কেন বর্তমান সময়ের অঘোষিত ইমাম মেহেদী এরদোয়ানের তুরস্কে বহুবিবাহ আইন করে নিষিদ্ধ করা?

ভারতে মুসলমান ছাড়া অন্য সব ধর্মের মানুষদের জন্য বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। বহু বিবাহ করা মুসলিম পুরুষদের জন্য কুরআনের আইন। তাই ভারতে সকলের জন্য একই আইন থাকলেও এক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য রয়েছে পৃথক আইন। বিষয়টি ফের সামনে চলে আসল ভারতীয় মুসলিম নারী রেশমা আদালতে তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে ঠেকাতে আর্জি পেশ করায়। এর ফলে গোটা ভারতে নতুন করে মুসলিমদের কুরাণিক অধিকার চার বিয়ে বিষয়ে আবার আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে।

বিষয়টা এমন না যে মুসলিম মাত্রই চার বিয়ে করে। যদি পার্সেন্ট যাচাই করে দেখেন তাহলে সেটা এক পার্সেন্টও হবে না। কিন্তু মোটামুটি অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের ধারণা মুসলমান পুরুষের ঘরে চার বউ থাকাবেই কিংবা চার বিয়ে করবেই। এই ধারণা হওয়ার পিছনে যদি কারোর প্ররোচনা থেকে থাকে সেটা খোদ মুসলমানদেরই। কারণ যখনই বহুবিবাহ নিষিদ্ধের দাবী উঠেছে মুসলমানরাই বাঁধা দিয়ে বলেছে, এটা আমাদের কুরআনের আইন, এটা নিষিদ্ধ করলে কুরআন অবমাননা হবে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হলেও শুধু মুসলমানদের সেই অধিকার রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মত মুসলিম দেশগুলিতেও কার্যত বহুবিবাহের দরজা খুলে রাখা হয়েছে শুধু ইসলামের বিধান বজায় রাখার জন্য। কিন্তু মুসলিম নারীরা মূলত এই বহুবিবাহের আগুনে পুড়ে থাকে। এমনকি বহুবিবাহ শিশুদের উপর মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মুসলিম নারীরা এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন আন্দোলন করতে না পারলেও ভারতে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম নারীদের সংগঠনগুলি বহুবিবাহ আইন বাতিলের দাবীতে আন্দোলন করছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড। এই বোর্ডের মহিলা বিভাগের প্রধান ড. আসমা জোহরা বলেন, ‘ইসলামী আইন হচ্ছে ঐশী। আমরা কুরআন হাদিসকে মানি। আল্লাহ যা আইনসিদ্ধ করেছেন তা পরিবর্তন করার অধিকার কোন মানুষের নেই’।

শিক্ষিত এই নারী নিজেই মুসলিম পুরুষের একাধিক বউ পোষার পক্ষে আদালতে পড়ছেন। কুরআন হাদিস অনুযায়ী তিনি মাহরাম ছাড়াই আদালত যাচ্ছেন। তিনি ডক্টরেট করতে গিয়েছিলেন মাহরাম ছাড়া বলাই বাহুল্য। ভারত যদি আফগানিস্থানের মত মুসলিম দেশ ও শাসনে চলত তাহলে এই আসমা জোহরাকে সত্যিকারের কুরআন হাদিসের আইন অনুযায়ী চলতে হতো। তখন কি সে এইসব ধর্মীয় বোর্ডের সদস্য হয়ে বসতে পারত? পারত না। তবে এই আসমা জোহরাদের চেয়েও বেশি ভয়ংকর মডারেট মুসলমানরা। কারণ এই বিতর্কগুলির সময় তাদের মূল ফোকাস থাকে ইসলামকে রক্ষা করা- ভিকটিমদের রক্ষা করা নয়। ভারতে যখন বহুবিবাহ নিয়ে ফের আলোচনায় তখন আরেক শিক্ষিত মানুষ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেশি একরাশ মিথ্যা বলেছেন ইসলামকে বাঁচাতে। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, “ভারতে মুসলিম পুরুষরা চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে এবং কোরআনে বহুবিবাহের অনুমোদন আছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে "কড়া পূর্বশর্ত এবং বিধিনিষেধ আছে" - যা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব”

একদমই অসত্য দাবী। একাধিক বিয়ে করার জন্য কোন মুসলিম পুরুষকে ইহকাল পরকাল কোথাও জবাবদেহী করতে হবে না। আলী যখন ফাতেমাকে বিয়ে করেছিলেন তখন তার কাছে কোন টাকা পয়সা ছিলো না। দেনমোহর হিসেবে আলী তাকে একটা যুদ্ধের পোশাক দিয়েছিলেন। যার কাছে কিছুই থাকবে না সে বিনিময়ে কিছু সুরা পাঠ করলেও দেনমোহর উসুল হয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে কোন কারণ দর্শন ছাড়াই মুসলিম পুরুষ স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে। এ জন্য আল্লাহ তাকে জবাবদেহী করবে না। কড়া শর্ত বলতে জনাব কোরেশি কি বলতে চেয়েছেন সেটি জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো বিবিসির। সব স্ত্রীদের সমান চোখে দেখা ও রাখা? বিয়ের আগে এমন অঙ্গিকার করে পরে রাখতে না পারলে কোন মুসলিম পুরুষের পরকালে কঠিন শাস্তি হবে এমন কোন বিধান মিস্টার কোরেশি কুরআন হাদিস থেকে দেখাতে পারবেন না। খোদ প্রেফট মুহাম্মদের ১১ স্ত্রীর মধ্যে কলহ শুরু হলে তিনি সবাইকে তালাক দেয়ার কথা ভেবেছিলেন হাদিস থেকে জানতে পারি। কাজেই কোরেশি নিজের ধর্মের সন্মান রক্ষার জন্য এগুলো বলেছেন।

