে সৌদি আরব। সেখানে ইসলামী শাসন উঠে গেলে সৌদিদের দেখা যাবে আরব বেদুইন সংস্কৃতি সেখানে জেঁকে বসছে। ইসলাম যে কৃত্রিম সংস্কৃতি ও জাতিসত্ত্বা কোন জাতিগোষ্ঠির উপর ফেলে তা কখনো গভীরে প্রবেশ করে না বলেই আমার বিশ্বাস। ইসলামের নিয়ন্ত্রণের ফলে দেখা যায় সেই জাতি তার পুরোনো সংস্কৃতিতে ঘেঁষতে থাকে। ভারতবর্ষে ‘ওহাবী আন্দোলন’ তার প্রমাণ। মুসলমানদের উপর ইসলামের প্রভাব কমে গিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি জেঁকে বসতেই শরীতুল্লাহ-তীতুমীর শুরু করে ওহাবী আন্দোলন যাতে মুসলমানরা ইসলামিক সংস্কৃতি ধরতে পারে। সেদিন থেকে বাঙালী মুসলমান নিজের সংস্কৃতিকে শিরক পাপ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। কিন্তু আপনি কি রাজপুতদের দিয়ে বাঙালি হিন্দুকে হিন্দুত্ববাদ মানাতে পারবেন? বাঙালিকে দিয়ে রাজপুতদের? কিন্তু মুসলমানদের কিন্তু কিবলা সৌদি আরব। সহি ইসলামের চর্চায় তারা একটি সুনির্দিষ্ট তড়িকা অনুসরণ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলসানরা দেওবন্ধ মাদ্রাসাকে ফলো করে। সেই দেওবন্ধকে ফলো করে এখন যারা আফগানিস্থানে ক্ষমতায় বসে আছে। হিন্দুত্ববাদীদের কিবলা ঠিক কোনটি?
ইসলামিক শরীয়া আইন সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এক ও অভিন্ন। খ্রিস্টান, ইহুদী সকলেরই ধর্মীয় আইন এক ও অভিন্ন। কিন্তুর হিন্দুর দেশকাল ভিন্ন। তাই বালি দ্বিপের হিন্দুর সঙ্গে ভারতের হিন্দুর নিয়মে মেলে না। সমগ্র ভারতবর্ষে হিন্দুর সুনির্দিষ্ট কোন একক ধর্মীয় পুরুষ নেই। তাই ‘রাম নবমী’ সমগ্র ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা ইসলামের নবীর মত আবেগ সৃষ্টি করতে পারবে না। যে কারণে ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও তাদের নবীর নামে তান্ডব চালাতে ভীত হয় না। ফ্রান্স বেলজিয়াম কোথাও তারা নবী অবমানরার জন্য আইন হাতে তুলে নিতে ভয় পায় না। ইসলাম তাই কোনভাবেই হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এক ভারতেরই রাম যেমন ভগবান তেমন রাবণও ভগবান। কেমন করে হিন্দুত্ববাদ তাদের একই সুতায় বাঁধবে?
বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলাম কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদের মত সমস্যা নয়। এখানে ইসলাম ধর্মীয়ভাবে সমাজের উপর চেপে বসতে পারে। পুরো একটা গান বাজনা করা জাতিকে মুল্লায় পরিণত করে দিতে পারে কয়েক দশকে। ১৯৭০ সালের আফগানিস্থান ও ১৯৪০ এ দশকের ইরান হচ্ছে তার প্রমাণ। পুরো একটা জাতির পোশাক আচার আচরণ বদলে দিতে পেরেছে ইসলাম। অথচ মুসলিম ঐতিহ্য হিসেবে এসব দেশে আগে থেকেই ইসলামী আদব প্রচলিত ছিলো যেগুলির সঙ্গে আপনি বাংলাদেশের নারীদের মাথায় কাপড় দেওয়া ও বয়স্ক পুরুষদের দাড়ি রাখাকে তুলনা করতে পারেন। ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা সামাজিকভাবে এরকম কোন বদল আনতে পেরেছি কি? কেন পারল না? ভারতীয় হিন্দুদের পশ্চিমের দেশে বিশাল ও প্রভাবশালী কমিউনিটি থাকার পরও কেন সেখানে বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের দাবী হতে দেখি না? এটা কিন্তু মূল পয়েন্ট। ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু যুক্তি দেখিয়ে যারা বলেন ভারতে ইসলামী মৌলবাদ কোন আতংকের শংকার কিছু নয় তারা ইসলামের ফিলোসফিকেই জানেন না। ভারতের হিন্দু সমাজকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতায় নেই হিন্দুত্ববাদীদের। ভিএস নাইপল এ জন্যই বলেছিলেন, ইসলাম ভাষা ও সংস্কৃতির উপর উপনিবেশ চালায়।
আমার কথা বুঝার চেষ্টা করেন, হিন্দু শাস্ত্র ঘাঁটলে নারীদের প্রতি বৈষম্য ও হেয় করা উক্তির অভাব নেই। হিন্দু নারী স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। সম্পত্তিতে অধিকার নেই। কিন্তু ভারত স্বাধীন হবার পর হিন্দু শাস্ত্র নয়, আধুনিক আইন ও মানবাধিকার অনুযায়ী চলেছে। তবু এখনো বিশাল ভারতবর্ষে দলিতদের প্রতি তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সামাজিক বৈষম্য নিপীড়ণ রীতিমত মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। রূপ কাঁওয়ার সহমরণ করেছে রামমোহনের সতীদাহ রদ করার আড়াইশো বছর পর। হিন্দুত্ববাদীদেরও সতীদাহ রদ আইনকে মান্য করতে হয়। কিন্তু তিন তালাক বিল বাতিল করার পক্ষে কোন ইসলামিক শক্তি কি রাজি থাকে? যে সমস্যাগুলির কথা বলা হলো ভারত যারাই শাসন করেছে বাম ডান সেক্যুলার সকলের সময়ই ছিলো আছে। এর কারণ এটা ভারতের কয়েক হাজার বছরের সামাজিক সমস্যা। ‘পর্দা’ না করলে বাংলাদেশের মেয়েদের উপর যে সাইবার বুলিং, শারীরিক হেরেজমেন্ট শুরু হয়েছে সেটি কিন্তু এখানকার কালচার ছিলো না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির মেয়েরাই প্রথম শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজের পরা শুরু করে। এর আগে বাঙালি নারীরা ব্লাউজ পরত না। এখানে পর্দা নিয়ে বাড়াবাড়ি ইসলামী প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত, রাজপুতদের মত জাতিগত সমস্যা নয়।
#সুষুপ্তপাঠক
21 May 2022
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................