মিস্টার কোরেশি আবার বলেছেন "কোরআন বলছে, একজন পুরুষ দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে কিন্তু তা করতে হবে শুধুমাত্র অনাথ ও বিধবাদের মধ্যে থেকে - এবং তাদের সাথে সমান ব্যবহার করতে হবে, অন্য কোন কিছু করলেই তা হবে লঙ্ঘন"

একদমই নির্জলা চাপা! এমন বিধান তিনি কোত্থেকে পেলেন কেবল অনাধ ও বিধবাদের বিয়ে করা যাবে? তাহলে আয়েশা কি অনাথ নাকি বিধবা ছিলো? সারাবিশ্বে মুসলিম পুরুষদের যে বহুবিবাহ ঘটেছে তারা কেউ এরকম বিধান মেনেছেন? ইসলাম সম্পর্কে ভারতের অমুসলিমরা কিছু জানবে না সেটাই স্বাভাবিক- তাই তাদের কাছে নিজের ধর্মের সন্মান রক্ষার্থে তিনি এই মিথ্যাচারটা করেছেন।

কোরেশি আরেক জায়গায় বলেছেন, “তখন আরবে গোত্রে-গোত্রে যুদ্ধ চলতো, বহু পুরুষই অল্প বয়সে মারা যেতো - তাই বিধবা ও এতিমদের সহায়তার জন্যই বহুবিবাহের কথা বলা হয়। কিন্তু আসলে কোরআন বহুবিবাহকে ভালো চোখে দেখে না এবং এটাকে নিরুৎসাহিত করে"

আবার চাপা! ইসলাম যদি বহুবিবাহকে মানবিক কারণে অনুমোদন দিতো তাহলে পুরুষের পাশাপাশি নারীকে বহুবিবাহের অনুমতি দিলো না কেন? নারী কি দুজন পুরুষকে একত্রে বিয়ে করতে পারবে? ইসলাম তো নারীদের তালাক দেওয়ারও কোন অনুমতি দেয়নি। বলে রাখা ভালো বাংলাদেশ পাকিস্তানে মুসলিম নারীদের তালাকের যে অধিকার তা সম্পূর্ণই ১৯৫৪ সালের পাশ করা আইন। এটি পুরোপুরি কুরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিলো বলে সেকালে আলেমরা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলো। বহুবিবাহকে যদি কুরআন নিরুত্সাহিত করত তাহলে প্রধান চার সাহাবী কেমন করে চারের অধিক বিয়ে করেছিলো? মিস্টার কোরেশিকে কেউ একটু জিজ্ঞেস করবেন, ইসলামে একত্রে চার বউ রাখার বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু তালাক দিয়ে সেই চারের কোঠা পূরণ করতে যে কোন বাধা নেই সেটির কথা তিনি কেন বললেন না? আলী পুত্র হাসান ৮০ টি উপর বিয়ে করেছিলেন এই তড়িকায় তিনি কি সেটা জানেন নাকি জেগে ঘুমান?

ভারতীয় মুসলিম নারীরা এগিয়ে আসছে এটিই সবচেয়ে বড় সুখবর। বলে রাখা দরকার ভারতীয় মুসলিম নারীদের এই সামাজিক আন্দোলনে কখনোই কমিউনিস্টরা বা কংগ্রেস কেউ সমর্থন করেনি পাছে তাদের ভোট নষ্ট হয়। এরা বরং তিন তালাক, বহুবিবাহের পক্ষে দাঁড়িয়েছে পরোক্ষভাবে। ভারতের মুসলিম পার্সোনাল ল বাতিল হয়নি এই পার্টিগুলির কারণে। অথচ ভারতীয় মুসলিম নারীদের অধিকার আদায় সংগঠনগুলির দাবী ছিলো সেটি। এখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ধর্মীয় আইনগুলিকে বাতিল করে একটি অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ আইনে বিয়ে ও সম্পত্তি বন্টনে নতুন আইন করার ঘোষণা দেয়ায় সুর উঠেছে মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে আঘাত করার জন্যই এটি করা হবে। অথচ বর্তমান সময়ের অঘোষিত ইমাম মেহেদী এরদোয়ানের তুরস্কে বহুবিবাহ আইন করে নিষিদ্ধ করা! মোদী সরকার যদি ভারতীয় মুসলিম নারীদের দাবীর পক্ষে যায় এমন কোন আইন করে, ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ অভিন্ন আইনে পারিবারিক বিষয়ে নিষ্পত্তি করতে বিল উঠায় দেখার বিষয় অরুন্ধতী নোয়াম চেমিস্কদের সমর্থন মেলে কিনা!

#সুষুপ্তপাঠক
12 May 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted